বহু বছর পর সেই মুখ, দৃশ্যমান হয়েই আবার মিশে যাচ্ছিল জনস্রোতে। একবার ভাবে, মিশে যেতে দেওয়া যাক। পরের দৃশ্যে দেখা যায় ছুটে যেতে। অপস্রিয়মাণ আলো–আঁধারি ছেঁকে হঠাৎ নিজের সামনে তুলে ধরল সে, লাবণীর মুখ।
‘হ্যালো লাবণী! চিনতে পারছেন? দেখলেন, কেমন সন্ধ্যাবেলাতেই আবার দেখা হয়ে গেল!’
বলতে গেলে, এই সন্ধ্যাটা রাফির জীবনে এমনি এমনি তো আসেনি। এসেছে প্রতিটা সন্ধ্যা জোড়া দিয়ে দিয়ে। অবিচ্ছিন্ন গাঁথুনির একেকটা সন্ধ্যা ধরে ধরে পিছিয়ে বহুদূরে পৌঁছে গিয়ে আবারও কোনো সন্ধ্যায় এ দুজনকে একত্রে পাওয়া যাবে।
সেলিব্রিটি টিভি নাটক নির্মাতার আপন বোন লাবণী জেলা শহরে বিখ্যাত ছিল অন্য কারণে। সে তার ভাইয়ের চেয়েও বেশি বিখ্যাত হয়ে ওঠার কোনো উদ্যোগ নিজে কখনোই নেয়নি। অথচ হয়ে উঠেছিল। অবশ্য শুধু বিদ্বৎসমাজেই। ঈদের পরদিন লাবণী ওর ভাইয়ের নির্মিত মূল্যবান স্লটে প্রচারিত টিভি নাটকগুলো দেখত না।
ওই সময় রাফিসহ তাকে দিঘির পাড়ে গিয়ে বসতে হতো। রাফি সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। নাটক লেখে। নাট্যাচার্য মহাশয়ের নির্দেশে দ্রুত পড়ে শেষ করছে তলস্তয়ের আনা কারেনিনা। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী লাবণী রাফিকে বুঝিয়েই চলেছে সামাজিক নানান স্তরবিন্যাস।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে গিয়ে সেনা–সমর্থিত সরকারের শপথ গ্রহণের সন্ধ্যায়ও দুজন একসঙ্গে ছিল। হাঁটতে হাঁটতে রেলব্রিজ ছাড়িয়ে শহরের বাইরে গিয়ে পৌঁছে। একটা টংদোকানে চা খেতে খেতে শপথ গ্রহণের সাক্ষী হয়েছিল। তাদের দুজনের মধ্যে কোনো শপথ গ্রহণ নেই কেন, এমন কথাবার্তাও উঠে এসেছিল ফিরতি পথে।
পরে জানা গিয়েছিল ডিপার্টমেন্টের এক স্যারের প্রেমে পড়ে জ্বর উঠে গেছে লাবণীর। সেই স্যার ওকে কোন পর্যায়ের, হিপনোটাইজই বলবে রাফি, করেছিল যে, কোনো কোনো সন্ধ্যায় লাবণী ব্লেডের হালকা আস্তরে নিজের হাত কাটতে আরম্ভ করল। একেক সন্ধ্যায় রক্তাক্ত হাত ধরে বসে থাকতে বলত রাফিকে। কিছুতেই রাজি হতো না রাফি। তার প্রস্তাব ছিল পায়ে পা ঘষবে। কোনো কোনো সন্ধ্যায় রাফির ধারণা হতো, লাবণী মূলত বদ্ধ এক উন্মাদিনী। রাফির বাসা থেকেও সাবধান করা হয়েছিল, লাবণীর সঙ্গে এত মেলামেশা কিসের।
‘আপনার স্যার হুট করে মারা গেলেন। জানেন নিশ্চয়ই?’ বর্তমান সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটের বারান্দায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রাফি বলছে।
‘খবরটা মিস করে যাওয়ার উপায় ছিল কি? যেসব কাণ্ড ঘটিয়ে মরলেন!’
