জর্জ ফোরম্যান: কাঠমিস্ত্রি থেকে কিংবদন্তি বক্সার
Published: 23rd, March 2025 GMT
এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো তিনি শুধুই ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা। যার নামে বিশ্ববিখ্যাত কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স ব্র্যান্ড ‘জর্জ ফোরম্যান গ্রিল’ রয়েছে। তবে গত শতকের বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে তিনি কেবলই কিংবদন্তি এক হেভিওয়েট বক্সার। যিনি কিনা দরিদ্রতা জয় করে বক্সিং রিংয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠীর মুখ হিসেবে। দু’বার বিশ্বজয়ী হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ও অলিম্পিক পদক জয়ী সেই বক্সার জর্জ ফোরম্যান এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন কাল।
শুক্রবার রাতে পরিবারের পক্ষ থেকে ৭৬ বছর বয়সী ‘বিগ জর্জ’ খ্যাত বক্সারের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। তাঁর অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রামে ঘোষণা আসে, ‘আমাদের হৃদয় আজ বিক্ষিপ্ত। গভীর শোকের সঙ্গে আমরা আমাদের প্রিয় জর্জ এডওয়ার্ড ফোরম্যান সিনিয়রের প্রয়াণের খবর জানাচ্ছি। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত যাজক, একজন দয়ালু স্বামী, একজন প্রিয় বাবা।’
জীবনের শেষ সময়ে অর্থের প্রাচুর্যের মধ্যেই কেটেছে তাঁর। তবে প্রথম জীবনে প্রচণ্ড দরিদ্রতার মধ্যেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে টেক্সাসে তাঁর জন্মের পর পরই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ছয় ভাইবোনের সংসারে স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। সেই সময়ে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ১৬ বছর বয়সে জেল থেকে বেরিয়ে মায়ের কাছেই আবদার করেন স্কুলে যাওয়ার।
আমেরিকায় তখন সরকারি সহায়তায় অসহায় ছেলেমেয়েদের জন্য ভোকেশনাল কিছু কোর্স চালু করেছিল। সেখানেই কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখেন। কখনও রাজমিস্ত্রির কাজও করতেন ফোরম্যান। এভাবেই কিছুদিন যাওয়ার পর টেক্সাস থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে বক্সিংয়ের টানে পড়ে যান। শুরুটা অ্যামেচার হিসেবেই হয়েছিল তাঁর। তবে রিংয়ে তাঁর ক্ষিপ্রতা আর শক্তি দেখে পেশাদার রিংয়ে নিজের জায়গা করে নেন। গত দশকের ষাট ও সত্তর দশকে বক্সিংয়ে নাম ছড়িয়ে পড়ে ফোরম্যানের।
১৯৭৩ সালে আরেক কিংবদন্তি জো ফ্রেজিয়ারের বিপক্ষে প্রথম হেভিওয়েট টাইটেল জিতে নেন ফোরম্যান। মাত্র দুই রাউন্ডেই ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রেজিয়ারকে নকআউট করে দেন। তার আগে ১৯৬৮ মেক্সিকো অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতেন। সেই সময় ক্রীড়া বিশ্বে আলোড়ন তোলা এক ইভেন্ট আয়োজন করা হয় ফোরম্যান ও মোহাম্মদ আলির সঙ্গে। বর্তমানের কঙ্গোতে আয়োজিত সেই হেভিওয়েট লড়াইয়ের নাম দেওয়া হয় ‘রাম্বল ইন দ্য জঙ্গল’। ঐতিহাসিক সেই লড়াইয়ে তিনি তাঁর প্রথম বিশ্ব টাইটেল হারান আলির কাছে। জিমি ইয়াংয়ের কাছে পরাজিত হয়ে ১৯৭৭ সালে রিং থেকে অবসরের ঘোষণাও দেন। ফিরে আসেন তারও ২২ বছর পরে ১৯৯৪ সালে। মাইকেল মুরারকে হারিয়ে ফিরে পান তাঁর হেভিওয়েট টাইটেল।
বছর পঁয়তাল্লিশে এসেও এভাবে রিংয়ে ফিরে চ্যাম্পিয়ন হওয়টা অনুপ্রাণিত করেছিল অনেককে। তাঁর সেই কাহিনি নিয়েই হলিউডে সিলভেস্টার স্ট্যালোনের বিখ্যাত ‘রকি বলবায়ো’ সিনেমা নির্মিত হয়। ৮১ ম্যাচের ক্যারিয়ারে মাত্র ৫ ম্যাচে হেরেছিলেন ফোরম্যান। ৭৬ ম্যাচে জয়ের ক্ষেত্রে ৬৮ ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে নকআউট করেন। জয়ের হিসাবে যা ছিল মোহাম্মদ আলির চেয়ে দ্বিগুণ। আলি পৃথিবী ছেড়েছেন তাও প্রায় ৯ বছর হতে চলল। এবার র্যাম্বাল ইন দ্য জঙ্গলের আরেক কিংবদন্তিও বিদায় নিলেন।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে প্রপাগান্ডার সয়লাব
ট
১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন তৎকালিন বাকশাল সরকার চারটি পত্রিকা সরকারি ব্যবস্থাপনায় রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। এতে হাজারো সাংবাদিক রাতারাতি বেকার হয়ে দুঃসহ জীবনে পতিত হন। জনগন সঠিক তথ্য ও বস্তুনিষ্ঠ খবর জানা থেকে বঞ্চিত হয়। গোটা দেশে যেন অন্ধকার নেমে আসে। জবরদস্তিমূলকভাবে তখন সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীদেরকে বাকশালে যোগদানে বাধ্য করা হয়।
