শড়াতলায় নিষেধাজ্ঞা: এভাবে কি বহু মত-পথের দেশ গড়া সম্ভব
Published: 22nd, February 2025 GMT
কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের একটি কপি ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে দেখে বিশ্বাস করতে পারিনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিক (সমকালে) ‘গ্রামে নিষিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঢুকতে মানা’ শিরোনামে খবরটি প্রথম পাতায় ছেপেছে।
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফলসী ইউনিয়নে অবস্থিত একটি গ্রাম শড়াতলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই স্ট্যাম্পের বর্ণনায় বলা হচ্ছে, এতদ্বারা শড়াতলা সব গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে, সব প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো। যাঁরা বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেই সঙ্গে তাঁদের চার হাজার টাকা জরিমানা করা হবে এবং তাঁদের পিতা–মাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করে ৯৫% মানুষ শিক্ষিত ও ২০ জনের মতো সরকারি কর্মকর্তার ওই গ্রামে ‘হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষদেরও গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের গ্রামগঞ্জে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন ২০২৩ সালে নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার এক গ্রামে বিয়ে, জন্মদিন বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে গানবাজনা নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রামে কেউ গানবাজনা করলে তাঁকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল। সেই সময় এ ঘটনা বেশ আলোচনা তৈরি করে। তখন সংস্কৃতিকর্মীরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সুর ও গানের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যের গ্রামবাংলার সংস্কৃতিমণ্ডল যে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তা আমাদের কারও অজানা নয়। সেখানে এখন হাজির হয়েছে আর্থসামাজিক নতুন বাস্তবতা ও নানা আদর্শিক দ্বন্দ্ব বা প্রভাব।
শড়াতলা গ্রামটির এই নোটিশ এমন সময় এল, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এখানে ধর্মীয় মহলের আপত্তি ছাড়াও রাজনৈতিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বাধা আসছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঢাকায় মহানগর নাট্য উৎসব, উত্তরায় বসন্ত উৎসব, চট্টগ্রামে বসন্ত উৎসব, টাঙ্গাইলের ঘুড়ি উৎসব, গোয়াইনঘাটে যাত্রাগান প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেছে বা আয়োজনই করা যায়নি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমির বইমেলা ঘিরে একের পর এক ঘটনা ও তর্কবিতর্ক আমরা দেখলাম। এসব ঘটনা ও অভিযোগ সত্যি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।
এর আগে আমরা দেখেছি গত ২ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় দেশনাটক দলের প্রদর্শনী চলার সময় বন্ধ করার মধ্যে দিয়ে। নাট্যকর্মীদের একাংশের প্রতিবাদের মুখে যেভাবে মাঝপথে নাটক বন্ধ করে দেওয়া হলো, সে সময় বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর সপ্তাখানেক পর ৮ নভেম্বর দেশের নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদের ওপর হামলা হলো। এরপর তাঁকে মঞ্চনাটকে বাধা দেওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এরপর বেশ কিছু নারী অভিনেত্রী-শিল্পীদের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।
দেশের কয়েকটি স্থানে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করার মতো ঘটনা ঘটেছে। পরে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের উদ্যোগে আবার খেলার আয়োজন করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নারীদের ফুটবল খেলা নিয়ে একধরনের শঙ্কা থেকেই যায়। যদিও এ বছর নারী ফুটবল দলকে একুশে পদক দেওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে দারুণ এক প্রশংসনীয় কাজ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত দেড় দশকে দেশে ভালোবাসা দিবস উদ্যাপনে তরুণ-তরুণীর মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির কারণে আমাদের পরিবার ও সমাজে এখন এমন অনেক দিবসই ঢুকে পড়েছে। সেগুলোর সঙ্গে আমরা অভ্যস্তও হয়ে পড়েছি। সেসব দিবসকে ঘিরে নানা আয়োজন আমাদের বিনোদনের অংশও হয়ে গেছে। এসব দিবসকে ঘিরে নানা ব্যবসায়িক আয়োজনও থাকে। একটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও এখানে যুক্ত থাকে। আবার এমন অনেক দিবস আছে, যা পালনে অনেকে পছন্দ করেন না, অন্যকেও পালনে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু কোনো দিবস জোর করে পালন করতে বাধ্য করা বা পালনের সময় বাধা দেওয়া, অর্থাৎ নীতি পুলিশিং করা, তা কোনোভাবেই মানা যায় না। ভালোবাসা দিবসে টাঙ্গাইলে ফুলের দোকানে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে একজনের ব্যবসার ক্ষতি করার তো মানে হয় না।
একইভাবে লালনের আখড়ায় হামলা, বাউলশিল্পীদের মেরে আহত করা, বাধাবিপত্তির ঘটনা অতীতেও বহুবার ঘটেছে। সেই অপরাধীদের ধরতে সব সময়ই সরকারের উদাসীনতা লক্ষ করা গিয়েছিল। গত কয়েক মাসেও এমন অনেক ঘটনা দেখা যাচ্ছে, সরকার কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু দিন শেষে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে দৃশ্যত মনে হয় না।
একদিকে যখন সংবিধান সংস্কার কমিশন ‘বহুত্ববাদ’ চর্চার সুপারিশ করছে, অন্যদিকে দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী বা মহল নিজেদের আদর্শ বা মতাদর্শ চরিতার্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সরকারের নমনীয় ভূমিকায় তারা আরও বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সৃজনশীল ও মননশীল কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান করছে। সমাজে ক্রমান্বয়ে একধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে। তাদের ঠেকাতে সরকার কি সত্যিই অপরাগ, নাকি সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোনো মহল দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারা করছে?
