সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারের প্রস্তাব
Published: 31st, January 2025 GMT
বাল্যবিয়ে ও নির্যাতন উপসর্গমাত্র। এগুলো প্রতিকারে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন উদ্যোগ নেয়, কিন্তু রাশ টেনে ধরা যায় না। সংকটের মূল কারণ সম্পদে নারীর সমান অধিকার না থাকা। তাই উত্তরাধিকার আইনে নারীর সমান অধিকারের সুপারিশ করবে নারী-বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
সম্পদে সমান অধিকার না থাকাকে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে প্রধান বাধা বলে কমিশনের মতামতে উঠে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড.
এ বিষয়ে কমিশনপ্রধান শিরীন পারভিন হক সমকালকে বলেন, ‘কমিশনের লক্ষ্য হলো নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা। সুতরাং নারীর প্রতি বৈষম্য যেখানে আছে, সেটা-ই নিরসন চাই। সেই সঙ্গে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ নেওয়ারও সুপারিশ করা হবে। দেশে নারীর প্রতি যত বৈষম্যমূলক আইন রয়েছে, সেগুলো সংস্কারের সুপারিশ করব।’
এ জন্য দেশে প্রচলিত কোন কোন আইনে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ধারা রয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সংবিধান ও আইন, নীতি নির্ধারণ এবং কর্ম পরিকল্পনা– এই তিন ভাগে ভাগ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আইন যখন বাধা
১৯৭১ সালের এপ্রিলে গঠিত মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণার মূলনীতি ছিল সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও এই নীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। সংবিধানের ২৮ (১) ধারা অনুযায়ী, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ অথচ ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের তৈরি পারিবারিক আইন এখনও বহাল। এতে রাষ্ট্রের ৫০ ভাগ নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অথচ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল হয়ে যাবে বলে সংবিধানের ২৬ (১) ও (২) ধারায় অঙ্গীকার রয়েছে।
এদিকে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিয়ে ও বিচ্ছেদে সমানাধিকার বিষয়ে সিডও সনদের ২ ও ১৬ (১) (গ) দুটি ধারায় সংরক্ষণ বহাল রেখেছে বাংলাদেশ। এটা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০, ১৯, ২৬, ২৭ ও ২৮-এর মূল নির্যাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবিধানের ২৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘বৈষম্যহীনতা’র সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তরাধিকার আইন বহাল থাকার যৌক্তিক ও আইনগত ভিত্তি নেই।
ছয় জেলায় সভা
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক তারিখ হলেও কমিশনের কার্যক্রম দেরিতে শুরু করায় মার্চে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। বৈষম্য দূর করে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, সিলেট ও রংপুরে বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে সভা করেছে কমিশন। ওই সব সভায় অধিকারকর্মী, নারী ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, আইনজ্ঞসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাদের মতামতের ভিত্তিতে কয়েকটি সুপারিশ পেয়েছে কমিশন। ময়মনসিংহে সভা হলে প্রাপ্ত সুপারিশ নিয়ে মূল প্রতিবেদন সাজানো হবে বলে জানান নারী-বিষয়ক সংস্কার কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সদস্য।
১৮-এর আগে বিয়ে নয়
মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮। তবে আইনে বলা আছে, মা-বাবা চাইলে ১৬ বছরেও বিয়ে হতে পারে। চিকিৎসক ও অধিকারকর্মীরা এ আইনের সঙ্গে একমত নন। শিশু আইন, শিশুনীতিসহ বিভিন্ন আইন ও নীতি এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুসমর্থন করে সরকার ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাই বাল্যবিয়ে নিরোধের লক্ষ্যে এ ধারা বাতিলের সুপারিশ করা হবে।
স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে সুপারিশ
স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য– সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে গর্ভনিরোধক, এমআরএম কিট এবং নিরাপদ প্রসব পরিষেবা দেওয়ার জন্য ৫ম সেক্টরাল প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে। কারণ, ২০২৩ সাল থেকে লজিস্টিক সহায়তা (পণ্য সরবরাহ, মানবসম্পদ ও বাজেট) কমে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নারীরা তাদের মৌলিক প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইসিপিডির (জনসংখ্যা ও উন্নয়ন-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন) প্রতিশ্রুতি হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এর মাধ্যমে এফপি (পরিবার পরিকল্পনা) ২০৩০ এবং এসডিজি (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) ২০৩০ গুরুত্ব পাবে। মাতৃমৃত্যু হ্রাস করার জন্য এমআর/এমআরএম পরিষেবা উন্নত করতে হবে।
