হারমান হেসের দ্য জার্নি টু দ্য ইস্ট উপন্যাসের কাহিনিতে দেখা যায়, একদল তীর্থযাত্রী আধ্যাত্মিক অভিযানে বের হন। তাঁদের গাইড হিসেবে থাকেন লিও নামের এক ব্যক্তি। লিও একজন বিনয়ী সেবক। তিনি তীর্থযাত্রীদের নানা ধরনের কাজ করে দেন। তাঁদের প্রয়োজন মেটান এবং তাঁদের সংগঠিত রাখেন। কিন্তু যাত্রার মাঝামাঝি লিও হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যান আর তীর্থযাত্রাটি বিশৃঙ্খলায় ভেঙে পড়ে। তীর্থযাত্রীরা (যাঁরা নিজেদেরই এ যাত্রার নেতা ভাবছিলেন) লিওর শান্ত, কিন্তু অপরিহার্য উপস্থিতির অভাবে পথ হারিয়ে ফেলেন।

ঠিক একইভাবে অভিজ্ঞ সরকারি পেশাজীবীদের হারানোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের গোছানো সবকিছু তছনছ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়। এই সরকারি পেশাজীবীরা হলেন ক্যারিয়ার সিভিল সার্ভেন্ট, প্রশাসক ও বিশেষজ্ঞ। যদিও হেসের গল্পে লিও ছিলেন একজনমাত্র মানুষ, তবে লিও সেসব বেনামি আমলা ও সিভিল সার্ভেন্টদের প্রতিনিধিত্ব করেন, যাঁরা রাষ্ট্র নামের জাহাজকে ভাসিয়ে রাখেন।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন যে সমস্যা চলছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে ‘প্রিন্সিপাল-এজেন্ট ডিলেমা’ (মূল ব্যক্তি ও তাঁর প্রতিনিধির দ্বন্দ্ব) নামের একটি ধারণা। ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতিবিদ স্টিফেন রস, মাইকেল জেনসেন ও উইলিয়াম এইচ মেকলিং এ ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন।

এ ধারণা বোঝায়, যখন একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী (প্রিন্সিপাল বা মূল ব্যক্তি) অন্য কাউকে (এজেন্ট বা প্রতিনিধি) তার পক্ষে কাজ করার দায়িত্ব দেয়, তখন এই দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। কারণ, প্রতিনিধির নিজস্ব উদ্দেশ্য, জ্ঞান বা পছন্দ মূল ব্যক্তির উদ্দেশ্যের সঙ্গে সব সময় মিল না–ও খেতে পারে।

সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এ সমস্যা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। রাজনৈতিক নেতারা (প্রিন্সিপাল) তাঁদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের (এজেন্ট) ওপর নির্ভর করেন। নেতারা চান, তাঁদের নির্দেশনা হুবহু অনুসরণ করা হোক। কিন্তু কর্মকর্তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা, নৈতিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখে কাজ করেন। ফলে অনেক সময় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেন, যা রাজনৈতিক নেতাদের চাওয়া অনুযায়ী না–ও হতে পারে।

এই অসামঞ্জস্য কাটিয়ে উঠতে ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রিন্সিপালরা এজেন্টদের প্রতিস্থাপন করার বা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এমন শুদ্ধি অভিযান সাধারণত উল্টো ফল দেয়। কারণ, একবার একজন সন্দেহপ্রবণ নেতা যখন তাঁর নিজের এজেন্টদের সরিয়ে দেন, তখন তিনি তাঁর কার্যকরভাবে শাসন করার উপায় হারিয়ে ফেলেন।

আধুনিক প্রশাসনিক তত্ত্বের ভিত্তি যিনি স্থাপন করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেই জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার দেখিয়েছিলেন, কার্যকর শাসনের জন্য একটি পেশাদার আমলাতন্ত্র প্রয়োজন। অভিজ্ঞ সরকারি কর্মচারীরা বাজেট, আইন প্রয়োগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো প্রকল্পের মতো জটিল কাজ বোঝেন এবং পরিচালনা করতে পারেন। যদি নিয়মভিত্তিক ও যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা না থাকে, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের খামখেয়ালিপনার কারণে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