‘আহা!’ আফসোস করে রাফি, ‘ব্যাপারটা আমার কাছে খুব প্যাথেটিক মনে হয়েছে। শিক্ষার্থীর সঙ্গে কলরেকর্ড ফাঁসের জেরে স্যারের চিকিৎসা-সহায়তা ফান্ডিংটা মুখ থুবড়ে পড়ল।’
লাবণী কিছু বলল না। স্যারের প্রতি রাফির ঈর্ষা ধরতে না পারার মতো বোকামি সে কখনোই করেনি। এত দিন পর মোক্ষম অস্ত্র পেয়েছে।
স্যার যখন লাবণীর শহরে এসে উঠত, থাকত রাফির বাসায়। শুধু সন্ধ্যাবেলায় লাবণী বের হতে পারত বা বের হতো যখন, রাফি চাইত সটকে পড়তে। কিন্তু স্যারও তাতে যেন খানিক আতঙ্কিত বোধ করতেন। ‘রাফি থাকুক না’, বলে বলে রাফিকে রেখে দিতেন। স্যারও হয়তো ভয় পেতেন উন্মাদিনী শিক্ষার্থী একা পেয়ে তাকে কোন বিপদে ফেলে আবার!
‘আপনিও আর দশজনের মতো স্যারকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছেন এখন?’ চুপ থাকা লাবণীকে জিজ্ঞেস করে রাফি।
লাবলী কেয়ারলেস ভঙ্গিতে বলে, ‘না। আসলে ঘৃণার সংস্কৃতিটাকেই আমি ঘৃণা করি। তা ছাড়া তোমাকেও দেখতে পাচ্ছি স্যারের প্রতি যথেষ্ট দরদি!’
ডিপার্টমেন্টের এক স্যারের প্রেমে পড়ে জ্বর উঠে গেছে লাবণীর। সেই স্যার ওকে কোন পর্যায়ের, হিপনোটাইজই বলবে রাফি, করেছিল যে, কোনো কোনো সন্ধ্যায় লাবণী ব্লেডের হালকা আস্তরে নিজের হাত কাটতে আরম্ভ করল। একেক সন্ধ্যায় রক্তাক্ত হাত ধরে বসে থাকতে বলত রাফিকে।‘খোঁটা দিচ্ছেন? ধরতে পারছি না যদিও। পুরুষ হয়ে পুরুষের পক্ষে দাঁড়ালাম কি?’
‘স্যারের কথা থাকুক। তোমার খবর বলো।’ প্রসঙ্গ বদলাতে চায় লাবণী।
‘না না, বলেন প্লিজ, কোনো ব্যাপারে কি বাধ্য হয়েছিলেন আপনি? নাকি বলা যায়, আমিই তা হয়েছি? স্যারকে আর আমাকে এক করে দেখানো উচিত না আপনার।’ ত্বরিত প্রতিক্রিয়া দেখায় রাফি।
‘কোথায় এক করে দেখলাম? বলেছি একবারও?’ লাবণী জানতে চায়।
‘তা বলুন আর নাই–বা বলুন, শুনে রাখুন, না আমার, না স্যারের—কারও পক্ষ থেকেই কোনো জোর তো ছিল না আপনার প্রতি। আপনিই মূল্য পরিশোধের ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। অথচ কেউ মূল্য ধরেইনি।’
কেউ মূল্য ধরেনি! এমন কথায় লাবণীর সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরে। ব্যাপারটা যদিও স্পষ্ট, স্যারকে ঈর্ষান্বিত করতে সর্বোচ্চ দু–একবারই হবে—রাফিকে জাপটে ধরে চুমু খেতে হয়েছে। সেই শোধ কি রাফি তোলেনি কক্সবাজার গিয়ে? অবশ্য লাবণীই অনেক বলে-কয়ে ওকে নিয়ে গিয়েছিল। ট্যুরে স্যার সস্ত্রীক থাকছে, আর সে একা একা ঘুরে মরবে? একা জাগবে, একা ঘুমাবে? তা হয় না। তবে যতটুকু হওয়ার তা যে শুধু স্যারের সামনেই হওয়ার—এ সামান্য হিসাব না বোঝা ছেলে আজ তার সামনে দাঁড়াচ্ছে বড় গলা নিয়ে? হাস্যকর লাগে লাবণীর।
সে কর্কশ গলায় বলল, ‘স্যারের দায়িত্বও নিয়ে নিচ্ছ! তোমাদের মধ্যে এসব নিয়ে কথা হতো নাকি?’ তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলল—‘সুখস্মৃতি রোমন্থনের মতো!’