নিম্ন-কর্মক্ষম অঞ্চলের জন্য ভৌগোলিকভাবে লক্ষ্যযুক্ত পরিষেবা প্যাকেজ (বিসিসি প্রচারণা এবং গর্ভনিরোধক সরবরাহসহ) বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা সেবার জন্য দক্ষ মানব সম্পদের ঘাটতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নার্সসহ টাস্ক-শেয়ারিং উদ্যোগ সম্প্রসারণ করতে হবে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারত্ব জোরদার করতে হবে। যুবকেন্দ্রিক পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবার অ্যাপস এবং মান বাড়িয়ে কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্লায়েন্ট ফলো-আপ, চাহিদা তৈরি, রিপোর্টিং ইত্যাদিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় দক্ষ মানব সম্পদের ঘাটতি পূরণ, স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্তি, শিশু মৃত্যুর হার কমাতে পদক্ষেপ ও পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বৈষম্যমূলক সব আইন পরিবর্তনের সুপারিশ
বছরের পর বছর ধরে নারীর অধিকার সুরক্ষার জন্য আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করে আসছে কয়েকটি সংগঠন। অভিন্ন পারিবারিক আইন চালুর দাবিতে আন্দোলন করছে। বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকারে সব ধর্মের নারী-পুরুষের জন্য অভিন্ন আইন থাকার প্রস্তাব করেছে।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ মনজুন নাহার বলেন, প্রচলিত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পারিবারিক আইন সিডও সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এসব আইন। অবিলম্বে অভিন্ন ও সার্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করতে হবে।
মৃত্যুর পরও নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সদস্য জানান, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নয়, মৃত্যুর পরও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যা যা করার দরকার, সবকিছু প্রতিবেদনে আসবে। আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি সেগুলো কার্যকরে বাধার বিষয়ও তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসবে। কমিশনে তরুণদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে একজন ও শ্রমজীবী নারীদের অধিকার রক্ষায় যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে দু’জন প্রতিনিধি আছেন। ইতোমধ্যে কমিশন ১৩টি সভার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। সব পর্যায়ে তরুণদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নসহ বাস্তবায়ন করার সুপারিশ থাকবে।
শ্রমজীবী নারীদের বিষয়ে সুপারিশ আসছে জানিয়ে শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের বিষয়টি কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় অংশগ্রহণ কম।’ এ নিয়ে ইতোমধ্যে শ্রম কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ সভা করা হয়েছে।
কমিটিতে কে কে
গত ১৭ অক্টোবর নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে ১০ সদস্যের নারী-বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর এক মাস পর গত ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন– ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীপক্ষের পরিচালক কামরুন নাহার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প র ব র ক আইন র স প র শ কর র জন য পর ষ ব আইন প সদস য সরক র ব ষয়ক
এছাড়াও পড়ুন:
নারায়ণগঞ্জে কারখানায় বিস্ফোরণ, দগ্ধ ৩
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় মঞ্জু টেক্সটাইলে এন্ড ডাইং কারখানায় গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে কারখানার দুই নিরাপত্তাকর্মীসহ তিন জন দগ্ধ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১ মে) সকাল পৌনে ৯টার দিকে উপজেলার তারাবো পৌরসভার কাজীপাড়া এলাকায় কারখানায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। দগ্ধরা হলেন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আব্দুল হান্নান, গার্ড কবির হোসেন ও সিনিয়র অফিসার সাইফুল ইসলাম।
কারখানার সুপারভাইজার মিজানুর জানান, নাইট ডিউটি শেষে সকাল ৮টার দিকে শ্রমিকরা চলে যাওয়ার ঠিক পরপরই তিতাস গ্যাস সংযোগের আরএমএস রুমে গ্যাসের অতিরিক্ত চাপে বিকট শব্দে একটি দেয়াল ধসে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়। এ সময় নিরাপত্তাকর্মীসহ তিনজন দগ্ধ হন। বিস্ফোরণ ও আগুনের তীব্রতায় আশপাশের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৫ জন দগ্ধ, সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক
মাইক্রোবাসে বিস্ফোরণ, অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন ৫ ছাত্রনেতা
তিনি জানান, কারখানায় দায়িত্বে থাকা টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীরা দ্রুত গ্যাসের চাবি বন্ধ করে নিজেরাই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে দগ্ধ তিনজনকে দ্রুত রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। আগুনে কারখানার কিছু কাপড় ও আসবাবপত্র পুড়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, আগুন লাগার খবর পেয়ে ইউনিট সেখানে যায়। তবে তার আগেই কারখানার লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলে। বিস্ফোরণ ও আগুনের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী বলেন, ‘‘খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। শুনেছি তিনজন দগ্ধ হয়েছেন এবং তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
ঢাকা/অনিক/বকুল