মূল হোতারা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে
Published: 27th, February 2025 GMT
সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান রক্ষার জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম একটি হলো কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুমে এর শিকার নিষিদ্ধ করা। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকে। কারণ, এ সময় মা কাঁকড়া ডিম পাড়ে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই কিছু জেলে, ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা যোগসাজশে এ নিষিদ্ধ মৌসুমেও মা কাঁকড়া শিকার অব্যাহত রেখেছেন। বছরের পর বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে।
২০২৪ সালের মতোই ২০২৫ সালেও কাঁকড়া শিকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছে বন বিভাগ। কিন্তু বাস্তবে বরং অভিযোগ উঠেছে, কিছু বনকর্মী এই অবৈধ কাঁকড়া শিকারিদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে তাঁদের নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে দিচ্ছেন। বন বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তাঁরা চুরি করে কাঁকড়া শিকারের প্রবণতা বন্ধ করতে চেষ্টা করছেন এবং টহল বৃদ্ধি করেছেন। কিন্তু বাস্তবে বিশাল পরিমাণ কাঁকড়া প্রতিদিন সুন্দরবন থেকে তুলে স্থানীয় বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে।
বন বিভাগের কার্যক্রম শুধু সুন্দরবনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু লোকালয়ে যখন এই কাঁকড়াগুলো বিক্রি হয়, তখন কি কোনো তদারকি থাকে? অন্যদিকে সুন্দরবনের আশপাশের দরিদ্র জেলেরা একমাত্র সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সরকার তাঁদের বিকল্প ব্যবস্থা করেনি অথচ তাঁদের ওপর কেবল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীর চাপে এবং মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া আগাম টাকার জন্য জেলেরা বাধ্য হন অবৈধভাবে কাঁকড়া ধরতে। কিন্তু ধরা পড়লে শুধু গরিব জেলেদেরই শাস্তি হয়, মূল হোতারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ পরিস্থিতিতে অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বাজার পর্যবেক্ষণ ও কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে সুন্দরবনের নদীগুলোতে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে কাঁকড়া বিক্রির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে যাঁরা এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়িত্বহীনতার জন্য যদি বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা অভিযুক্ত হন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দরিদ্র জেলেদের জীবন চালানো সম্ভব নয়। সরকারকে তাঁদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাসহ নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের জন্য ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নিলে জেলেরা অবৈধ কাঁকড়া শিকার থেকে সরে আসতে উৎসাহিত হবেন। স্থানীয় মানুষ ও জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যে তাঁরা নিজেরাই যদি কাঁকড়ার বংশবিস্তার ধ্বংস করেন, তাহলে ভবিষ্যতে এর ফল তাঁদের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র বন ব ভ গ র ব যবস থ র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’