বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের মাসিক খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানোর পরিকল্পনার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি বলেছে, বরাদ্দ অর্ধেক কমলে রোহিঙ্গাদের ওপর এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি এ আহ্বান জানায়। চার দিনের সফরে গতকাল বাংলাদেশে এসেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তাঁর এ সফরের প্রাক্কালে এ আহ্বান জানাল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ৫ মার্চ লিখিতভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেকের বেশি কমানোর পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশকে জানায়। সংস্থাটি বলেছে, জরুরি নতুন তহবিল পাওয়া না গেলে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাবারের বরাদ্দ আগামী এপ্রিল থেকে সাড়ে ১২ ডলার থেকে ৬ ডলারে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে তারা।

গতকাল নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করেন। এপ্রিল থেকে তাঁদের জন্য ডব্লিউএফপির মাসিক বরাদ্দ ব্যাপক হারে কমতে পারে। এটা তাঁদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিষয়টি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা কীভাবে দেখছেন, তা নিয়ে সম্প্রতি কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছে তারা।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, প্রায় ৯৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ডব্লিউএফপি তাঁদের মাসিক খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক করার পরিকল্পনা করছে। এমন সময়ে এই ঘোষণা এল, যখন তহবিল স্বল্পতায় রোহিঙ্গাদের জীবনে টানাপোড়েন চলছে। তাই এই পরিস্থিতিতে বরাদ্দ কমলে তাঁদের জীবন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ডব্লিউএফপি বলেছে, দাতাদের পক্ষ থেকে সার্বিক তহবিল বরাদ্দ কমায় রোহিঙ্গাদের মাসিক খাবারের বরাদ্দ কাটছাঁট করার পরিকল্পনা করতে হচ্ছে তাদের। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) অর্থ অবরুদ্ধের নির্দেশ দেন তা সরাসরি যুক্ত নয়।

এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক স্মৃতি সিং বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও পরিষেবায় এরই মধ্যে যে ভয়াবহ স্বল্পতা চলছে, তহবিল ঘাটতি সেই সংকটে আরও বাড়িয়ে তুলবে। শরণার্থীদের মধ্যে যাঁরা বৈষম্যের শিকার ও যাঁরা আরও প্রান্তিক হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁরা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বেন। বিশেষ করে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান আরও, ‘কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ডব্লিউএফপির (সহায়তার) ওপর নির্ভর করা ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকার তাদের চাকরি করার বিষয়টি কঠোরভাবে সীমিত করে রেখেছে। আশ্রয়শিবিরের বাইরে তাঁরা চলাচলও করতে পারেন না।’
‘আমাদের খাওয়া কমাতে হবে’

ডব্লিউএফপি খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানোর পরিকল্পনার কথা জানানোর পর কক্সবাজারের ছয় রোহিঙ্গা তরুণের সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাঁদের একজন ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ আয়েস। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার মুখে ২০১৭ সালে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ৭ লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে একজন তিনি। এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘বরাদ্দ কমিয়ে যে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা দৈনিক তিনবেলা খাবারের জন্য অপর্যাপ্ত। এমনটা হলে কিছু মানুষকে দৈনিক খাবার খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে।’

আরও পড়ুনতহবিল না পেলে রোহিঙ্গাদের রেশন অর্ধেকের বেশি কমাতে হবে: ডব্লিউএফপি০৭ মার্চ ২০২৫

আশ্রয়শিবিরের ২৩ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবক মুহাম্মদ মির্জার মতে, যে মূল্যস্ফীতি চলছে, তাতে মাসে ৬ ডলারের বরাদ্দ দিয়ে শুধু সর্বোচ্চ চাল, ডাল ও লবণের মতো নিত্যপণ্য কেনা সম্ভব। ফলে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে দুধ, ডিম, ফল ও সবজির মতো অন্য কিছু কেনার মতো অর্থ থাকবে না। মুহাম্মদ মির্জা বলেন, ‘এটা আমাদের ভয়াবহ ক্ষতির মুখে ফেলবে।’

আমারাহ (ছদ্মনাম) নামের ২১ বছর বয়সী আরেক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, বর্তমান বরাদ্দে একটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্য মাসে ১৩ কেজি চাল পান। বরাদ্দ কমলে তা ১০ কেজিতে নেমে আসবে। প্রতিদিন খেয়েপরে বাঁচার জন্য এটা যথেষ্ট নয়।

আরও পড়ুনকক্সবাজারে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করবেন জাতিসংঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টা১২ মার্চ ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম স ক খ ব র র বর দ দ র হ ঙ গ দ র জন য অ য মন স ট বর দ দ ক তহব ল

