ডাকাতের হামলায় নিহত গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মাটি ব্যবসায়ী মো. সজিব হোসেনের (৩৮) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের গাবচালা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে। এর আগে ময়নাতদন্ত শেষে সজিবের মরদেহ সেখানে পৌঁছলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কফিন ছুঁয়েই মূর্ছা যান তাঁর বাবা ও স্ত্রী। দুই নাবালক ছেলেকে সেখানে অনবরত কাঁদতে দেখা যায়। 
গাবচালা গ্রামের মুক্তার আলীর ছেলে সজিব মাটির ব্যবসা করেন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আরেক মাটি ব্যবসায়ী রয়েল হোসেনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে হাটুরিয়াচালা এলাকার নির্জন স্থানে তারা ডাকাতের কবলে পড়েন। ১০ থেকে ১৫ সশস্ত্র ডাকাত তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় রয়েল দৌড়ে পালিয়ে যান। কিন্তু সজিবকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে ডাকাতরা। 
রয়েলের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে গ্রামবাসী চারদিক থেকে ডাকাতদের ঘেরাও করে। এ সময় দুই ডাকাতকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়। আহত সজিব ও রয়েলকে সফিপুর মডার্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক সেখানেই সজিবকে মৃত ঘোষণা করেন। দুই ডাকাতকে অচেতন অবস্থায় পুলিশ কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। 
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে সজিবের মরদেহ গ্রামে নেওয়া হয়। সেখানেই তাঁর বাবা মুক্তার আলী ও স্ত্রী শারমিন আক্তার কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সজিবের ছেলে সোয়াদ হোসেন ও নার্সারির ছাত্র দিদার হোসেন বাবার কফিন ধরে কাঁদতে থাকে। 
শারমিন বেগম বলেন, ‘দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়েই আমার সংসার। স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে ও নৃশংশভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ হত্যাকাণ্ডের মামলা না নিয়ে নিয়মিত মামলা দিয়েছে।’ যারা পরিকল্পিতভাবে সজিবকে হত্যা করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান শারমিন। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি তোলেন সজিবের বাবা মুক্তার আলী। 
এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে আটক ডাকাত দলের সদস্য সোহেল রানা ও মিজানুর রহমানকে নিয়মিত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মিজানের বাড়ি বগুড়ার শেরপুর থানাধীন হাটগাড়ী গ্রামে। মিজানুর দিনাজপুরের বিরামপুর থানাধীন মহেশপুর গ্রামের বাসিন্দা। দু’জনই কালিয়াকৈরের বাড়ইপাড়া এলাকার আনোয়ার হোসেনের বাড়ির বাড়াটিয়া। তারা দিনে পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করে, রাতে পিকআপ ভ্যান নিয়ে আশপাশের বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতি করে। কেউ বাধা দিলে তাকে কোপাতেও দ্বিধা করে না তারা।
কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াদ মাহমুদ জানান, এ ঘটনায় থানায় নিয়মিত মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার দু’জনকে আদালতের মাধ্যমে গাজীপুর জেলহাজতে পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। 

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