ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ট্রাম্প করেননি!
Published: 19th, February 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন। বাস্তবে তা হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাত্র তিন সপ্তাহ পার হতেই এই যুদ্ধ থামানোর প্রক্রিয়া যেন দুরন্ত গতিতে এগোতে শুরু করেছে।
১২ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এরপর ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করেন যে তাঁরা ‘যুদ্ধের কারণে প্রাণহানি রোধের’ বিষয়ে একমত হয়েছেন। এই আলোচনার পরপরই সৌদি আরবে তাদের মধ্যে একটি সম্ভাব্য শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা আসে।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরে এক বক্তৃতায় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের কিছু মূল দিক তুলে ধরেন। আগের মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান থেকে একেবারে ভিন্ন পথে গিয়ে তিনি বলেন, ইউক্রেনের পক্ষে তার সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখতে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টিও বাদ দিতে হবে।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন কার্যত ২০০৮ সালের মার্কিন-ইউক্রেন কৌশলগত অংশীদারত্ব সনদকে অকার্যকর ঘোষণা করেছে। ওই সনদে ইউক্রেনের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি মার্কিন প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তিকে নীতিগত অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
ট্রাম্প ও হেগসেথের এই ঘোষণার পর কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম সঙ্গে সঙ্গে একে ‘ইউক্রেনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে আখ্যা দেয়। বাস্তবে ওয়াশিংটন সত্যিই কিয়েভকে পরিত্যাগ করছে। কিন্তু এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং ইউক্রেনের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের ধরন বিবেচনায় এমন পরিণতি অনেক আগেই অনুমেয় ছিল।
এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করা যায় না। ইউক্রেনের সঙ্গে আসলে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। তারা ইউক্রেনকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই ভরসায় ইউক্রেন আপসের পথ প্রত্যাখ্যান করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অথচ এই যুদ্ধ জেতা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ট্রাম্পকেও ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের প্রতি আগ্রহী করার চেষ্টা করেন জেলেনস্কি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল কার্যত একধরনের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ। তা ইউক্রেনের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার শামিল। জেলেনস্কিকে দেখাতে হবে যে তিনি সব পথ চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে অবাস্তব পথগুলোও। শেষ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমাদের বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করে অনিবার্য পরিণতির কাছে নতিস্বীকার করতে পারেন।গত তিন বছরে পশ্চিমা বিশ্ব অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যত দূর সম্ভব ব্যবস্থা নিয়েছে। এর বেশি এগোলে বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হতো। ক্ষতিগ্রস্ত হতো বৈশ্বিক অর্থনীতি। ব্যয়বহুল এই সমর্থন অব্যাহত রাখলেও পরিস্থিতি বদলাত না। রাশিয়া ইউক্রেনের চেয়ে শক্তিশালী ও ধনী। তার সেনাবাহিনী আধুনিক যুদ্ধে পারদর্শী। শুধু উন্নত পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে তাদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। এর চেয়ে বড় বিষয়, রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। এ কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায়নি।
মার্কিন প্রশাসনে যে–ই থাকুক, একসময় তাকে ইউক্রেনের প্রতি সহায়তা কমিয়ে দিতেই হতো। অনির্দিষ্টকাল তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ঘটনাচক্রে, রিপাবলিকান প্রশাসনই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের তা করতে হয়নি। তাই তারা এখন একে রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
এদিকে ইউক্রেনের কিছু ইউরোপীয় মিত্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের পথেই হাঁটবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ন্যাটোর নতুন মহাসচিব মার্ক রুটে বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের নিশ্চয়তা কখনোই দেওয়া হয়নি। এই বক্তব্য তাঁর আগের কিছু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্ক রুটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ইউক্রেন ‘ন্যাটোর সদস্যপদ পাবেই’। কিন্তু এখন ন্যাটো সদস্যপদ ইউক্রেনের জন্য পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন পুরোপুরি ইউক্রেনকে উপেক্ষা করছে না। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য ইউরোপীয় ও অন্যান্য অঞ্চলের শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। তবে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে কোনো মার্কিন সেনা পাঠানো হবে না আর ন্যাটোভুক্ত দেশের সেনারা ন্যাটোর ৫ নম্বকর অনুচ্ছেদের আওতায় থাকবে না। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, কোনো সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে পুরো ন্যাটো সম্মিলিতভাবে সক্রিয় হয়।