মনে রাখতে হবে, এই দেশ বহু মতের দেশ। এখানে বিভিন্ন ধর্মচর্চা থাকবে, নাটক-সিনেমার মঞ্চ থাকবে, সংগীত থাকবে, সাহিত্য থাকবে, এখানে ওয়াজ-মাহফিল ও পূজার্চনা সবই থাকবে। প্রাচীনকাল থেকে বহু মতের চর্চার ধারা যে অঞ্চলে প্রবাহিত, বাধা দিয়ে কি সেই চিরায়ত ধারা কখনো বন্ধ করা যাবে? জোর করে কোনো কিছু কি ঠেকিয়ে রাখা যায়?
সব বিভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে গড়ার প্রত্যয় ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমরা ইনক্লুসিভনেসটা গড়তে পারছি না। ঐক্যের সুতায় টানাটানির কারণে পদার্থবিদ্যার ভাষায় আমাদের চব্বিশের এই বন্ধনে এ ধরনের ‘পীড়ন’ দেখা যাচ্ছে, যা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করবে। ঝিনাইদহের শড়াতলা গ্রামের বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের টনক নড়েছে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে গ্রামটি থেকে সেই নোটিশ সরানো হয়েছে। তবে ওই গ্রামে যে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস আমরা দেখলাম, যা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে বহু মত-পথের ঐক্যসূত্রে গাথা বাংলাদেশ গড়া কঠিনই হয়ে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬০ দিন পর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা, উৎসবের আমেজ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) দীর্ঘ ১৬০ দিন পর একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসেছেন। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে বইছে উৎসবের আমেজ।
সকালে কুয়েট ক্যাম্পাসে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস। ছাতা মাথায় দল বেঁধে ছুটছেন ক্লাসরুমের দিকে। কখনো এক ছাতার নিচে দু-তিনজন। কারও সঙ্গে অভিভাবকও এসেছেন। সকাল নয়টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি শিক্ষাবর্ষের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ক্লাসে যোগ দেন। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে শ্রেণি কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করেন।
ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইসিই) বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দীপ্ত বলেন, ‘আমাদের প্রায় এক সেমিস্টার নষ্ট হয়ে গেছে। এই সময়টা খুব অস্বস্তিতে কেটেছে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে, তবে এখন আবার ক্লাস শুরু হওয়াটা ইতিবাচক দিক। আমরা আশাবাদী।’ একই ব্যাচের শিক্ষার্থী আম্মান বলেন, ‘অনেক দিন জীবনটা থেমে ছিল। আজকের দিনটা বিশেষ মনে হচ্ছে। ঠিক যেন স্কুলজীবনের প্রথম দিনের মতো। সব হতাশা কাটিয়ে আমরা অনেকটা নতুন করে শুরু করছি।’
হুমায়ুন কবির নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ে। পাঁচ মাস ধরে ক্লাস বন্ধ থাকায় ও মানসিকভাবে খুব চাপের মধ্যে ছিল। একসময় অসুস্থও হয়ে পড়ে। কুয়েটে এমন পরিস্থিতি আগে দেখিনি। কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে হয়তো আগেই খুলে যেত। তারপরও এখন অন্তত খুলেছে, এটা বড় স্বস্তি।’
কুয়েটের ছাত্র পরিচালক আবদুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার বলেন, আজ থেকে কুয়েটে ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে এখনো সব শিক্ষার্থী আসেননি। যাঁদের কেবল ক্লাস রয়েছে, তাঁরা অংশ নিচ্ছেন। যাঁদের পরীক্ষা ছিল, তাঁরা প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় চেয়েছে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন হবে ১৪ আগস্ট, ক্লাস শুরু ১৭ আগস্ট।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ওই রাতেই তৎকালীন উপাচার্য ও কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২৬ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ ও সহ-উপাচার্য অধ্যাপক শরিফুল আলমকে অব্যাহতি দেয়। ১ মে চুয়েটের অধ্যাপক হজরত আলীকে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার দাবিতে ৪ মে থেকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতি। এরপর কোনো শিক্ষকই ক্লাসে ফেরেননি। শিক্ষক সমিতির বিরোধিতার মুখে হজরত আলী দায়িত্ব পালন করতে না পেরে ২২ মে পদত্যাগ করেন।
এরপর ১০ জুন নতুন উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার কুয়েটের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী। পরদিন শুক্রবার তিনি খুলনায় এসে দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় আন্দোলন কর্মসূচি তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার ক্লাস শুরুর নোটিশ জারি করা হয়।