কথাশিল্পী কাজী লাবণ্যের বর্ণনায় মাটির কাছে থাকা মানুষের নিবিড় পরিচয় ফুটে ওঠে। তিনি অবহেলিত, প্রতারিত এবং নিগৃহীত মানুষের কথা লিখে চলেন প্রকৃতির চিত্রময় বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে। তার প্রকাশিত গল্প গ্রন্থের সংখ্যা ৬ টি, উপন্যাসের সংখ্যা ২টি। ২০২৫ বইমেলায় কাজী লাবণ্যের একটি গল্পগ্রন্থ এবং একটি উপন্যাস প্রকাশ হচ্ছে। প্রকাশিতব্য বই নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি।

রাইজিংবিডি: হাজারমুখী রোদসীর প্রেক্ষাপট জানতে চাই। 
কাজী লাবণ্য:
এই নামে আমার একটি গল্প আছে ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘আয়োলিতার পুরুষ’ গ্রন্থে। বাস্তবে দেখা এক নারীর আবছায়া নিয়ে লেখা ঐ গল্পের গর্ভে উপন্যাসের বীজ লুকায়িত ছিল। পরবর্তীতে এটি উপন্যাস আকারে আনার সিদ্ধান্ত নিই এবং তাতে উৎসাহ দেয় সুহৃদ বন্ধু কথাসাহিত্যিক সাদিয়া সুলতানা। গতবছরের একটা সময়ে দেশ থেকে দূর পরবাসের এক আনন্দধামে ছিলাম। লেখালেখি বান্ধব সেই পরিবেশে বসে দেখতে পেয়েছি হাজার হাজার মাইল দূরত্বে থাকা ‘ময়না’ নামক অভাবী, অশিক্ষিত, এক তেজি নারীর লড়াই, সংগ্রাম। ঐ সময়েই রচনা করেছি এই ময়না তথা হাজারমুখীর নিত্যদিনের আখ্যান। আসলে তো, হাজারমুখীরা আমাদের চারপাশেই থাকে; থাকে গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রংপুর, ঢাকা উদ্যান, কিংবা কামরাঙ্গির চরে। এদের দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের চিত্রই এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। 

রাইজিংবিডি:  মাদ্রাসায় শিশু ছাত্রদের যৌন নির্যাতন বিষয় আপনি উপন্যাসে তুলে ধরেছেন, সেক্ষেত্রে বাস্তবতাকে কতটুকু আশ্রয় করেছেন? 
কাজী লাবণ্য:
ঢালাওভাবে একথা বলা যাবে না যে, মাদ্রাসাগুলোতে শিশু ছাত্রদের উপর যৌন নির্যাতন চলে। সব মাদ্রাসাতেই এমন ঘটে সেটাও সত্য নয়। বিভিন্ন স্থানে, বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে। আমার লেখার পেছনে আছে আমার শোনা কয়েকবছর আগের তেমনই একটি ঘটনা। বেড়াতে গিয়েছিলাম পূর্বপুরুষের ভিটায়। সকালবেলায় হাঁটতে গিয়েছি। ছোট কালভার্টের উপর নির্মিত সেতুতে নীল জোব্বা, মাথায় টুপি পরা একটি শিশু বালক বসেছিল।চারপাশের অনাবিল পরিবেশ, অপুর্ব সবুজ বনরাজি, মেঘমুক্ত আকাশ, পাখির কুজন, জলাশয়, আর শস্যক্ষেতের মাঝে বাচ্চাটিকে দেখে কৌতূহলী হয়ে বসেছিলাম ওর পাশে। অনেক কসরতের পর, মাছের মতো পর্দাহীন চোখে তাকিয়ে ওর ক্রোধান্বিত কিছু বক্তব্য আমাকে একেবারে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এটাই এই আখ্যানের বীজ। এরপরে আরও অনেকের মুখে শুনেছিলাম কিছু কদর্য কাহিনী। আর টিভি, পত্রিকা, ফেসবুকের রিপোর্ট তো আছেই। 

রাইজিংবিডি: আপনারতো একটি গল্পের বইও প্রকাশ হচ্ছে ‘আরুশি ও একটি মিছরিদানা আংটি’— এই নামকরণের কারণ কী? কী ধরণের গল্প থাকছে বইতে? 
কাজী লাবণ্য:
এই বইটি ১৬টি ভিন্ন মেজাজের গল্প নিয়ে মলাটবন্দি করেছে গ্রন্থিক প্রকাশন। গল্পগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং ভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে। অধিকাংশ গল্পই এসেছে নিজের দেখা প্রখর বাস্তবতা থেকে। কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছি সেখানে দেখা পেয়েছি ‘নুরবানু’ নামে এক ফুলওয়ালি বালিকার, বাজার করি কৃষিমার্কেটে সেখানে দেখা পাই প্রকৃতির খেয়ালি সৃষ্টি ‘অজুফা’র, এরাই চলে আসে আখ্যানে, এদের নিয়ে তৈরি হয় গল্পের কাঠামো।
‘আরুশি ও মিছরিদানা আংটি’ গল্পটি নাম গল্প। এখানে এক নিঃসঙ্গ নারীর একাকীত্বের চিত্র এসেছে একেবারে আলাদা ফরমেটে। প্রেমিক পুরুষের দেওয়া নাম ‘আরুশি’। এর অর্থ সূর্যের আলো বা প্রভাতি। এটি লিখতে গিয়ে কেমন এক ঘোর তৈরি হয়েছিল। 

রাইজিংবিডি: সারাদিনে লেখা ও পড়ার সময়টা কীভাবে বের করেন? 
কাজী লাবণ্য:
আদতে আমি একজন ‘পড়ুয়া মানুষ’। পূর্বেও একথা একাধিকবার বলেছি। লেখালেখিতে না এলে আজীবন পড়ুয়াই থাকতাম। প্রচুর পড়া হয়, এই পড়ার জন্য আলাদা সময় বের করতে হয় না। এটা জীবনের প্রতিটি ধাপের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। যেভাবেই হোক ঢুকে পড়েছি এক ছুটন্ত টানেলের ভেতর। নিশ্চিন্ত ঘুমের কাছে সমর্পিত হয়েও মাঝেমধ্যে আবার ভূমিকম্পের মতো আঁতকে উঠি। লিখতে বসি। লম্বা সময় না লিখতে পারলে খুব অস্থির লাগে। যা লিখি যেমন লিখি লেখার টেবিলে বসতে হয়। তাতে শান্তি পাই, স্বস্তি আসে। শব্দেরা আমার ইরেজার, আখ্যান আমার প্রেমময় সঙ্গী। 

রাইজিংবিডি: বইয়ের প্রচারণায় লেখকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
কাজী লাবণ্য:
জোরালো হওয়া উচিত মানে, আমাদের প্রেক্ষাপটে। আমার বই আমি প্রচার না করলে কে করবে? ব্যাপারটা এমনটাই দাঁড়িয়ে গেছে। না, আজকাল আর খারাপ লাগে না। আমিও কম, বেশি প্রচারে নেমে পড়েছি।তবে প্রচারের নানা উপায় থাকলেও কেবলমাত্র ওই ফেসবুকে দেওয়া ছাড়া আর তেমন কিছু করা হয় না। তবে প্রকাশকের উচিৎ নানাভাবে প্রচার করা। 

ঢাকা/লিপি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপন য স

এছাড়াও পড়ুন:

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।

আরো পড়ুন:

খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’

‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।

মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।

বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন। 

জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’

‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