নিন্দার বিবৃতিতে গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে না
Published: 19th, March 2025 GMT
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি চূড়ান্তভাবে বাতিল করে গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক গণহত্যা পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। রাতারাতি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একের পর এক হামলা শুরু করে। যার ফলে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫৬২ জন আহত হয়েছেন।
উদাহরণ দেওয়া যাক। জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টার্ক ঘোষণা করেছেন, ইসরায়েলি আক্রমণ ‘ট্র্যাজেডির ওপর ট্র্যাজেডি যোগ করবে’। আর ‘ইসরায়েল সামরিক শক্তি প্রয়োগ বাড়ালে ইতোমধ্যে বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর দুর্দশা চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে।’
নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জোনাস গাহর স্টোর একমত– ইসরায়েলি আক্রমণ গাজার জনগণের জন্য ‘একটি বড় ট্র্যাজেডি’। তাদের অনেকেই ‘তাঁবুতে ও ধ্বংসাবশেষে দিনযাপন করে।’ তাঁর পক্ষ থেকে ডাচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাসপার ভেল্ডক্যাম্প এক্স-এ মতামত দিয়েছেন, ‘মানবিক সাহায্য অবশ্যই অভাবীদের কাছে পৌঁছাতে হবে এবং সব শত্রুতার স্থায়ী নিরসন করতে হবে।’ সুইজারল্যান্ড ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে ফিরে আসা’র আহ্বান জানিয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র গাজায় নতুন করে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। দেশটির পক্ষ থেকে একটি অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, যারা শুরু থেকেই গণহত্যাকে সহায়তা ও উস্কানি দিয়ে আসছে। প্রথমে জো বাইডেন প্রশাসনের অধীনে এবং এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই কাজটি করে যাচ্ছেন।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট নিশ্চিত করেছেন, সর্বশেষ হামলা নিয়ে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শ করেছে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প ‘স্পষ্ট করে দিয়েছেন’– হামাস ও ‘যারা কেবল ইসরায়েলকেই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকেও ভয়ংকর করে তুলতে চায়, তাদের সবাইকে এর মূল্য দিতে হবে।’ হামাসের প্রতি ট্রাম্পের পূর্ববর্তী হুমকির ব্যাখ্যা করে লিভিট সতর্ক করে বলেছেন, ‘সমগ্র নরক ভেঙে পড়বে।’
তবুও যে কোনো বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ড অনুসারে, গাজা উপত্যকায় ইতোমধ্যে নরক ভেঙে পড়েছে। দৃঢ় মার্কিন সহায়তায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৮ হাজার ৫৭৭ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যখন ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে একটি দুর্বল যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। সরকারি সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে গাজায় মৃতের সংখ্যা প্রায় ৬২ হাজারে পৌঁছেছে। এ ছাড়া সব জায়গায় ধ্বংসস্তূপের নিচে হাজার হাজার নিখোঁজ ফিলিস্তিনিকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গাজা দৃশ্যত ইসরায়েলি বোমা বর্ষণ থেকে কিছুটা মুক্তি পেলেও, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও চুক্তি লঙ্ঘন অব্যাহত রেখেছে। সর্বোপরি যুদ্ধবিরতি কখনও ইসরায়েলের কৌশল ছিল না।
মার্চের গোড়ায় যখন ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় সব মানবিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়, যা জোরপূর্বক অনাহার ও একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধের সমান একটি কৌশল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য বন্ধ করার জন্য মূল হোতাদের চিহ্নিত না করে হামাসকে দায়ী করে, যা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নও হামাসের নিন্দা করে ‘গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ের সম্প্রসারণ মেনে নিতে অস্বীকৃতি’র অভিযোগ তোলে।
যেহেতু ইসরায়েল সরাসরি চুক্তির শর্তাবলি পরিবর্তন করেছে, বাস্তবে এটি হামাসের ‘অস্বীকৃতি’ ছিল না। বরং ইসরায়েল একতরফাভাবে গোলপোস্টগুলো সরিয়েছে, যেমনটি তারা বারবার করেছে। পরবর্তী সময়ে ইইউ উল্লেখ করেছে, ইসরায়েলের ‘গাজায় সব মানবিক সাহায্য প্রবেশ বন্ধ করার সিদ্ধান্তের ফলে আশঙ্কাজনক মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।’ এত কিছুর পরও সব দোষ হামাসের। যখন ইসরায়েলের নতুন করে বর্বরতার নিন্দা শোনা যাচ্ছে, তখন এটা বোঝা কঠিন নয়– কেন ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আপত্তিগুলো কম গুরুত্ব দেবে। দিন শেষে গাজায় ‘ট্র্যাজেডি’ বন্ধ করার জন্য এই আনুষ্ঠানিকতা ও আবেদন ইসরায়েলের স্বেচ্ছাচারিতা ও গণহত্যা বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না।
ইসরায়েলি সন্ত্রাসে আজকের হতাহতের মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছে। ইসরায়েল গাজা উপত্যকার বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন করে জোরপূর্বক ভিটে ছাড়ার আদেশ জারি করেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রক্তদানের জন্য জরুরি আবেদন জারি করেছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, যুদ্ধবিরতি বহাল রাখা নির্বিঘ্নে উপেক্ষা করা গেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য আরও একটি সুবিধা রয়েছে। তিনি বর্তমানে জালিয়াতি, ঘুষ ও বিশ্বাস ভঙ্গের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে তিনটি দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি। আজ টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, নেতানিয়াহুর নির্ধারিত সাক্ষ্য গ্রহণ ‘গাজায় আকস্মিক হামলা চলমান থাকায় বাতিল’ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মতে, গাজায় নতুন করে অভিযান পরিচালনা নিয়ে সরকারকে ‘জরুরি নিরাপত্তা পরামর্শ’ পরিচালনা করতে সক্ষম করে তোলার জন্য আইন কর্মকর্তারা এই বাতিলকরণকে অনুমোদন করেছেন। গাজা উপত্যকায় আবারও বর্বর ট্র্যাজেডি শুরু হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে এটি বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানানো নিজেই এক বর্বর ট্র্যাজেডি।
বেলেন ফার্নান্দেজ: আলজাজিরার কলামিস্ট; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ন ইসর য গণহত য ত ন কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।
সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।
পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।
বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।
এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)