কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের একটি কপি ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে দেখে বিশ্বাস করতে পারিনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিক (সমকালে) ‘গ্রামে নিষিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঢুকতে মানা’ শিরোনামে খবরটি প্রথম পাতায় ছেপেছে।

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফলসী ইউনিয়নে অবস্থিত একটি গ্রাম শড়াতলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই স্ট্যাম্পের বর্ণনায় বলা হচ্ছে, এতদ্বারা শড়াতলা সব গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে, সব প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো। যাঁরা বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সেই সঙ্গে তাঁদের চার হাজার টাকা জরিমানা করা হবে এবং তাঁদের পিতা–মাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করে ৯৫% মানুষ শিক্ষিত ও ২০ জনের মতো সরকারি কর্মকর্তার ওই গ্রামে ‘হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষদেরও গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের গ্রামগঞ্জে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন ২০২৩ সালে নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার এক গ্রামে বিয়ে, জন্মদিন বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে গানবাজনা নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রামে কেউ গানবাজনা করলে তাঁকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। সেই সময় এ ঘটনা বেশ আলোচনা তৈরি করে। তখন সংস্কৃতিকর্মীরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সুর ও গানের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যের গ্রামবাংলার সংস্কৃতিমণ্ডল যে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তা আমাদের কারও অজানা নয়। সেখানে এখন হাজির হয়েছে আর্থসামাজিক নতুন বাস্তবতা ও নানা আদর্শিক দ্বন্দ্ব বা প্রভাব।

শড়াতলা গ্রামটির এই নোটিশ এমন সময় এল, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এখানে ধর্মীয় মহলের আপত্তি ছাড়াও রাজনৈতিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বাধা আসছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকায় মহানগর নাট্য উৎসব, উত্তরায় বসন্ত উৎসব, চট্টগ্রামে বসন্ত উৎসব, টাঙ্গাইলের ঘুড়ি উৎসব, গোয়াইনঘাটে যাত্রাগান প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেছে বা আয়োজনই করা যায়নি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমির বইমেলা ঘিরে একের পর এক ঘটনা ও তর্কবিতর্ক আমরা দেখলাম। এসব ঘটনা ও অভিযোগ সত্যি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।

এর আগে আমরা দেখেছি গত ২ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় দেশনাটক দলের প্রদর্শনী চলার সময় বন্ধ করার মধ্যে দিয়ে। নাট্যকর্মীদের একাংশের প্রতিবাদের মুখে যেভাবে মাঝপথে নাটক বন্ধ করে দেওয়া হলো, সে সময় বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর সপ্তাখানেক পর ৮ নভেম্বর দেশের নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদের ওপর হামলা হলো। এরপর তাঁকে মঞ্চনাটকে বাধা দেওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এরপর বেশ কিছু নারী অভিনেত্রী-শিল্পীদের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

দেশের কয়েকটি স্থানে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করার মতো ঘটনা ঘটেছে। পরে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের উদ্যোগে আবার খেলার আয়োজন করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নারীদের ফুটবল খেলা নিয়ে একধরনের শঙ্কা থেকেই যায়। যদিও এ বছর নারী ফুটবল দলকে একুশে পদক দেওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে দারুণ এক প্রশংসনীয় কাজ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

গত দেড় দশকে দেশে ভালোবাসা দিবস উদ্‌যাপনে তরুণ-তরুণীর মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির কারণে আমাদের পরিবার ও সমাজে এখন এমন অনেক দিবসই ঢুকে পড়েছে। সেগুলোর সঙ্গে আমরা অভ্যস্তও হয়ে পড়েছি। সেসব দিবসকে ঘিরে নানা আয়োজন আমাদের বিনোদনের অংশও হয়ে গেছে। এসব দিবসকে ঘিরে নানা ব্যবসায়িক আয়োজনও থাকে। একটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও এখানে যুক্ত থাকে। আবার এমন অনেক দিবস আছে, যা পালনে অনেকে পছন্দ করেন না, অন্যকেও পালনে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু কোনো দিবস জোর করে পালন করতে বাধ্য করা বা পালনের সময় বাধা দেওয়া, অর্থাৎ নীতি পুলিশিং করা, তা কোনোভাবেই মানা যায় না। ভালোবাসা দিবসে টাঙ্গাইলে ফুলের দোকানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে একজনের ব্যবসার ক্ষতি করার তো মানে হয় না।

একইভাবে লালনের আখড়ায় হামলা, বাউলশিল্পীদের মেরে আহত করা, বাধাবিপত্তির ঘটনা অতীতেও বহুবার ঘটেছে। সেই অপরাধীদের ধরতে সব সময়ই সরকারের উদাসীনতা লক্ষ করা গিয়েছিল। গত কয়েক মাসেও এমন অনেক ঘটনা দেখা যাচ্ছে, সরকার কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু দিন শেষে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে দৃশ্যত মনে হয় না।

একদিকে যখন সংবিধান সংস্কার কমিশন ‘বহুত্ববাদ’ চর্চার সুপারিশ করছে, অন্যদিকে দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী বা মহল নিজেদের আদর্শ বা মতাদর্শ চরিতার্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সরকারের নমনীয় ভূমিকায় তারা আরও বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সৃজনশীল ও মননশীল কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান করছে। সমাজে ক্রমান্বয়ে একধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে। তাদের ঠেকাতে সরকার কি সত্যিই অপরাগ, নাকি সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোনো মহল দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারা করছে?

