রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান
Published: 13th, March 2025 GMT
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের মাসিক খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানোর পরিকল্পনার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি বলেছে, বরাদ্দ অর্ধেক কমলে রোহিঙ্গাদের ওপর এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি এ আহ্বান জানায়। চার দিনের সফরে গতকাল বাংলাদেশে এসেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তাঁর এ সফরের প্রাক্কালে এ আহ্বান জানাল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ৫ মার্চ লিখিতভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেকের বেশি কমানোর পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশকে জানায়। সংস্থাটি বলেছে, জরুরি নতুন তহবিল পাওয়া না গেলে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাবারের বরাদ্দ আগামী এপ্রিল থেকে সাড়ে ১২ ডলার থেকে ৬ ডলারে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে তারা।
গতকাল নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করেন। এপ্রিল থেকে তাঁদের জন্য ডব্লিউএফপির মাসিক বরাদ্দ ব্যাপক হারে কমতে পারে। এটা তাঁদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিষয়টি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা কীভাবে দেখছেন, তা নিয়ে সম্প্রতি কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছে তারা।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, প্রায় ৯৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ডব্লিউএফপি তাঁদের মাসিক খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক করার পরিকল্পনা করছে। এমন সময়ে এই ঘোষণা এল, যখন তহবিল স্বল্পতায় রোহিঙ্গাদের জীবনে টানাপোড়েন চলছে। তাই এই পরিস্থিতিতে বরাদ্দ কমলে তাঁদের জীবন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ডব্লিউএফপি বলেছে, দাতাদের পক্ষ থেকে সার্বিক তহবিল বরাদ্দ কমায় রোহিঙ্গাদের মাসিক খাবারের বরাদ্দ কাটছাঁট করার পরিকল্পনা করতে হচ্ছে তাদের। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) অর্থ অবরুদ্ধের নির্দেশ দেন তা সরাসরি যুক্ত নয়।
এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক স্মৃতি সিং বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও পরিষেবায় এরই মধ্যে যে ভয়াবহ স্বল্পতা চলছে, তহবিল ঘাটতি সেই সংকটে আরও বাড়িয়ে তুলবে। শরণার্থীদের মধ্যে যাঁরা বৈষম্যের শিকার ও যাঁরা আরও প্রান্তিক হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁরা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বেন। বিশেষ করে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান আরও, ‘কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ডব্লিউএফপির (সহায়তার) ওপর নির্ভর করা ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকার তাদের চাকরি করার বিষয়টি কঠোরভাবে সীমিত করে রেখেছে। আশ্রয়শিবিরের বাইরে তাঁরা চলাচলও করতে পারেন না।’
‘আমাদের খাওয়া কমাতে হবে’
ডব্লিউএফপি খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানোর পরিকল্পনার কথা জানানোর পর কক্সবাজারের ছয় রোহিঙ্গা তরুণের সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাঁদের একজন ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ আয়েস। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার মুখে ২০১৭ সালে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ৭ লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে একজন তিনি। এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘বরাদ্দ কমিয়ে যে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা দৈনিক তিনবেলা খাবারের জন্য অপর্যাপ্ত। এমনটা হলে কিছু মানুষকে দৈনিক খাবার খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে।’
আরও পড়ুনতহবিল না পেলে রোহিঙ্গাদের রেশন অর্ধেকের বেশি কমাতে হবে: ডব্লিউএফপি০৭ মার্চ ২০২৫আশ্রয়শিবিরের ২৩ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবক মুহাম্মদ মির্জার মতে, যে মূল্যস্ফীতি চলছে, তাতে মাসে ৬ ডলারের বরাদ্দ দিয়ে শুধু সর্বোচ্চ চাল, ডাল ও লবণের মতো নিত্যপণ্য কেনা সম্ভব। ফলে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে দুধ, ডিম, ফল ও সবজির মতো অন্য কিছু কেনার মতো অর্থ থাকবে না। মুহাম্মদ মির্জা বলেন, ‘এটা আমাদের ভয়াবহ ক্ষতির মুখে ফেলবে।’
আমারাহ (ছদ্মনাম) নামের ২১ বছর বয়সী আরেক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, বর্তমান বরাদ্দে একটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্য মাসে ১৩ কেজি চাল পান। বরাদ্দ কমলে তা ১০ কেজিতে নেমে আসবে। প্রতিদিন খেয়েপরে বাঁচার জন্য এটা যথেষ্ট নয়।
আরও পড়ুনকক্সবাজারে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করবেন জাতিসংঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টা১২ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম স ক খ ব র র বর দ দ র হ ঙ গ দ র জন য অ য মন স ট বর দ দ ক তহব ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।