সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারীর প্রতি নিপীড়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মাগুরায় শিশুকে ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। আজ রোববার সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শিক্ষক নেটওয়ার্ক, রাজু ভাস্কর্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা, বুয়েট শহীদ মিনারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বিভাগ বিক্ষোভ করেছে।

কর্মসূচি থেকে শিশু ধর্ষণে দ্রুত সময়ে বিচার, বিগত সময়ের সব ধর্ষণ-নিপীড়নের বিচার শুরু করা, ধর্ষণের ঘটনায় বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করার দাবি এবং নারীর প্রতি গৃহ থেকে পাবলিক পরিসরে পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও ওঠে।

শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিবাদ সমাবেশ

আজ সকাল সাড়ে ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিবাদ সমাবেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্লাটফর্ম থেকে ৯ দফা দাবি জানানো হয়।

সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, নারীর ওপর নিপীড়ন গৃহ থেকে পাবলিক পরিসরে দেখতে পাই। এই নির্যাতনগুলো চলছে। সমাজ এই নির্যাতনকে স্বাভাবিকীকরণ করে। নির্যাতনের স্ট্রাকচার এমন হয়েছে যে, নির্যাতকরা জানে, তার কোনো শাস্তি হবে না। আর নারীকে দোষ দেবে, সে কেন পথে বেরিয়েছে।

তিনি আর বলেন, একেবারে মাইক্রো লেভেল থেকে এই নির্যাতন টিকিয়ে রাখার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। যদি না এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে না দাঁড়ান তাহলে তিনি নির্যাতক ব্যবস্থার অংশ। এটা ঠেকাতে হবে প্রত্যেককে। সবাই একসঙ্গে মিলে নারী, দুর্বলের ওপর নির্যাতন রুখে দেওয়া সম্ভব।

চলমান নারীর প্রতি সহিংসতার কথা উল্লেখ করে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম মাহবুব বলেন, নারী উপদেষ্টারা কী আদৌ আছেন? দেশে কী ঘটছে, ওনারা কী সে ব্যাপারে সচেতন? ওনারা তো এগিয়ে আসতে পারেন, সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু সেরকম কোনো উদ্যোগ দেখছি না।

কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারীকে হেনস্তার ঘটনায় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা কয়েকটি দাবি জানান। তিনি বলেন, থানা থেকে ভুক্তভোগী ছাত্রীর ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে পড়া এবং অভিযুক্তের নারীকে নিয়ে অশালীন বক্তব্য দিয়ে বাধা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পুলিশদের বিচার করা, ভুক্তভোগীকে সাইবার বুলিং এবং ধর্ষণের হুমকিদানকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা, অভিযুক্তকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করে বরখাস্ত করতে হবে।

সমাবেশ থেকে দেওয়া ৯ দফা দাবি পাঠ করেন শিক্ষার্থী নওরীন সুলতানা তমা। দাবিগুলো হলো- জননিরাপত্তা দানে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দায় স্বীকারপূর্বক পদত্যাগ করতে হবে; সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; সারাদেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নিপীড়নের সব ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে হবে; প্রয়োজনে ধর্ষণের ঘটনার বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে; সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে ধর্ষণ ও নারী-নিপীড়ন প্রতিরোধের আইনসমূহে প্রয়োজনীয় যৌক্তিক সংযোজন, বিয়োজন ও সংশোধন করতে হবে।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন আইন করে বাধ্যতামূলক করতে হবে; প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে জেন্ডার সংবেদনশীলতার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ধর্ষণ মামলা গ্রহণে জটিলতা তা দূর করতে হবে। বিশেষ আইন অথবা বিশেষ সেলে’র অধিকারবলে ধর্ষণের অভিযোগ যে কোনো থানা গ্রহণ করবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; ভুক্তভোগী ও সাক্ষীকে সব ধরনের সুরক্ষা প্রদানের জন্য ২০১১ সালে পর্যালোচিত সাক্ষী সুরক্ষা আইন পুনরায় পর্যালোচনা ও প্রয়োগ করা; চবির নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা, স্লাটশেমিং এবং বরখাস্তের ঘটনা পূর্ণ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমন্বয়ে স্বাধীন যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সেলে আবশ্যিক নারী সদস্য থাকবে। অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে, দোষীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা উক্ত সেলকে দিতে হবে।

