সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ‘থ্রি জিরো’ বা তিন শূন্য তত্ত্বকে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরেন। ওই বক্তব্যে ড. ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেন, শূন্য তত্ত্ব এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। এতে গড়ে উঠবে সবার জন্য বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী। তিন শূন্য অর্জনে তিনি চারটি মহাশক্তির কথা বলেছেন– তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। তাঁর মতে, প্রত্যেক তরুণ হবে ‘থ্রি জিরো পারসন সিটিজেন’। অর্থাৎ তারা কার্বন নিঃসরণ করবে না; সম্পদ মজুতের পরিবর্তে সামাজিক ব্যবসা করবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণে উদ্যোগী হবে। 
বস্তুত বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও তিন শূন্য তত্ত্বের ধারণা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। এখানে বিশ্বায়ন হচ্ছে একটি সীমানাহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার মূল লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা জোরদার করা। কিন্তু বর্তমানে যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলছে, তা প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। উন্নত রাষ্ট্রগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জেনেও বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হিসেবে দুর্বল বা অনুন্নত দেশগুলোকে প্রলুব্ধ করছে। জাতিসংঘ ২০১৫ সালে একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে পেশ করে। এসডিজি নামে পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য টেকসই বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা। এসডিজির মধ্যে আছে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা। এ পরিকল্পনা হচ্ছে বিশ্বের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকার। লক্ষণীয়, ২০১৫ সালেই তিন শূন্য তত্ত্ব প্রথম উপস্থাপিত হয় রাজধানী ঢাকার চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড.

মুহাম্মদ ইউনূস ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস-২০১৫’ উদযাপনকালে এ তত্ত্ব দেন। অর্থাৎ শূন্য তত্ত্ব ও এসডিজি বিশ্ববাসীর কাছে কাছাকাছি সময়ে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘শূন্য তত্ত্ব’ হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রদত্ত ব্যক্তিগত মতবাদ। বিশ্ব সুরক্ষায় প্রদত্ত এ দার্শনিক মতবাদ এসডিজির সামগ্রিক লক্ষ্যের সমন্বিত রূপ। ড. ইউনূসের শূন্য তত্ত্বের ধারণা থেকেই বিশ্ববাসী এসডিজি বাস্তবায়নের অনুপ্রেরণা পাবে বলে আমি মনে করি।

১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক অবস্থায় মন্দা ভাব পরিলক্ষিত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতির সার্বিক উত্তরণের লক্ষ্যে লেবার পার্টির পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রী আর্থার গ্রিনউড ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তমতে, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম হেনরি বিভারিজের নেতৃত্বে ‘ইন্টারডিপার্টমেন্টাল কমিটি অন সোশ্যাল ইন্স্যুরেন্স অ্যান্ড অ্যালায়েড সার্ভিসেস’ শীর্ষক কমিটি গঠন করা হয়। বিভারিজ কমিশনের রিপোর্ট আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে আর্থনৈতিক সংস্কার সাধন ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আজও একটি আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। বিভারেজ কমিশনের রিপোর্ট সমাজের অগ্রগতির পথে পাঁচটি অন্তরায় চিহ্নিত করেছিল। চিহ্নিত অন্তরায়গুলো হলো– অভাব, রোগব্যাধি, অজ্ঞতা, মলিনতা ও অলসতা, যা পঞ্চদৈত্য হিসেবে বিবেচিত। গত শতাব্দীর সমস্যা ও বর্তমান শতকের সংকটের ধরনে বহুলাংশে মিল রয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় বর্তমান শতকের বিরাজমান সব সমস্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। তাই তিন শূন্য তত্ত্বের লক্ষ্য অর্জনে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ রচনা করা সম্ভব হয়। 

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার মহান অঙ্গীকার। একদিন তরুণ প্রজন্ম শপথ নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। স্বাধীন করেছিল বাংলাদেশ। উৎসর্গ করেছিল মূল্যবান জীবন। কিন্তু শহীদের বিসর্জন ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার পরিচালনাকারীরা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। তারা স্বাধীনতার সুবিধাভোগী কিংবা হননকারী হিসেবে অতিমুনাফা, লুণ্ঠন, দুর্বৃত্তায়ন ও মুদ্রা পাচারে লিপ্ত। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের প্রাথমিক ফলমতে, বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ হিসাবে অতিদ্রুত বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ প্রতিবেদন-২০১৮’ মতে, এ দেশে অতি ধনীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি তরুণ সমাজ বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে দেশে একটি গণবিপ্লবের সূচনা করেছে। আশা করা যায়, এ বিপ্লবের ফলে শূন্য তত্ত্বের বাস্তবায়ন গতিশীল হবে। দেশের দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থান সংকট দূর হবে। রাষ্ট্র সংস্কার ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা হোক সবার অঙ্গীকার।