পাল্টা জবাবে রাফি বলে, ‘সুখটাও দেখি চাপিয়ে দিতে চান। আমাকে একটু সময় দিন না, এমনও হতে পারে আমি নিজেই স্বীকার করব!’
‘যে ওসব সুখস্মৃতিই ছিল? হাহা, যেন সেটা স্বীকার করার অপেক্ষা রাখে!’ সামনে এগিয়ে এসে বলে, ‘আমি বলছি শোনো, বিকৃত সুখ বলাটাই সমীচীন হবে তোমাদের ক্ষেত্রে।’ হঠাৎ মনে পড়ায় জুড়ে দিল, ‘হ্যাঁ, শেষ দিকে ফেসবুকে দেখতাম তোমার আর স্যারের মধ্যে খুব দহরম-মহরম। খুব শেয়ারিং হতো আমাকে নিয়ে, তাই না?’
খানিক দমে গিয়ে রাফি বলতে নিল, ‘আপনি তো শুধু স্যারকেই না, আমাকেও ভীষণ ঘৃণা করেন দেখছি.
বিজাতীয় কণ্ঠে বলল, ‘তার আগে তোমাকে জানতে হবে, বিকৃত সুখ ব্যাপারটা নিয়ে আমি নিজে কী ভাবি।’
টাসকি খেয়ে রাফি বুঝল, ‘মানে খারাপ ভাবেন না?’
‘খারাপ না ভাবলে কি এখনই আবার বিকৃত সুখের দিকে ছুটতে হবে নাকি?’
‘এতটাও নাছোড়—কখনো ছিলাম কি?’ সিগারেট জ্বালতে জ্বালতে রাফি প্রশ্ন তোলে।
‘বাহ্, এখন দেখি নিজেকে নিরাসক্ত প্রমাণেরই জয়জয়কার।’ বলেই আকস্মিকভাবে হাত ধরে ফেলে রাফির—‘আহা ষোলো বছর আগের হাত! আচ্ছা আমাকে বলো তো, মূল্য পরিশোধের ব্যাপারটা কী?’
‘সেটা শুনতে চাওয়ার মানে আছে? আপনি ভালো করেই জানেন আপনার স্বভাব।’ এর মধ্যে শক্ত করে লাবণীরই হাত আঁকড়ে ধরেছে রাফিও।
‘আমার স্বভাব! কী সেটা বলো, আমি জানি না।’ লাবণী হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়।
‘আপনার স্বভাব কী, সেটা আপনি জানেন না?’
‘না।’
‘ঠিক আছে, শুনুন তাহলে।’ হাত ছেড়ে দিয়ে রাফি বলতে লাগে, ‘আপনার পরিচয় হলো আপনি বদ্ধ উন্মাদ এবং স্বভাবগ্রস্ত এক জাত চোর। আমি নিশ্চিত এখনো এসব স্বভাব আপনি ছাড়তে পারেননি।’
বিস্ময়ে বাক্রুদ্ধ অবস্থা লাবণীর, ‘এসব কী বলছ তুমি!’ তীব্রভাবে খামচে ধরে এবার রাফিকে।
‘সে কি আপনি পড়ে যাচ্ছেন নাকি? থাকুক না। আমি তো বলতে চাইনি।’
‘প্রসঙ্গ তুলে বলতে না চাওয়া কেমন ভদ্রতা?’