শাসনকার্যে সন্দেহপ্রবণতা (প্যারানোইয়া) একটি বিপজ্জনক মানসিকতা। যদি কোনো নেতা সব সময় তাঁর নিজস্ব কর্মকর্তাদের বিশ্বাসঘাতক বলে সন্দেহ করেন, তাহলে তিনি একটা পর্যায়ে এমন শত্রু দেখতে শুরু করবেন, প্রকৃতপক্ষে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ডিপ স্টেট’ বা পর্দার আড়ালের শক্তি থেকে হুমকি আসছে বলে মনে করতেন, যদিও বাস্তবে তা কতটা সত্য ছিল, তা তর্কসাপেক্ষ।

এই মানসিকতার ফলে একটি দুষ্টচক্র তৈরি হয়। যখন নেতারা সন্দেহের বশে তাঁদের কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেন বা সরিয়ে দেন, তখন সরকারের অভ্যন্তরীণ জ্ঞান ও দক্ষতা কমে যায়। এতে প্রশাসন দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে সরকারের কার্যক্রম বিশৃঙ্খল হয়ে যায়, সরকার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

সরকারি সংস্থাগুলোর (যেমন এফবিআই, সিআইএ) বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হলে বা পদত্যাগে বাধ্য করা হলে জাতীয় নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে প্রশাসনের দক্ষতা কমে যায়, মনোবল নষ্ট হয় এবং ভবিষ্যতে মেধাবী লোকদের এসব সংস্থায় যোগদানে অনীহা তৈরি হয়। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিলে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও বিনিময়প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো সংবেদনশীল তথ্য ভাগাভাগি করতে ভয় পেতে পারে। তাদের মধ্যে এই আশঙ্কা হতে পারে, যদি সেই তথ্য ইলন মাস্ক বা তুলসী গ্যাবার্ডের মতো ব্যক্তিদের হাতে পড়ে যায়!

আরও পড়ুননির্বাচন করিয়ে জেলেনস্কির পতন ঘটালে ফল হবে ভয়াবহ ০৪ মার্চ ২০২৫

ইউএসএআইডি ধ্বংসের ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক সংযোগ ও কূটনৈতিক প্রভাব হারাচ্ছে। এটি বৈশ্বিক পরিসরে মার্কিন কৌশলগত স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখা কঠিন করে তুলবে। এ ছাড়া ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (এনএসএফ) মতো সংস্থাগুলো থেকে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের অপসারণ গবেষণা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে উন্নত প্রযুক্তি বিকাশে দেরি হবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনস্বাস্থ্য–সংকটের মতো নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা হ্রাস পাবে।

আধুনিক প্রশাসনিক তত্ত্বের ভিত্তি যিনি স্থাপন করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেই জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার দেখিয়েছিলেন, কার্যকর শাসনের জন্য একটি পেশাদার আমলাতন্ত্র প্রয়োজন। অভিজ্ঞ সরকারি কর্মচারীরা বাজেট, আইন প্রয়োগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো প্রকল্পের মতো জটিল কাজ বোঝেন এবং পরিচালনা করতে পারেন। যদি নিয়মভিত্তিক ও যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা না থাকে, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের খামখেয়ালিপনার কারণে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

সমানভাবে বিপজ্জনক হলো সরকারি প্রশাসনকে একটি প্রাইভেট কোম্পানির মতো চালানোর চেষ্টা, যেখানে সাফল্য ও ব্যর্থতা শুধু অ্যাকাউন্টিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষতা, খরচ সাশ্রয় ও লাভ পরিমাপ করা হয়। যদিও আর্থিক দায়িত্বশীলতা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সরকারি খাতের উদ্দেশ্য–সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব নিয়ে করপোরেট-স্টাইলের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। টেসলা থেকে ধার করা একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট ব্যালেন্স শিটে যৌক্তিক দেখায় এমন সম্ভাব্য সরকারি সঞ্চয় চিহ্নিত করতে পারেন বটে, কিন্তু সেটি দীর্ঘ মেয়াদে দেশকে অনেক বেশি খরচের দিকে নিয়ে যাবে।