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, আগারগাঁও, ঢাকা 

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের কত পারমাণবিক স্থাপনা রয়েছে, কোথায় সেগুলোর অবস্থান

ইরানের রাজধানী তেহরানের বিভিন্ন শহরে আজ শুক্রবার ভোররাতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ হামলার আগে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন সময় ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি দ্রুত সম্প্রসারণ করছে—ক্রমবর্ধমান এই আশঙ্কার কারণেই মূলত এসব বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

২০১৫ সালে ছয় প্রভাবশালী দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে ইরানকে পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখার শর্ত দেওয়া হয়। বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর থেকে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করেছে।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ‍(আইএইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইরানে মোট সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ছিল প্রায় ৯ হাজার ২৪৭ দশমিক ৬ কেজি বা ২০১৫ সালের চুক্তিতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি।

মোট মজুতকৃত ইউরেনিয়ামের মধ্যে ৪০৮ দশমিক ৬ কেজি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে ইরান, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে প্রযোজ্য সমৃদ্ধকরণের চেয়ে সামান্য কম। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে হয়।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্রে একটি হামলা হয়। এ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান।

ভিয়েনাভিত্তিক সংস্থা আইএইএ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, তাত্ত্বিকভাবে ইরানের কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম রয়েছে, আরও কিছু পরিশোধন করলে তা দিয়ে দেশটি প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে।

তবে ইরান বরাবরই এ কথা অস্বীকার করে আসছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো অভিপ্রায় নেই বলে জানিয়েছে দেশটি।

নিচে ইরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার তালিকা দেওয়া হলো, যেগুলো জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক দল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে:

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র

০১. নাতাঞ্জ

তেহরান থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইরানের মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এটি গভীরভাবে সুরক্ষিত (বাংকারযুক্ত) একটি স্থাপনা। কেন্দ্রটির অস্তিত্ব প্রথম সামনে আসে ২০০২ সালে।

নাতাঞ্জের দুটি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭০টি সেন্ট্রিফিউজের সারি আছে। এর মধ্যে একটি কেন্দ্রের কার্যক্রম ভূগর্ভে পরিচালিত হয়। সেন্ট্রিফিউজ হলো এমন যন্ত্র, যা ব্যবহার করে ধাপে ধাপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়।

২০২১ সালের এপ্রিলে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্রে একটি হামলা হয়। এ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান।

আজ শুক্রবার ভোররাতে এই কেন্দ্রে হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কেন্দ্রটির পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত পরমাণুবিজ্ঞানীদেরও নিশানা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

আইএইএ–এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি নিশ্চিত করেছেন, যেসব স্থান লক্ষ্য করে হামলা করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি নাতাঞ্জ।

মধ্য ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে গোপনে নির্মিত পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্র ফোর্ডো ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তৈরি করা হয়।

ফোর্ডো

মধ্য ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে গোপনে নির্মিত পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্র ফোর্ডো ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তৈরি করা হয়।

প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘জরুরি’ স্থাপনা হিসেবে বর্ণনা করা হলেও পরে ইরান জানায়, এটি একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য মাটির নিচে এটি নির্মাণ করা হয়। এই কেন্দ্রে প্রায় তিন হাজার সেন্ট্রিফিউজ বসানো সম্ভব।

২০২৩ সালে এই কেন্দ্রে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কণা পাওয়া যায়। ইরানের দাবি, পরিশোধন প্রক্রিয়ায় অনিচ্ছাকৃত তারতম্যের কারণে এমনটি হয়েছে।

আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তু কী, কারা জড়িত, নিহত কারা ৮ ঘণ্টা আগেইরানের বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আমানতকারীরা টাকা ফেরত চান
  • ইরানের কত পারমাণবিক স্থাপনা রয়েছে, কোথায় সেগুলোর অবস্থান