‘তাহলে তো জানেনই। আপনি কী করেছেন, সেটা নিজেই আপনি ভালো জানেন।’
‘তুমি যা জানো, বা বলতে চাচ্ছ, বলোই না।’
‘সাদি ভাইয়ের একটা নাটক ছিল না? ওই যে অভিজাত ঘরের সম্ভ্রান্ত এক মহিলা নিতান্তই অভ্যাসের বশে প্রতিবেশীর ঘর কি দোকানপাট থেকে সুযোগ পেলেই এটা–সেটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। অভাব ছিল না মোটেই, স্বভাবই ছিল চুরির।’
জেলায় ব্যাপক সাফল্যের পরে একদিন ঢাকা শিল্পকলায় শো করে ফেরার সময় সাদি ভাই রাফিকে জানায়, নাটকটি মঞ্চস্থ করার অনুপ্রেরণা তিনি নাকি লাবণীর কাছ থেকেই পেয়েছেন।
‘সাদি ভাইয়ের বাসায় গিয়ে কী করেছেন? ভাবির নেকলেসটা চুরি করেননি? কিংবা সরোয়ার ভাইয়ের আলমারি থেকে দুলাখ টাকা, আপনিই তো সরিয়েছিলেন।’ উত্তেজিত হয়ে যায় রাফি। খামচে থাকা লাবণীকে ঝাঁকি দিয়ে সরিয়ে দেয়।
‘এমনকি আমার আপার ফোনটা পর্যন্ত চুরি করেছেন। ছি, কীভাবে পারলেন?’
জবাবে শান্ত কণ্ঠে লাবণী বলল, ‘রাফি, এসব অভিযোগ কমবেশি আমার কানেও এসেছে। শুধু জানতাম না, তুমিও এসবের প্রচার করতে। সাদি ভাই কি কম করেছেন নাকি। আসমা আপা বাসায় এসে নিজে সার্চ করে গেছেন।’
‘তাই বুঝি? কিছু পায়নি নিশ্চয়ই, কারণ আগেই আপনি বিক্রি করিয়েছিলেন নেকলেসটা। অবশ্য খুবই কম মূল্যেই হয়তো, চুরির জিনিস...’
‘প্লিজ থামো রাফি। আমি যাই। তোমার সঙ্গে আর দেখা না হোক।’
‘না না, আপনাকে শুনতে হবে তো। শুনতে চেয়েছেন যখন।’
‘নাই–বা শোনালে আর। আমি কিন্তু তোমাকে মিস করতাম রাফি, এখনো করি...’
‘হা হা। আপনি আবারও ছলচাতুরী শুরু করছেন। আমি তো আপনাকে চিনি লাবণী। এখন মিস করার গল্প শোনাবেন। আমাকে নিয়ে লেখা কবিতাও শোনাবেন হয়তো! নানাভাবে ভোলাবেন যেন, জেনেও আমি আর একটা শব্দও না বলি। জেনেও কিছু না জানি আগেকার মতো!’
স্খলিত চোখে ঢলে পড়া শরীরে লাবণী বলল, ‘জেনেও কি না জানো, আমার চোর স্বভাব?’
অবশ্যই। এবং স্যারের সামনে আমাকে প্রতিমা হিসেবে খাড়া করার ব্যাপারে। কিংবা আমার সামনে স্যারকে প্রতিমা হিসেবে খাড়া করার ব্যাপারে।’
‘তার মানে এভাবেই মূল্য পরিশোধের ব্যতিব্যস্ততা তৈরি হতো আমার মধ্যে?’ ধরে ফেলে লাবণী।
‘হ্যাঁ। এটাকেই বলা হচ্ছে মূল্য পরিশোধের ব্যতিব্যস্ততা, যা আপনার মধ্যে ইনবিল্ট, আপনার ছলনাময়ী চোখে আপনাতেই ভেসে উঠেছে এখনো। কীভাবে কীভাবে যেন সব ভুলিয়ে দেবেন এখন। আমি জানি...’