এখন ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে ‘প্যারানয়েড প্রিন্সিপাল ডিলেমা’তে রূপ দিয়েছে, যেখানে নেতা আমলাদের শত্রু ভেবে তাঁদের ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন। ফলে আমলারা নিষ্ক্রিয় হচ্ছেন, নেতার প্রতি আস্থাহীন হচ্ছেন এবং নেতা একা হয়ে পড়ছেন। নেতা কারও ওপর ভরসা করতে পারছেন না এবং সত্যিকারের শাসনক্ষমতা হারাচ্ছেন। ‘জার্নি টু দ্য ইস্ট’ উপন্যাসের মতো (যেখানে তীর্থযাত্রীরা লিও ছাড়া পথ হারিয়ে ফেলে) একটি সরকারও যদি অনেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে, তবে সেই সরকার এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে পারে, যেখানে সব কর্মকর্তার সংহতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

সামি মাহরুম অলিভার উইম্যানে গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক ইনস্টিটিউশনের পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র র জন ত ক ন ত ব যবস থ ওপর ন র ক ষমত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আমি গর্বিত আমি একজন মুসলিম: আমির খান

বলিউডের মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খানকে নিয়ে রাজকুমার হিরানি নির্মাণ করেন আলোচিত সিনেমা ‘পিকে’। ২০১৪ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এটি। মুক্তির পর বক্স অফিসে সুপারডুপার হিট হয়।

এ সিনেমা মুক্তির আগে প্রকাশিত হয় আমিরের পোস্টার। সিনেমাটিতেও নগ্ন আমিরের দেখা মেলে। তারপর দারুণ আলোচনায় উঠে আসেন এই অভিনেতা। সমালোচনাও কম সইতে হয়নি তাকে। এখানেই শেষ নয়, হিন্দু ধর্মের প্রতি কটাক্ষ করার অভিযোগে তীব্র সমালোচনা মুখে পড়েন আমির। ভাঙচুর করা হয় প্রেক্ষাগৃহ।

প্রায় এক যুগ পর এসব বিষয় নিয়ে মুখ খুলেছেন আমির খান। ইন্ডিয়া টিভি চ্যানেলের ‘আপ কি আদালত’ শোয়ে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন আমির। তার ভাষায়— “ধর্ম নয়, ধর্মের নামে যারা প্রতারণা করে ‘পিকে’ সেসব লোকদের সমালোচনা করেছে।”

আরো পড়ুন:

জোড়া লাগল অর্জুন-মালাইকার ভাঙা প্রেম!

অন্তঃসত্ত্বা কিয়ারাকে কী উপহার দিলেন রাম চরণ?

ব্যাখ্যা করে আমির খান বলেন, “তারা ভুল। আমরা কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নই। আমরা সমস্ত ধর্ম ও সমস্ত ধর্মের মানুষদের শ্রদ্ধা করি। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা কামায়, তাদের বিষয়ে সচেতন করাই ‘পিকে’ সিনেমার উদ্দেশ্য ছিল। প্রতিটি ধর্মেই এমন লোক পাওয়া যায়।”

‘পিকে’ সিনেমায় পাকিস্তানি এক মুসলিম ছেলেরি প্রেমে পড়ে ভারতীয় হিন্দু ধর্মের অনুসারী এক নারী (আনুশকা শর্মা)। এটাকে ‘লাভ জিহাদ’ বলে অনেকে অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে আমির খান বলেন, “সবসময়ই এটিকে লাভ জিহাদ বলা উচিত নয়। এটি মানবতা। মানবতা ধর্মের উর্ধ্বে।”

গত ৭-৮ বছরে দেশদ্রোহী, হিন্দুবিরোধী হওয়ার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন আমির খান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি গর্বিত আমি একজন মুসলিম। আমি গর্বিত আমি একজন ভারতীয়। দুটোই একসঙ্গে সত্যি হতে পারে।”

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কখন ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে, সেই আতঙ্কে দিন কাটছে তেহরানের মানুষের
  • ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র কেড়ে নিল তরুণ ইরানি কবি আর তাঁর পুরো পরিবারকে
  • চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু
  • আমি কারো সঙ্গে পাল্লা দিতে আসিনি: অপু বিশ্বাস
  • হামজাদের কোচিং স্টাফ বাড়ছে
  • ব্যক্তিগত মুহূর্ত নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, স্পষ্ট বার্তা দিলেন অপু
  • ব্যক্তিগত মুহূর্ত নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমি নেই: অপু বিশ্বাস
  • শালবনে ছেচরা কই ও পাটখই
  • কালিয়াকৈরে বিএনপির দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় আটক ২ নেতা, পরে ছাড়া পেলেন একজন
  • আমি গর্বিত আমি একজন মুসলিম: আমির খান