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৬০ হাজার ছাড়াল

ইসরায়েলের হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। উপত্যকাটিতে প্রায় ২২ মাস ধরে চলা সংঘাতের সময় হত্যা করা হয়েছে এই ফিলিস্তিনিদের। নৃশংস হামলার পাশাপাশি গাজা অবরোধ করে তীব্র খাদ্যসংকট সৃষ্টি করেছে ইসরায়েল। এর জেরে মৃত্যু হয়েছে দেড় শতাধিক মানুষের। তাঁদের বেশির ভাগই শিশু।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। আজ মঙ্গলবার উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর ৬৬২ দিনে ৬০ হাজার ৩৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সে হিসাবে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ৯০ জনের বেশি। হামলা শুরুর পর থেকে আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮৭০ ফিলিস্তিনি।

আজও গাজাজুড়ে তীব্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এদিন সকাল থেকে শুরু করে বিকেল সাড়ে ছয়টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অন্তত ৬২ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন। আর আগের ২৪ ঘণ্টায় আহত হয়েছেন মোট ৬৩৭ জন ফিলিস্তিনি। গাজার মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ।

গাজায় নিজেদের অভিযানের লক্ষ্য হামাসকে নির্মূল করা বলে দাবি ইসরায়েলের। তবে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত প্রায় সবাই নারী, শিশুসহ বেসামরিক ফিলিস্তিনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উপত্যকাটিতে ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। সোমবার ইসরায়েলভিত্তিক দুটি মানবাধিকার সংস্থাও একই কথা বলেছে।

গাজায় যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় ত্রাণ

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গাজায় ত্রাণ প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আগের তুলনায় শিথিল করেছে ইসরায়েল। উপত্যকাটির কিছু এলাকায় প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে হামলা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলছে কয়েকটি দেশ। তবে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) অভিযোগ, গাজায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ ত্রাণ যাচ্ছে না।

ডব্লিউএফপির পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকা আঞ্চলিক ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ আঞ্চলিক প্রকল্প উপদেষ্টা রস স্মিথ বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ ত্রাণের জন্য অনুমতি চেয়েছিলাম, তা পাইনি। এই শতাব্দীতে এর আগে এমন কিছু দেখা যায়নি।’ ডব্লিউএফপির তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিতে রয়েছেন। অপুষ্টিতে ভোগা ৯০ হাজার নারী-শিশুর বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন।

আরও পড়ুনইসরায়েলের দুই মন্ত্রীর নেদারল্যান্ডসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো১ ঘণ্টা আগে

ডব্লিউএফপির মতো একই ভাষ্য ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশনের (আইপিসি)। তারা বলছে, গাজায় প্রতি মাসে ৬২ হাজার টন খাবার প্রয়োজন। তবে ইসরায়েলের ত্রাণ সমন্বয়কারী সংস্থা সিওজিএটির তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে উপত্যকাটিতে মাত্র ১৯ হাজার ৯০০ টন খাবার প্রবেশ করেছে। আর জুনে করেছে ৩৭ হাজার ৮০০ টন।

এমন পরিস্থিতিতে গাজায় প্রতিদিনই অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে ইসরায়েলের গাজা অবরোধ শুরুর পর থেকে অনাহারে অন্তত ১৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৮৮ জনই শিশু। বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বিগত কয়েক সপ্তাহে।

আরও পড়ুনগাজায় কেউ না খেয়ে নেই—দাবি নেতানিয়াহুর, দ্বিমত ট্রাম্পের৪ ঘণ্টা আগে

‘দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিকল্প নেই’

গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতার মধ্যে গতকাল সোমবার ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সম্মেলন শুরু হয়েছে। এই সম্মেলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ফ্রান্স ও সৌদি আরব। সম্মেলনে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ নোয়েল-ব্যারট বলেছেন, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বেঁচে থাকার যে বৈধ আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তাতে সহায়তা করতে পারে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান।

সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, গাজায় ইসরায়েল যে নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা অসহনীয়। এ ছাড়া ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে অবৈধভাবে পশ্চিম তীরকে বিচ্ছিন্ন করছে দেশটি। ইসরায়েলে এই দুই পদক্ষেপই বন্ধ করতে হবে।

এরই মধ্যে সোমবার এক চিঠিতে নেদার‌ল্যান্ডস সরকার জানিয়েছে, গাজা পরিস্থিতির নিন্দা জানাতে দেশটিতে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হবে। এ ছাড়া ইসরায়েলি মন্ত্রী বেন-গভির ও বেজালাল স্মতরিচের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি।

আরও পড়ুনগাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল: বলছে ইসরায়েলভিত্তিক দুই মানবাধিকার সংস্থা২১ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৬০ হাজার ছাড়াল