হেসে ফেললে লাবণী। মানা করে রাফি—
‘না লাবণী, হাসবেন না প্লিজ। আপার ফোনটা আপনি সায়েমের দোকানে বিক্রি করেছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকায়। অস্বীকার করতে পারবেন? ফোনটা আমি কিনে নিয়েছিলাম আবার।’
অবাক মানে লাবণী, ‘তাই! কিনে কি আপাকে ফেরত দিয়েছিলে?’
‘নাহ! তা কী করে দিই। ফোনটা আমি ফেলে দিই ব্রিজে গিয়ে।’
‘ফেলে দিলে কেন?’ সরলভাবে জানতে চায় লাবণী।
‘প্রমাণ নষ্ট করলাম। চাইনি তো কেউ জানুক আপনার মতো একজন চোরের সঙ্গে আমার প্রেম।’
‘হা হা হা।’ উচ্ছল হয়ে ওঠে লাবণী।—‘তলে তলে এত কিছু তাহলে!’ যেন রাফির আশঙ্কামতোই মিথ্যেমিথ্যি ছলনাময়ীর ভূমিকায় অভিনয় করে দেখাচ্ছে এবার।
‘কোনটা সত্য কে জানে! অভিনয়টাই সত্য নাকি সত্যটাই অভিনীত?’ গভীর দার্শনিক প্রশ্নে উপনীত হয়ে লাবণীর হাত ধরে ধীরপায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে।
হাত ধরেই হাঁটতে হাঁটতে পরিবাগের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, ‘স্যারকে মিস করেন না?’
‘মিস করি না। তবে মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি।’
বিশ্বস্ত কণ্ঠে রাফি বলল, ‘স্যারের জন্য আপনার করুণ পরিস্থিতির সাক্ষ্য আমি আজও নিজেকে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি আমাকে সামনে রেখে স্যারের চোখে খুঁজতেন ঈর্ষা। অথচ তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে কী সাংঘাতিক পাগলামি আপনি করতেন! স্যার না থাকলে আপনি আমাকে কখনোই চুমু খেতে দিতেন না।’বিশ্বস্ত কণ্ঠে রাফি বলল, ‘আমার কিন্তু খারাপই লাগে। আগের দিনগুলোর কথা ভেবে। স্যারের জন্য আপনার করুণ পরিস্থিতির সাক্ষ্য আমি আজও নিজেকে দিয়ে যাচ্ছি।’
আপনি আমাকে সামনে রেখে স্যারের চোখে খুঁজতেন ঈর্ষা। অথচ তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে কী সাংঘাতিক পাগলামি আপনি করতেন! স্যার না থাকলে আপনি আমাকে কখনোই চুমু খেতে দিতেন না।’
‘আর স্যার থাকলে?’
‘সেকি! তাড়িয়ে তাড়িয়ে শুনতে চান এখনো! স্যার থাকলে—অযথা ঘেঁষাঘেঁষি। ঢলে ঢলে পড়া। চ্যাপ্টা হয়ে লেগে থাকা। মানে কী বলব! আপনি এত সিলি ছিলেন বুঝতাম না কেন। আপনি নিজে কি এখন বুঝতে পারেন যে একটা সাইকো ছিলেন আপনি?’
রাফিকে প্রায় জড়িয়ে ধরে থেকে লাবণী আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, ‘আমার তো শুনে ইন্টারেস্টিংই মনে হচ্ছে। এমনই ছিলাম নাকি আমি? আরও আমি কেমন ছিলাম। খুলে বলো তো আমাকে!’
‘এমনই ছিলেন তো। আর আমি নিশ্চিত এখনো তেমনই আছেন।’
‘আরেহ নাহ। এখন তেমন নাই। বিয়েশাদি করেছি না? বাচ্চাপিচ্চিও তো আছে এখন।’
রাফি বলে চলে—
‘ছিলেন ভীষণ প্রতিশোধপরায়ণ। আমার সামনে বসে হাত কাটতেন। আমি জানতাম সেটা আপনি করতেন স্যারের জন্য। অথচ স্যারের কাছে নিজের এই পরিণতির জন্য আমাকে দায়ী করে আপনিও কি সুখ পেতেন না?’
