খ্যাতির মোহে নয়, যেটাই করব তার পেছনে লক্ষ্য থাকবে: পারশা মাহজাবীন
Published: 27th, February 2025 GMT
দর্শক-শ্রোতাকে চমকে দেওয়ার মন্ত্র ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছেন পারশা মাহজাবীন। না, কথাটা একদম বাড়িয়ে বলা হয়নি। প্রমাণ চাইলে সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘ঘুমপরী’ ওয়েব সিনেমাটি দেখে নিতে পারেন। তাহলেই বুঝে যাবেন উষা চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কীভাবে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন পারশা। কারণ, এক বছর আগে ‘লাভ লাইন’ নাটকে দেখা অনন্যা চৌধুরীর সঙ্গে ‘ঘুমপরী’ সিনেমার উষাকে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। একই অবয়ব, তবু ভিন্ন দুই চরিত্র পারশাকে পর্দায় তুলে এনেছে দুইভাবে।
এ বিষয়ে কৃতিত্ব যতটা না নিজের, তারচেয়ে বেশি অবদান পরিচালক জাহিদ প্রীতমের বলে উল্লেখ করেন পারশা। একই সঙ্গে চরিত্র বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার বিষয়ে দুই সহশিল্পী প্রীতম হাসান ও তানজিন তিশার সহযোগিতার কথা বলতেও দ্বিধা করেন না এই অভিনেত্রী।
তাঁর কথায়, ‘‘ছোটবেলায় থিয়েটার করেছি বলেই অভিনয় দারুণভাবে রপ্ত করা শিখেছি, বিষয়টা এমন না। সত্য এটিই, অভিনয়ে আমার তেমন কোনো শিক্ষা নেই। যতটুকু শেখার সুযোগ হয়েছে তা শুটিং সেটে পরিচালকের নির্দেশ মেনে আর সহশিল্পীদের দেওয়া সাহস ও সহযোগিতায়। ‘ঘুমপরী’ ওয়েব সিনেমায় অভিনয়ের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি।’’
পারশার এ কথা থেকে বোঝা গেল, কীভাবে পারশা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে এত সহজে চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছেন। তারপরও একটু খটকা লাগে এটি ভেবে, অভিনয় সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা কিংবা অভিনীত চরিত্র আত্মস্থ করে নেওয়ার চেষ্টা না থাকলে কীভাবে তা দর্শককে বিশ্বাস করানো যায়? সে প্রশ্ন করতেই পারশা জানালেন, ‘অভিনয়ের প্রতি ভালোলাগা ছোটবেলা থেকে। যদিও অভিনেত্রী হওয়ার বাসনায় নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার সুযোগ ততটা পাইনি, তবে নানা বিষয় ও ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, জীবনধারা, পরিবেশভেদে মানুষের চিন্তাধারা বদলে যাওয়া– এসব নিয়ে অনেক ভেবেছি। যার কিছু বিষয় আমার গানেও উঠে এসেছে। হয়তো এগুলোই আমার অভিনেত্রী সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। বাকি ছিল শুধু অভিজ্ঞতা; যা মডেলিং, গানের সঙ্গে পারফরম্যান্স এবং টিভি নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে বেড়ে চলেছে।’ পারশার এ কথা থেকে বোঝার বাকি থাকে না, অভিনেত্রী হিসেবে দর্শক মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার মন্ত্রটা তিনি কীভাবে রপ্ত করেছেন।
অভিনয় ছেড়ে এবার প্রসঙ্গ গানের বিষয়ে। কারণ গানই পারশাকে বিনোদন দুনিয়ায় বড় পরিচিতি এনে দিয়েছে। বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় তাঁর গাওয়া ‘ভুলে যাই আমি’ তরুণ এই শিল্পীর পরিচিতি দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই গানের আগে ও পরে আরও কিছু গান গেয়ে শ্রোতার মনে আনুরণ তুলে গেছেন তিনি। এ কারণে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, অভিনেত্রী পরিচয় গড়ে ওঠার কারণে কণ্ঠশিল্পী পারশা হারিয়ে যাবেন কিনা? এর উত্তরে পারশা হেসে বলেন, ‘একদমই না। গান গাওয়া, অভিনয়, ছবি আঁকাসহ যা কিছু ভালো লাগে সবই চালিয়ে যাব। খ্যাতির মোহে নয়, যেটাই করব, তার পেছনে লক্ষ্য থাকবে একটাই, দেশ ও দেশের মানুষকে ভালো কিছু উপহার দেওয়া।’
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।