প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “পুরো বিশ্ব বুঝে গেছে, আমরা জাতি হিসেবে সততার পরিচয় বহন করি না। এটা শুধু জাতীয় কলঙ্কের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটা আত্মঘাতী বিষয়। দেশবাসীর মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায় আমরা দুর্নীতিমুক্ত হই, কারণ তারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে চায়।”

তিনি বলেন, “দুর্নীতিমুক্ত হতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই চলবে না। দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের কোনও গতি নেই।”

মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।

আরো পড়ুন:

জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা: ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন

অর্থনৈতিক অবস্থা ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে: প্রধান উপদেষ্টা

ড.

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা সীমাহীন দুর্নীতি। স্বৈরাচারী সরকার এই দুর্নীতিকে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে নিয়ে গেছে। দুর্নীতির ফলে শুধু যে সবকিছুতে অবিশ্বাস্য রকম ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই না, এর ফলে সরকার ও জনগণের সব আয়োজন বিকৃত হয়ে যায়। সরকারের লক্ষ্য, নীতিমালা, প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন, সরকারি কর্মকর্তাদের দায় দায়িত্ব যা কিছু কাগজে লেখা থাকে, তার সবকিছু অর্থহীন হয়ে যায়। দেশ চলে অলিখিত আয়োজনে। সরকারকে চলতে হয়, ব্যবসায়ীকে চলতে হয়, শিল্পপতিকে চলতে হয়, বিনিয়োগকারীকে চলতে হয়, দেশের সব নাগরিককে এই অলিখিত নিয়মে চলতে হয়।”

তিনি বলেন, “নাগরিককে এই অদৃশ্য জগতের সঙ্গে মোকাবিলা করে টিকে থাকার বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার সাধনা করতে হয়। দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকা এবং সাফল্য অর্জনের জন্য একটা নতুন ভাষা আয়ত্ত করতে হয়। চারদিকে কী শব্দ বলা হচ্ছে, কাগজে কী লেখা হচ্ছে-তা মনে মনে দ্রুত অনুবাদ করে তার মর্মার্থ বুঝে নিতে হয়, তা নাহলে দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় মুশকিল হলো-এর কোনও অভিধান নেই। কারণ ব্যক্তি বিশেষে, স্থান বিশেষে, পরিস্থিতি বিশেষে এর অর্থ ক্রমাগতভাবে পাল্টে যায়।”

অন্তর্বর্তী সরকার সব কাজ দুর্নীতিমুক্ত করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই সরকারের মেয়াদকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার চেষ্টার পাশাপাশি আগামী দিনেও দেশের নাগরিককে যেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখতে পারি, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুর্নীতি ও হয়রানি রোধে আমরা একটা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকারের সঙ্গে দৈনন্দিন, মাসিক বা বার্ষিক রুটিন কাজের জন্য যেন কোনও নাগরিককে সশরীরে কোনও সরকারি অফিসে উপস্থিত হতে না হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধের অংশ হিসেবে সরকারি সব অফিসে ই-ফাইলিং চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ই-ফাইলিং ব্যবস্থা চালু হলে দুর্নীতি কমে আসবে। এতে করে কোন অফিসের কোন ডেস্কে কোন ফাইল আটকে আছে, তা সহজেই জানা যাবে।”

সরকারি যতগুলো কার্যক্রমে অনলাইন সেবা চালু করা সম্ভব সবখানেই এ সেবা চালুর বিষয়ে সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে অসহায় নাগরিকের টুঁটি চেপে ধরে অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। টাকার লেনদেন ও ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। সেটা থেকে নাগরিকদের বাঁচানোর জন্য আমরা বদ্ধপরিকর। অনলাইনে সেবা পাওয়ার পদ্ধতিটি আরো কীভাবে সহজ করা যায়-এ ব্যাপারে আমাদের কাছে পরামর্শ জানিয়ে লিখুন, ই-মেইল করুন। আপনি বা আপনার পরিবারের যে কেউ এই সেবা বাণিজ্যিকভাবে দিতে চাইলে, প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পৃথিবীর যেকোনও স্থান থেকে এই সেবা নিতে পারবেন।”