মনে রাখতে হবে, এই দেশ বহু মতের দেশ। এখানে বিভিন্ন ধর্মচর্চা থাকবে, নাটক-সিনেমার মঞ্চ থাকবে, সংগীত থাকবে, সাহিত্য থাকবে, এখানে ওয়াজ-মাহফিল ও পূজার্চনা সবই থাকবে। প্রাচীনকাল থেকে বহু মতের চর্চার ধারা যে অঞ্চলে প্রবাহিত, বাধা দিয়ে কি সেই চিরায়ত ধারা কখনো বন্ধ করা যাবে? জোর করে কোনো কিছু কি ঠেকিয়ে রাখা যায়?

সব বিভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে গড়ার প্রত্যয় ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমরা ইনক্লুসিভনেসটা গড়তে পারছি না। ঐক্যের সুতায় টানাটানির কারণে পদার্থবিদ্যার ভাষায় আমাদের চব্বিশের এই বন্ধনে এ ধরনের ‘পীড়ন’ দেখা যাচ্ছে, যা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করবে। ঝিনাইদহের শড়াতলা গ্রামের বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের টনক নড়েছে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে গ্রামটি থেকে সেই নোটিশ সরানো হয়েছে। তবে ওই গ্রামে যে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস আমরা দেখলাম, যা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে বহু মত-পথের ঐক্যসূত্রে গাথা বাংলাদেশ গড়া কঠিনই হয়ে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ভালো ফলনের আশায় গাছকে খাওয়ান তাঁরা

চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি প্রদেশ গুইঝৌতে প্রাচীনকাল থেকে ‘গেলাও’ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ভিয়েতনামেও এই জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন। চীনে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৭৭ হাজার।

কৃষিনির্ভর গেলাও জনগোষ্ঠীর সদস্যরা আজও প্রাচীনকালের পুরোনো এক ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন। বছরের নির্দিষ্ট দিনে তাঁরা গাছকে খাওয়ান, যা চীনা ভাষায় ‘ওয়েই শু’ রীতি নামে পরিচিত।

এই প্রাচীন রীতি মূলত একধরনের প্রার্থনা। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস, এতে প্রকৃতি তুষ্ট হয়, ফসল ভালো হয়, পরিবারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে। প্রতিবছর দুটি উৎসবের সময় এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়—চীনা নববর্ষে, যা বসন্ত উৎসব নামে পরিচিত। আর গেলাও নববর্ষে, যা চান্দ্র পঞ্জিকার তৃতীয় মাসের তৃতীয় দিনে পালিত হয়।

অনুষ্ঠানের দিন সকালে আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী পাহাড়ের ঢালে জড়ো হন। তাঁরা সঙ্গে করে চাল থেকে তৈরি মদ, শূকরের মাংস, মাছ ও লাল আঠালো চাল নিয়ে আসেন। পাহাড়ে পৌঁছে প্রথমে আতশবাজি পোড়ানো হয়। এতে করে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

এর মধ্যেই একটি পুরোনো ও শক্তিশালী গাছ বাছাই করা হয়। এরপর সবাই ধূপ জ্বালিয়ে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেন। সবশেষে মূল পর্ব ‘গাছকে খাওয়ানো’ শুরু হয়।

একজন কুঠার বা ছুরি দিয়ে গাছে তিনটি জায়গায় ছোট করে কেটে দেন। সেই ক্ষতস্থানে চাল, মাংস ও মদ ঢেলে দেওয়া হয়, যাতে গাছ তাঁদের দেওয়া ভোগ গ্রহণ করতে পারে। পরে ওই জায়গা লাল কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া গাছের গোড়া ঘিরে আগাছা পরিষ্কার করা হয়, মাটি আলগা করে দেওয়া হয়। এতে নতুন জীবনের বার্তা মেলে বলে মনে করেন গেলাও জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।

যে গাছকে খাওয়ানো হয়, সেটি যদি ফলদ হয়, তাহলে ভোগ দানকারীরা একটি আশাব্যঞ্জক শ্লোক উচ্চারণ করেন। বলেন, ‘তোমায় চাল খাওয়াই, ফল দিয়ো গুচ্ছ গুচ্ছ; তোমায় মাংস খাওয়াই, ফল দিয়ো দলা দলা।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘মবের’ পিটুনিতে নিহত রূপলাল দাসের মেয়ের বিয়ে আজ
  • এবারও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেই বাংলাদেশ
  • ডাইনির সাজে শাবনূর!
  • প্রার্থনার সুরে শেষ হলো ‘ফাতেমা রানীর’ তীর্থোৎসব 
  • ভালো ফলনের আশায় গাছকে খাওয়ান তাঁরা
  • টগি ফান ওয়ার্ল্ডে উদযাপিত হলো হ্যালোইন উৎসব
  • উদ্ভাবন–আনন্দে বিজ্ঞান উৎসব
  • নবীনদের নতুন চিন্তার ঝলক
  • বিজ্ঞান উৎসব উদ্বোধন করল রোবট নাও
  • ‘ফাতেমা রানীর তীর্থোৎসবে’ আলোয় ভাসল গারো পাহাড়