‘বলো কী। শুনে তো মনে হচ্ছে বিকৃত সুখই পেতাম!’
‘হা হা। মনে আছে একবার, আমাদের পাঠচক্রে আলোচক হিসেবে স্যার এলেন? স্টেশনে স্যারকে রিসিভ করতে গিয়ে দেখলেন স্যার সস্ত্রীক। আর পায় কে। আমার ওপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেবার।’
‘এভাবে বোলো না। তোমার প্রতিও আমার অবসেশন ছিল তো। মানে এখনো আছে...’
‘সরি, আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। বিশেষত এখন, যখন স্যারই নেই—আমার প্রতি আর কিছুই অবশিষ্ট থাকতে পারে না আপনার।’
‘কেন, এখনো কি ঢলাঢলি কম করছি?’ কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে লাবণী বলে।
‘এখন যা করছেন তা হয়তো আগেকার আমার অনুপস্থিতির প্রতিই কোনো এক জেদ থেকে। এ ছাড়া আপনার খবরও তো রাখিই, সপরিবার লন্ডনে আছেন। কোথায় আমি, কেনই আমি আর? অথবা স্যার!’
হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে নিয়ে লাবণী জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, স্যারের কবর কোথায় হয়েছে জানো?’
‘নাহ। স্যারের বাড়ি কোথায় যেন? আমি তো সেটাও জানি না।’
‘নারায়ণগঞ্জ। বাড়ি আমি চিনি।’ লাবণী জানাল।
‘আচ্ছা। তো এখন কী প্ল্যান?’ স্থূল ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করে রাফি।
‘চলো স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসি।’ প্রত্যাশিত জবাব পায় লাবণীর কাছ থেকে।
রাফিও রাজি, ‘আমার আপত্তি নেই। মানে ফ্রি আছি এখন।’
তার আগে লাবণী জানতে চায়, ‘তুমি কি সত্যিই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলে? সব বুঝতে পেরেও?’
‘আপনাকে আমি ঘৃণা করতাম। কিন্তু আপনার ডাক এড়ানো অসম্ভব ছিল তখনকার আমার পক্ষে।’
‘এখনো আমার ডাক এড়ানো সম্ভব হলো কই? তুমিই বরং আগের মতোই রয়ে গেছ রাফি।’ সুযোগ পেয়ে এবার রাফিকে আক্রমণ করে লাবণী।—‘বললাম মাত্র রাজি হয়ে গেলে স্যারের কবরে যেতে। কেন, তা তো জানিই।’
‘কেন?’ লাবণীকে, আর নিজেকেও যেন–বা প্রশ্ন করল রাফি।
‘কারণ, তুমি ভাবছ স্যারের ত্রিসীমানায় গেলেই এখনো আমি ওই সব পাগলামি করতে থাকব তোমার সঙ্গে। কি, ঠিক বলিনি?’
নিরুত্তর রাফিকে শর্তহীন দুটো চুমু খেয়ে লাবণী চলে গেছে ঘণ্টা দুয়েক আগে। পরিবাগের রাস্তায় রাত ক্রমেই বাড়তে থাকলে রাফির মনে হয়, নিজেও সে কম প্রতিশোধপরায়ণ কি? ক্যানসার আক্রান্ত স্যারের জন্য যখন নাগরিক শোকসন্তপ্ত পরিবেশ চারদিকে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, খবরের কাগজ—যে যার জায়গা থেকে জোগাড়যন্ত্র করছে প্রয়োজনীয় ফান্ডের। তখন, তখন, তখন...উফ, আর ভাবতে পারে না রাফি। পেশাগত সূত্রে কেন যে সেই কল রেকর্ড তার হাতেই এসে পড়ল!
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম ল য পর শ ধ র ব য স য র র জন য সন ধ য য় র স মন ম স কর আম র প কর ছ ন স য রক আপন র অবশ য কখন ই একব র করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
সবুজ পাতায় আলোর খেলা
২ / ৭পাতার কিনারে আটকে থাকা আলোর রেখা কুঁড়ি কোমলতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে