যেভাবে পরিকল্পনা করে ছিনতাই করা হয় ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা
Published: 14th, March 2025 GMT
দুই বছর আগে রাজধানীর উত্তরায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের মামলায় ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ছিনতাই হওয়া টাকার মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা উদ্ধার করতে পেরেছে ডিবি পুলিশ। ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার হদিস এখনো মেলেনি।
২০২৩ সালের ৯ মার্চ একটি সিকিউরিটি কোম্পানির গাড়ি থেকে এই ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিনতাই করা হয়। এ ঘটনায় ২০২৩ সালের ৯ মার্চ মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দায়েরের পর ডাকাতিতে জড়িত ১৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এদের মধ্যে ১২ জনের কাছ থেকে ডাকাতির ৮ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার ৫ টাকা উদ্ধার করা হয়৷
প্রায় দুই বছর তদন্ত শেষে গত ১৯ জানুয়ারি মামলার তদন্তকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মো.
চার্জশিটভূক্ত আসামিরা হলেন- সোহেল রানা শিশির ওরফে সোহেল ওরফে রানা ওরফে সোহেল রানা ওরফে শিশির, মো. আকাশ আহম্মেদ বাবলু ওরফে বাবলু মিয়া ওরফে হাজারি, মো. হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব ওরফে নুরু, মো. এনামুল হক বাদশা, মো. বদরুল আলম, মো. সোনাই মিয়া, মো. মিলন মিয়া, নিজাম উদ্দিন ওরফে মো. হৃদয়, মিজানুর রহমান, মো. আকাশ মাদবর, সাগর মাদবর, সানোয়ার হাসান, ইমন ওরফে মিলন জমাদ্দার, মো. মোস্তফা ও মো. জনি মিয়া।
এদের মধ্যে মোস্তফা ও জনি পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়েছে। আগামি ২০ এপ্রিল এ মামলার চার্জশিট আদালতে উপস্থাপনের তারিখ ধার্য রয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান বলেন, “এ মামলায় ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছি। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছে থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে সুনামগঞ্জে বাড়ি অভিযুক্ত মোস্তফা ও জনিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। ধারণা করছি, লুণ্ঠিত অবশিষ্ট ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা তাদের কাছে রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে অবশিষ্ট টাকা উদ্ধার করতে পারবো। তারা পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছি।”
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “আসামিরা সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য এবং প্রত্যেকেই একে অপরের পূর্ব পরিচিত। তাদের মধ্যে প্রায়ই মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হতো। আসামি সোহেল, আকাশ, হাবিবুর ও এনামুল দলনেতা এবং এ ডাকাতির ঘটনা সংঘটনের মূল পরিকল্পনাকারী। অন্যরা তাদের কথা মেনে চলে। সোহেল রানা ২০২১ সালের ৩ মার্চ মিরপুর ডিওএইচএস এ অবস্থিত মানি প্লান্ট লিংক প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডে ড্রাইভার হিসেবে ১৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। এক বছর পর চাকরি ছেড়ে দেন। কোম্পানির অন্যান্য ড্রাইভার ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ডাচ বাংলা ব্যাংকের টাকা বুথে ফিডিং করার জন্য কখন, কোথায়, কোন পথে নিয়ে যায় এ বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজখবর রাখতেন তিনি। এনামুল ও সোহেলের কু-প্ররোচনায় আকাশ ও হাবিব পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে অন্য আসামিদের নিয়ে ২০২৩ সালের ৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে একত্রিত হন। পরদিন ৯ মার্চ ভোর ৪/৫ টার দিকে বনানীর হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে যাত্রী ছাউনিতে আসেন।”
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “আকাশ মাদবর মাইক্রোবাস ভাড়ায় চালান। তিনি ঘটনার দিন ৯ মার্চ ভোরে ৮ হাজার টাকা ভাড়ায় তার মালিককে সিলেটে যাওয়ার মিথ্যা কথা বলেন। পরে আসামিরা তাকেসহ তারা গাড়ির পিছনের সিটে বসে এবং সোহেল গাড়ির ড্রাইভার হিসাবে গাড়িটি কিছু দূরে চালিয়ে একটি গ্যাস পাম্পে যান। তারপর ৫০০ টাকার গ্যাস নেন। পরবর্তীতে আসামিরা উত্তরার মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন রাস্তায় ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের টাকা ভর্তি গাড়ি ডাকাতি করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সকাল ৬ টা ৫৫ মিনিটে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে মানি প্ল্যান্ট লিংক কোম্পানি লিমিটেডের পাঁচজনের একটি টিম চারটি ট্রাংক ভর্তি মোট ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা নিয়ে সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় ডাচ্ বাংলা এটিএম বুথে টাকা ফিডিং করার উদ্দেশ্যে রওনা করে। সকাল ৭ টার দিকে আসামি সোহেল গাড়িটি রাস্তায় চলমান অবস্থায় দেখতে পেয়ে মোবাইল ফোনে প্রথমে এনামুলকে জানান।
তুরাগ থানাধীন উত্তরা ১৬ নাম্বার সেক্টর এলাকায় পৌঁছালে আসামিরা তাদের মাইক্রোবাসটি ডানদিক থেকে বামদিকে চাপদিয়ে সামনে গিয়ে টাকা ভর্তি মাইক্রেবাসটি থামায়। ডাকাতরা গাড়ি থেকে নামে এবং সবাইকে কিলঘুসি মারে ও গালিগালাজ করেন।হাবিব টাকা ভর্তি গাড়ির ড্রাইভার অহিদুজ্জামানের কাছে থেকে জোর করে গাড়ির চাবি কেড়ে নেয়। অন্য ডাকাতরা বাকি চারজনকে রাস্তার পার্শ্বে ঝোপঝাড়ে আটকে রাখে। পরে তারা গাড়িটি নিয়ে সামনে পঞ্চবটির দিকে ৩/৪ মিনিট চালানোর পর গাড়িটি থামিয়ে টাকা ভর্তি চারটি ট্রাংক তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। তারপর মিরপুর ১২ নম্বর হয়ে পূর্বাচল ৩০০ ফিট রাস্তায় আসেন। সেখানে ট্রাংকের তালা ভেঙ্গে লুট করা ৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ভাগ করে নিয়ে যার যার মতো চলে যান। তিনটি ট্রাংক ভর্তি অবশিষ্ট ৩ কোটি ৮৯ টাকা এবং গাড়িসহ ড্রাইভার আকাশ মাদবর উত্তরা ও খিলক্ষেত এলাকায় অবস্থান করে।”
যার কাছ থেকে যত টাকা উদ্ধার :
ঘটনাটি ডিবি পুলিশ অবগত হওয়ার পর এর সাথে জড়িত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে ১২ জন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়। তাদের কাছ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। ঘটনার দিনই খিলক্ষেত থানাধীন লা মেরিডিয়ান হোটেলের কাছ থেকে একটি কালো রংয়ের হাইয়েস মাইক্রোবাস থেকে ট্রাংকসহ ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। ১১ মার্চ বনানী থেকে সানোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ১ কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা, ১৩ মার্চ ভাটারা থানাধীন জোয়ার সাহারায় মিলনের কাছ থেকে ৩২ লাখ ৪৭ হাজার, দক্ষিণ খানের নর্দায় আকাশ ও সাগরের কাছ থেকে ১ কোটি ৭ লাখ, বনানী কড়াইল বস্তি থেকে নিজাম উদ্দিনের কাছ থেকে ৪৮ লাখ ৭ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। ১৪ মার্চ নেত্রকোনার দূর্গাপুর থানাধীন পূর্ব বাকল জোড়া গ্রামের মিলনের বাড়ি থেকে ১০ লাখ, আকাশ আহমেদের দেখানো মতে খিলক্ষেত থানাধীন একটি গ্যারেজ থেকে ২০ লাখ, ১৭ মার্চ পল্লবী থানাধীন সাগুপ্তাস্থ শিশিরের রুম থেকে ৬ লাখ, ১৮ মার্চ সাভার থানাধীন হেমায়েতপুর শিশিরের বোনের বাসা থেকে ৮১ লাখ ৫০ হাজার, ২০ মার্চ খিলক্ষেত থানাধীন আকাশ আহমেদ বাবুলের দেখানো মতে বাসা থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার, ২১ মার্চ শাহ আলী থানাধীন মিরপুর-১ থেকে তার খালাতো শ্যালিকার কাছ থেকে ৫ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা, ৩০ মার্চ গোপালগঞ্জ থানাধীন হরিদাসপুর থেকে হাবিবুর রহমানের বাড়ির নিচ থেকে ৬ লাখ, ময়লার স্লাব থেকে ৫ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।
২০২৩ সালের ৯ মার্চ একটি সিকিউরিটি কোম্পানির গাড়িতে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাভার ইপিজেডের ডাচ বাংলা ব্যাংকের বুথে রাখার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। রাজধানীর উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে সশস্ত্র অবস্থায় ছিনতাইকারীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় দিনগত রাতে মানি প্ল্যান্ট লিঙ্ক প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালক আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে তুরাগ থানায় মামলা দায়ের করেন।
ঢাকা/টিপু
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ১০ ল খ ৫ হ জ র গ র প ত র কর ২০২৩ স ল র কর মকর ত র রহম ন ১১ ক ট অবস থ তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
৭৮০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে পূবালী ব্যাংক
বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংক ২ হাজার কোটি টাকার রেকর্ড পরিচালন মুনাফা করলেও বছর শেষে ব্যাংকটির নিট মুনাফা হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়নি। গত বছর শেষে পূবালী ব্যাংকের নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৭৮০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছিল ৬৯৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির মুনাফা ৮২ কোটি টাকা বা প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদনের পাশাপাশি গত বছরের জন্য লভ্যাংশও অনুমোদন করা হয় গতকালের এই সভায়। গত বছরের জন্য ব্যাংকটি ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যার মধ্যে সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ। ২০২৩ সালেও ব্যাংকটি একই হারে শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দিয়েছিল।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে পূবালী ব্যাংক ঋণের সুদ থেকে ১ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা আয় করেছে। বিনিয়োগ, কমিশন, মুদ্রা বিনিময় ও ব্রোকারেজ থেকে আয় করেছে ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। তাতে সব মিলিয়ে আয় হয় ৪ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। বিদায়ী বছরে বেতন-ভাতাসহ নানা খাতে খরচ হয় ১ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। ফলে পরিচালন মুনাফা হয় ২ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। ব্যাংকটি বিদায়ী বছরে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে ৯৬১ কোটি টাকা। এরপর কর পরিশোধের পর নিট বা প্রকৃত মুনাফা হয় ৭৮০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় আমরা চাহিদার বেশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এই পরামর্শ দিয়েছে। খেলাপির তুলনায় বেশি সঞ্চিতি রাখার মাধ্যমে ব্যাংকটির ভিত্তি মজবুত করা হয়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে পূবালী ব্যাংকের আমানত বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার কমে নেমে এসেছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এখন ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। আর কর্মীর সংখ্যা ১০ হাজার ৬৭৮। সারা দেশে ৫০৮টি শাখা ও ২২৭টি উপশাখা রয়েছে ব্যাংকটির। বর্তমানে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি নেটওয়ার্ক পূবালী ব্যাংকের।