এই প্রস্তাব ইউক্রেনের জনগণের জন্য খুব আশাব্যঞ্জক বলা যাবে না। জেলেনস্কি বারবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া পশ্চিমা নিরাপত্তা নিশ্চয়তার তেমন কোনো মূল্য নেই। অন্যদিকে ক্রেমলিন সম্ভবত ইউক্রেনে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সেনা মোতায়েনকে ‘ট্রোজান হর্স’ হিসেবে বিবেচনা করবে। তাই বাস্তব আলোচনা খুব একটা এগোবে না।
অন্যদিকে ন্যাটো-বহির্ভূত ইউরোপীয় সেনাদের নিয়োগ নিয়ে মস্কোর আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মতো ন্যাটোর বাইরের দেশগুলো খুব বেশি সেনা দিতে পারবে না। ফলে প্রধান বাহিনী আসতে হবে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছ থেকে।
তবে শান্তিরক্ষী মোতায়েনের এই আলোচনাকে অতিরঞ্জিত করে দেখা হচ্ছে। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হলো ইউক্রেনের সত্যিকারের নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করা এবং রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা।
এর মানে কি রাশিয়ার জয়? হ্যাঁ, তাই-ই। তবে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সামনে ছুড়ে দিয়েছে কে? যুদ্ধে উৎসাহী পশ্চিমা আগ্রাসী নীতির অনুসারীরা।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মনে করেছিলেন যে যুদ্ধের চাপে রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়বে। ভেঙে পড়বে তার শাসনব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিশাল সামরিক ব্যয়ের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি বরং চাঙা হয়েছে। রুশ জনগণ এই যুদ্ধের বড় কোনো প্রভাব অনুভব করেনি। অন্যদিকে জীবন দুর্বিষহ হয়েছে ইউক্রেনের জনগণের।
পুতিনকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাঁর পতন সম্ভব কেবল রাশিয়ার জনগণ রুখে দাঁড়ালে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউক্রেন এতটাই কট্টর যে এমনকি পুতিনবিরোধী অনেক রুশ নাগরিকও তাদের থেকে দূরে সরে গেছে। পশ্চিমাদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, তারা শান্তি নয়, যুদ্ধই চেয়েছে।
ইউক্রেনের সামনে কোনো ভালো বিকল্প নেই। এই হতাশা প্রকাশ পেয়েছে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জেলেনস্কির বক্তব্যে। তাঁর বক্তব্য ছিল চ্যালেঞ্জ ছোড়ার মতো, কিন্তু ভেতরে ছিল অসহায়ত্বের ছাপ। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রস্তাব দেন যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীই নতুন ইউরোপীয় সামরিক শক্তির কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটি বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, তাহলে ইইউ সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে।
ট্রাম্পকেও ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের প্রতি আগ্রহী করার চেষ্টা করেন জেলেনস্কি। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল কার্যত একধরনের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ। তা ইউক্রেনের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার শামিল। জেলেনস্কিকে দেখাতে হবে যে তিনি সব পথে চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে অবাস্তব পথগুলোও। শেষ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমাদের বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করে অনিবার্য পরিণতির কাছে নতিস্বীকার করতে পারেন।
লিওনিড রাগোজিন রিগায় বাসকারী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
আল–জাজিরার ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র স ইউক র ন র প সদস যপদ ইউর প য় র জন য ন র জন
এছাড়াও পড়ুন:
ভুল শুধরে জনগণের আস্থা ফেরানোর সুযোগ এই নির্বাচন: আইজিপি
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে পুলিশের জন্য ভুল শুধরে জনমনে আস্থা ফেরানোর সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখছেন বাহিনীটির মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের সময় মাঠে থাকা প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে হবে।
রোববার বিকেলে রাজশাহী মহানগর পুলিশ লাইনসের পিওএম সভাকক্ষে পুলিশ সদস্যদের জন্য আয়োজিত এক প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিদর্শনে গিয়ে আইজিপি এ কথা বলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে।
রাতে রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. গাজিউর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) ট্রেনিং স্কুলের তত্ত্বাবধানে তিন দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। আজ আইজিপি কর্মশালার ষষ্ঠ ব্যাচের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনকালে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, জাতীয় নির্বাচন একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যেখানে পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে দায়িত্বশীলতা, সততা ও পেশাদারত্বের সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এ সময় অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন আইজিপি। এ সময় তিনি নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে পুলিশের করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করেন এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে আইন অনুযায়ী কঠোর থাকার নির্দেশ দেন।
অনুষ্ঠানে আইজিপির সঙ্গে রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান, রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহানসহ রাজশাহী রেঞ্জ, রাজশাহী মহানগর পুলিশ এবং রাজশাহী জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।