চীনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ট্রাম্প–ইশিবার
Published: 8th, February 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা তাঁদের প্রথম বৈঠকে উষ্ণ সুরে কথা বলেছেন। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসে এ দুই নেতা বৈঠক করেন। ট্রাম্প যেসব দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন বৈঠকের পর তা এড়াতে সক্ষম হয়েছে জাপান।
হোয়াইট হাউসে বৈঠকে পরস্পরের প্রশংসা করার পাশাপাশি দুই নেতা চীনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পারমাণবিক অস্ত্রধারী উত্তর কোরিয়া নিয়ে উদ্বেগের কারণে উভয় দেশই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জাপানের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্যঘাটতি শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য ইশিবাকে চাপ দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প সতর্ক করে বলেন, বাণিজ্যঘাটতি পূরণ না হলে টোকিওকেও অন্যদের মতো শুল্ক আরোপের মুখে পড়তে হবে। জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মতো ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চাপে রয়েছেন ইশিবা।
বৈঠকের পর দুই নেতা জোর দিয়ে বলেছেন, তাঁরা উভয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী।
উল্লেখ্য, গত ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয় কোনো বিদেশি নেতা হিসেবে সফর করছেন ইশিবা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সপ্তাহে ট্রাম্পের প্রথম অতিথি ছিলেন।
ইশিবা তাঁর এক দিনের সফরে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন যান। গত শুক্রবার দুপুরে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন।
পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইশিবা বলেন, ‘টেলিভিশনে ট্রাম্পকে দেখে অত্যন্ত ভীতিকর ও কঠিন ব্যক্তিদের মানুষ মনে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর দেখেছি, তিনি খুবই আন্তরিক ও শক্তিশালী একজন ব্যক্তি।’
ট্রাম্পের পক্ষ থেকেও ইশিবার প্রশংসা করা হয়। তাঁকে সুদর্শন বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্র যদি জাপানের ওপর শুল্ক আরোপ করে তবে এর পাল্টা ব্যবস্থা ইশিবা নেবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাত্ত্বিক প্রশ্নের’ উত্তর দেন না তিনি। ট্রাম্প এ কথায় হেসে বলেন, খুব ভালো উত্তর।
ট্রাম্প এ সময় বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত কারখানা ইউএস স্টিলে বিনিয়োগ করবে জাপানের নিপ্পন স্টিল। তবে প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করবে না। ট্রাম্প বলেন, তাঁরা ক্রেতার পরিবর্তে বিনিয়োগকারী খুঁজছেন। এর আগে বাইডেন প্রশাসন এ চুক্তিতে বাধা দিয়েছিল।
দুই নেতা নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের কয়েক দশক ধরে চলা সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার প্রতিশ্রুতির কথা বলেন।
ট্রাম্প বলেছেন, তাঁরা চীনা অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সম্মত হয়েছেন। এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে উসকানিমূলক কার্যকলাপের জন্য বেইজিংয়ের নিন্দা করেছেন।
উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণেরও আহ্বান জানিয়েছে তাঁরা। তবে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান। ইশিবা বলেন, তাঁর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী এবং সেখানে তাঁদের ব্যয় বাড়াবে। জাপানের পক্ষ থেকে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার বিষয়টিও রয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে
অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।
শ্রমবাজারে দুর্বলতাপাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থানমূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।
ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনএ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।
পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’
বাজারের প্রতিক্রিয়াসুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নীতিসুদ কীকেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।
কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাববিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।
নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।
সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।