সমাবেশে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, শিক্ষক ফাহমিদুল হক, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান, কবি ও লেখক ফেরদৌস আরা রুমি, সংস্কৃতিকর্মী সুস্মিতা রায় বক্তব্য দেন।

এদিকে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ চত্বরে, রাজু ভাস্কর্যে প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ভূতত্ব বিভাগ, বাংলা বিভাগসহ একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা পৃথক ব্যানারে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। তারা মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকদের ফাঁসির দাবি জানান এবং ধর্ষণের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

রাজু ভাস্কর্যে ঢামেকের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। তারা নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ধর্ষকের ফাঁসি দাবি করেছেন।

শিক্ষার্থীরা জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেখতে চান তারা। বিশেষ করে মাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন তারা।

বুয়েট শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি

ধর্ষণের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এসময় ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুয়েট একতাবদ্ধ উল্লেখ করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডসহ ছয়টি দাবি উত্থাপন করেছেন তারা। আজ  সকালে মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান ও সন্তোষজনক নয়। 

তারা দাবি জানান- দেশের ধর্ষণ আইন পরিবর্তন করে দ্রুত ট্রাইবুনালের মাধ্যমে শাস্তি দ্রুত সময়ে কার্যকর করতে হবে; মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের এই নতুন আইনে দ্রুত সময়ের মধ্যে নজিরবিহীন শাস্তি কার্যকর করতে হবে; সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া সব নারী নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে; নারী নির্যাতনের ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়া ও বিচারিক কার্যক্রম দ্রুততম সময়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; আইনি সহায়তা ও বিচারের প্রক্রিয়া নারীবান্ধব করে তুলতে হবে; সর্বোপরি বাড়িতে, বাইরে সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান ও কার্যকর হতে হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ স কর য পদক ষ প ক র যকর র জন য র করত ত সময় গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

ছুটি না পেয়ে অসুস্থ শ্রমিকের মৃত্যু, মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ 

নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মদনপুর এলাকায় লারিজ ফ্যাশনের পোশাক কারখানায় অসুস্থ হয়ে রিনা আক্তার (৩২) নামের এক শ্রমিকের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। 

সোমবার (৩ নভেম্বর) সকালে তারা মদনপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। খবর পেয়ে থানা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, রিনা আক্তার অসুস্থ অবস্থায় কারখানায় কাজ করছিলেন। রোববার তিনি বেশি অসুস্থতা অনুভব করলে ছুটি চেয়ে আবেদন করেন। তবে, কর্তৃপক্ষ ওই শ্রমিকের আবেদনে সাড়া না দিয়ে কাজ করতে বাধ্য করেন। ওই নারী গুরুতর অসুস্থ হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে সহকর্মীরা স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অবরোধকারী শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের সহকর্মীর মৃত্যুর জন্য মালিকপক্ষ দায়ী। রিনা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ছুটি দেওয়া হয়নি। চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন তিনি। 

লারিজ ফ্যাশনের মালিকপক্ষ ও কর্মকর্তাদেরকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে লারিজ ফ্যাশন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শিমুল বলেছেন, আমাদের একজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মৃত্যু হয়। এতে আমাদের কোনো গাফিলতি নেই। আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি।

কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাদের জিলানী বলেছেন, সহকর্মীর মৃত্যুর জন্য গার্মেন্টস মালিকপক্ষ দায়ী, এমন অভিযোগ করে শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। ঘটনাস্থলে থানা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশও আছে। শ্রমিকরা রাস্তা থেকে সরে গেছেন। যানচলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।

ঢাকা/অনিক/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