বিগত সরকারের আমলে ভিন্নমতকে দমন করার জন্য মিথ্যা মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন,  “বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই বাছাই করে আমরা এসব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছি। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় দায়ের করা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলোর মধ্যে সারা দেশে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ২৯৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্য সব হয়রানিমূলক মামলাও ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এছাড়া এ পর্যন্ত সাইবার সিকিউরিটি আইনের অধীনে বিচারাধীন স্পিচ অফেন্স সংক্রান্ত ৪১৩টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই আইনটি অবিলম্বে বাতিল করে নাগরিক বান্ধব সাইবার সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “মানুষের ভোগান্তি রোধেও আমরা আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি। জিডি করার সময় স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য এখন আর থানায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা অনলাইনেই করা যাবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হয়রানি লাঘব করা হয়েছে। সংশোধিত বিধিমালার আলোকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না থাকলেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তির পাসপোর্টে নো ভিসা রিকয়ার্ড স্টিকার থাকলে, কিংবা জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয় পত্র থাকলেই-তিনি বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবেন।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পর বিমানের টিকিট কেনার পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে নিয়ে যাওয়ায় ফলে বিমানের টিকিটের দাম শতকরা ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ কমে গেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচের প্রবাসী ভাই-বোনেরা এতে করে স্বস্তি পাচ্ছেন। এছাড়া অন্যান্য এয়ারলাইনে টিকিটের দামও কমে গেছে। নাগরিকদের হয়রানিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা প্রদানের জন্য সরকার ভূমি সেবা ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয় অনলাইনে ঘরে বসেই জমির খাজনা প্রদান, নামজারি, জমাখারিজ, খতিয়ান বা পরচা সার্টিফায়েড কপি ও মৌজা ম্যাপ বা নকশা প্রদানের কার্যক্রম চালু করেছে। এই পদ্ধতিতে ভোগান্তি, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অবসান হবে। বর্তমানে সারা দেশে পরীক্ষামূলকভাবে এই কার্যক্রম চালু হয়েছে। এগুলোকে ক্রমান্বয়ে আরো জনবান্ধব করে স্থায়ী রূপ দেওয়া হবে।”

তিনি বলেন, “এর লক্ষ্য হবে ক্রমাগতভাবে এসব দায়িত্ব সরকারের হাত থেকে নিয়ে সেবাদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেওয়া। গ্রামের স্কুল-কলেজ পাস করা ছেলে-মেয়েরা, গৃহিণীরা ঘরে বসে সারা দেশে এই সেবা দান করবে এবং অনেকে তাদের কৃতিত্বের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে পড়বে। তারা সারা দেশের গ্রাহকদের সেবা নিজের গ্রাম থেকেই প্রদান করবে।”

ঢাকা/হাসান/সাইফ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সরক র হয়র ন ম সরক র র র জন য ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

সাকিবের পথে হাঁটছেন মিরাজ

সাকিব আল হাসানের সঙ্গে নিজের তুলনাকে মেহেদী হাসান মিরাজ হয়তো উপভোগই করেন। কারণ, তাঁর স্বপ্ন সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা। সেই পথে বোধ হয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টেস্টে দেশে-বিদেশে সম্প্রতি ভালো করছেন। পাকিস্তানে দারুণ প্রশংসিত ছিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজে উভয় টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। সিলেটের হারের ম্যাচেও ১০ উইকেট ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নিয়ে সাকিব ও সোহাগ গাজীর কাতারে নাম লেখালেন। মূলত মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ব্যবধানে টেস্ট জেতা সম্ভব হয়। 

গতকাল শতকের ঘরে যেতে কম কসরত করতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে তো অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাসানের আউটের শঙ্কায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় শতকের দেখা পান তিনি। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল মিরাজের। গতকালের পারফরম্যান্স নিয়ে টাইগার এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় চেষ্টা করেছিলাম ২ রান নিয়ে ১০০ রানে যেতে। সেভাবে দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ডারের হাতে বল চলে গিয়েছিল (হাসি)। তার পর তো আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসান অনেক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তানজিমও ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তাইজুল ভাইও। এই তিনজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কারণ, ওদের জন্যই আমি ১০০ রান করতে পেরেছি।’ 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দাবি মিরাজের, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১০০ করেছিলাম, ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। অল্পের জন্য ৫ উইকেট হয়নি। হলে ভালো লাগত। ওই ম্যাচ হেরেছিলাম এই মাঠে। সে জিনিসটা মাথায় ছিল। ভালো লাগছে ম্যাচটি জিতেছি।’ মিরাজ ১৬২ বলে ১১টি চার ও একটি ছয় মেরে ১০৪ রান করেন। ২১ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন পাঁচ উইকেট।

টেস্টে এ রকম অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাংলাদেশে আর দু’জনের আছে। সাকিব আল হাসান দু’বার ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে আর ২০১৪ সালে খুলনায়। সোহাগ গাজী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার করেন চট্টগ্রামে। সেই মাইলফলক ছোঁয়া মিরাজকে সম্প্রতি অলরাউন্ডার ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়। সাকিবের বিকল্প ভাবা হয় তাঁকে এখন। 

এ ব্যাপারে মিরাজের অভিমত, ‘দেখেন একটা জিনিস, যখন সাকিব ভাই ছিলেন, ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল। যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।’ 

সিলেটে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট করে নিয়েও দলকে জেতাতে পারেননি মিরাজ। চট্টগ্রামে সাদমান, তাইজুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ম্যাচ জয়ের নায়ক হন। এই সাফল্য নিয়ে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম ম্যাচ হারার পর যেভাবে কামব্যাক করেছি, এটা খুবই দরকার ছিল। আমাদের সবাই ভেবেছিল, আমরা ভালো করব।’ মিরাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোচিং স্টাফ ও সতীর্থের কাছে। আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা পুরো দলের।

সম্পর্কিত নিবন্ধ