অনেক সাংবাদিক সেদিন জীবন-জীবিকার ভয়ে বাকশালের ফরম পূরণ করেন। তাই সংবাদমাধ্যম ও বাক-স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত। আজ দিবস আর কালো নেই। তথ্য প্রবাহের যুগে এখন মন খূলে লেখা যায়, প্রচার করা যায়। বিশেষ করে গেলো বছরের ৫ আগষ্টে ফ্যাসিবাদের পতনের পর গনমাধ্যমে অনেকটা স্বাধীনতা বেড়েছে। গণভবনের তেল তেলা তোষামদি প্রশ্ন এখন আর চলে না। বলা চলে গণমাধ্যম বিগত ১৬ বছরের চাইতে এখন বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। তবে একটা প্রশ্ন রয়েই গেছে তা হলো পেশাদার কিছু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে । এসব মামলা বেশির ভাগই আক্রোশের কারনে হয়েছে। বাদীকে না জানিয়ে একটা মহল মামলায় সাংবাদিকের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটা নিন্দনীয়। একজন সাংবাদিক মানুষ খুনের মামলার আসামী এটা মেনে নেয়া দুস্কর ।
৫ আগষ্টে আগে যারা তোষামদি করতো , সঠিক সংবাদ লিখতে কিংবা প্রচার করতো পারতো না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দোহাই দিয়ে যারা গনমাধ্যমের কন্ঠ রোধ করে রেখেছিল তাদের ভয়ে আতংকে থাকতো। তাদের অনেকে এখন গনমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে মিথ্যা প্রপ্রাগান্ডা চড়াচ্ছে। গনহত্যাার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি একটা দলের প্রতি বিশেষ দরদ দেখিয়ে মিথ্যা তথ্য চড়াচ্ছে। অনেকে তাদের ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। যাচাই বাছাই ছাড়া মিথ্যা তথ্য শেয়ার করছে। তাদের এখনই থামা দরকার। সত্য প্রকাশ করা একজন সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব । এ পেশাগত দায়িত্বের কেউ অপব্যবহার করলে মুলত তিনিই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। একসময় তার মিথ্যা সংবাদ পরিবেশের কারনে কেউ তার পাশে আর থাকবেন না। তাকে পেশাদার সাংবাদিক নয়, একজন দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আস্তুাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
পেছনের কথায় ফিরে আসি, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদ পত্রের কালো দিবস পেরিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভাবনীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর সাংবাদিকদের লেখার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করেন।
জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সব কালাকানুন শিথিল করে দেশের সব জায়গা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশে উৎসাহ প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা সরকারেরই দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করতেন। তিনি রাজশাহী থেকে ‘দৈনিক বার্তা’ নামে একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এ পত্রিকা ঘিরে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। বহু সাংবাদিকের কর্মসংস্থান হয়।ডিক্লারেশনের শর্ত শিথিল করার কারণে সে সময় ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয়, জেলা এমনকি থানা পর্যায় থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। এসব পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে জিয়াউর রহমান সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টননীতিও শিথিল করেন। বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বণ্টন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন। একই সঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপনের ৬০ ভাগ ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় এবং বাকি ৪০ ভাগ মফস্বল থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে সারা দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনায় নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই প্রথম টার্গেট করে সংবাদমাধ্যমকে। সর্বশেষ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেও একই পথে হাঁটে দলটি। গত প্রায় ১৫ বছরে আমার দেশ, দিনকাল, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, সিএসবিসহ জনপ্রিয় সংবাদপত্র, বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে কয়েক হাজার সাংবাদিককে বেকারত্বের মুখে ঠেলে দিয়েছিল । ৬০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে। একের পর এক কালাকানুন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। কথায় সাংবাদিক গ্রেফতার তখন নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সাংবাদিক পরিচয়ে একদল চাটুকার আওয়ামীলীগের দু:শাসনের মদদ দিয়ে জাতির উপর জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়েছিল। ছাত্রজনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ পতনে মানুষ যেমন স্বস্তি ফিরে পেয়েছে তেমনি গণমাধ্যম ফিরেছে অবাধ স্বাধীনতায়।
লেখক : সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)