প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ‘বর্ণমেলা’-এর আয়োজন করা হয়। বাঙালি যে ইতিহাস ধরে এসেছে, যেখানে সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছে, সেটা বর্ণমেলায় রয়েছে। অভিভাবকদের জন্য জরুরি কর্তব্য হচ্ছে সন্তানেরা যেন নিজের ভাষা ঠিক করে বলতে পারে।

আজ শুক্রবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ঢাকার ধানমন্ডিতে সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে ‘বর্ণমেলা’র উদ্বোধনী বক্তব্যে বক্তারা এসব কথা বলেন। ভাষাশহীদদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে সকাল ৯টা থেকে বর্ণমেলা শুরু হয়েছে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই বর্ণমেলা চলবে।

প্রথম আলোর আয়োজনে এই বর্ণমেলায় সহযোগিতা করছে স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্র্যান্ড মেরিল বেবি।

সহযোগিতা করছে সেপনিল, সুপারমম ও প্রচার সহযোগী এটিএন বাংলা।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অভিনেতা ও চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ যে মা-বাবারা সন্তানদের নিয়ে এখানে আসেন। মানে তাঁদের মধ্যে আগ্রহটা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন জরুরি কর্তব্য হচ্ছে বাচ্চারা ভাষাটা ঠিক করে বলুক। উচ্চারণগুলো শুদ্ধ করে বলুক। সেটা সবার জন্য গর্বের হয়ে উঠতে পারে।’

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, বর্ণমেলার এটি ১৬তম আসর। যার যাত্রা হয়েছিল ২০১০ সালে। প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটা আয়োজন হবে, যেখানে শিশু–কিশোরেরা আসবে, বাংলা ভাষার সৌন্দর্য নিয়ে আনন্দে মেতে থাকবে, সারা দিন সময় কাটাবে, ভাষা নিয়ে তাদের মধ্যে ভালোবাসা জন্ম নেবে, তারা বাড়ি চলে যাবে—এমন ইচ্ছার জায়গা থেকে বর্ণমেলার আয়োজন।

গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শব্দটি আলোচনায় উল্লেখ করে সাজ্জাদ শরিফ বলেন, পাকিস্তানিরা বলেছিল উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ১৯৫২ সালে যেসব ভাষাশহীদ রক্ত দিয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু বলেননি যে বাংলা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। তাঁরা বলেছিলেন, বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে। ফলে অন্তর্ভুক্তি তখন থেকেই শুরু হয়েছে যে ‘আমি নই, আরও অনেকে আছে।’ বাংলাদেশে তারই আরেকটা বড় বিস্ফোরণ হয়েছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার, সবাইকে একই রকম মর্যাদা দেওয়ার আন্দোলন হয়েছে।

এই সময় বর্ণমেলার বড় তাৎপর্য আছে উল্লেখ করে সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘বাঙালি যে ইতিহাস ধরে এসেছে, যেখানে সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছে, সেটা বর্ণমেলায় সবাই মনের মধ্যে রাখব। প্রথম আলো চায়, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাক।’

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সৌন্দর্য হলো এই দিবসে সব ভাষাকেই শ্রদ্ধা করতে বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। আগত দর্শনার্থীদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টার মধ্যে শিশু-কিশোরদের নিয়ে এসেছেন। আর সবাই একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণ করে উপযুক্ত পোশাক পরে এসেছেন। এতেই বোঝা যায়, এই ব্যাপারটাকে আপনারা গুরুত্বের সঙ্গে নেন।’

ম–তে ‘মা’। তাতে রং দিচ্ছে এক শিশু। আজ শুক্রবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকাল থেকে ঢাকার ধানমন্ডিতে সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে বর্ণমেলা শুরু হয়েছে.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