নিরাপত্তা ও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হোক
Published: 30th, March 2025 GMT
এবার ঈদুল ফিতরের ৯ দিনের লম্বা ছুটি পড়েছে। ঈদের ছুটিতে মানুষ শহর ছেড়ে যান পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ উদ্যাপন করতে। এবার লম্বা ছুটি থাকায় অনেকে বেরিয়ে পড়বেন বেড়াতেও। বিগত লম্বা ছুটিগুলোর অভিজ্ঞতা এমনটিই বলে। ফলে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বাড়তি ভিড় হবে বলে পর্যটন–সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
দেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষের সবচেয়ে পছন্দের স্থান কক্সবাজার। হোটেল–মোটেলমালিকেরা জানাচ্ছেন, গত বছর ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিতে ৯ লাখ ৭০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেছিলেন কক্সবাজারে। এবারের ঈদের ছুটির দ্বিতীয় দিন থেকে হোটেল–মোটেলগুলো বুকিং হয়েছে। ঈদের ছুটি ৫ এপ্রিল পর্যন্ত হলেও ১২ এপ্রিল পর্যন্ত টানা কক্ষ বুকিং রয়েছে বেশির ভাগ হোটেলে। ইতিমধ্যে শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজে ৫৫ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। অবশিষ্ট কক্ষগুলোও ৩১ মার্চের আগে বুকিং হয়ে যাবে।
পাঁচ শতাধিক হোটেলের দৈনিক ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৮৭ হাজার। তবে এবারও গতবারের চেয়ে বেশি, অন্তত ১২ লাখ পর্যটক সমাগম হতে পারে বলে ধারণা করছেন হোটেল–মোটেলমালিকেরা। ফলে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পর্যটকের চাপ তৈরি হওয়ায় থাকা–খাওয়ার চরম দুর্ভোগ হতে পারে। আর এমন পরিস্থিতি কক্সবাজারের ক্ষেত্রে নতুন নয়। শুধু কক্সবাজার নয়; পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে এবার পর্যটকের বিপুল চাপ দেখা দিতে পারে।
পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভিড় বেশি হলে প্রতারণার ঘটনাও বেশি ঘটে। ফলে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি হোটেল–মোটেল, রেস্তোরাঁ এবং যানবাহনে যাতে অতিরিক্ত টাকা আদায় না করা হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে প্রশাসনকে। আর অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ এড়াতে প্রশাসনের পদক্ষেপও জরুরি। পর্যটনকেন্দ্রের ধারণক্ষমতা অতিক্রম করলে স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করতে পারে। অনেকে পরিস্থিতি না বুঝে পর্যটনকেন্দ্রে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন। এতে সময়, অর্থ ও আনন্দ—সবকিছুই মাটি হয়ে যায়। প্রশাসন থেকে সচেতনতার বার্তা পেলে ঘুরতে যাওয়ার আগে মানুষের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সুবিধা হবে।
তা ছাড়া ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে পর্যটনকেন্দ্রের পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ ব্যাপারেও প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে পদক্ষেপ নিতে হবে। সচেতন হতে হবে আমাদেরও। সবার ঈদের ছুটি উদ্যাপন ও ঘোরাঘুরি নিরাপদ হোক, সেটিই কাম্য।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সেন্ট মার্টিন ভালো নেই, সেন্ট মার্টিনের মানুষ ভালো নেই
অমাবস্যা ও সমুদ্রের নিম্নচাপ একই সময় হওয়ার কারণে উপকূলজুড়ে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। সেখানকার জনজীবনে দুর্ভোগ ও ক্ষতির পরিমাপ এতটা বেশি যে অনুমান করাও কঠিন।
প্রতিবছর বর্ষায় মোটামুটি দু-তিনটি ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু এত ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কখনো হয়নি। এত তাণ্ডব কখনো দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
২৬ ও ২৭ জুলাই সমুদ্রের নিষ্ঠুর লীলাখেলা দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্বীপের প্রায় চারপাশ থেকে হু হু করে ঢুকেছে সমুদ্রের পানি। অনেক দিন এমন পানির তোড় দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
দ্বীপে যা সামান্য কৃষিকাজ হয়, বিশেষ করে ধান চাষ ও সবজি চাষে এবার জলোচ্ছ্বাসের থাবা পড়েছে। লোনাপানি ঢুকে চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
সমুদ্রের পাড়ের বাড়ি ও দ্বীপের মাঝখানের নিম্নাঞ্চলে (স্থানীয় ভাষায় মরং বলে) সাগরের পানি ঢোকার কারণে অনেক এলাকায় পানি লবণাক্ত হয়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
অনেক বাড়ি ও রিসোর্ট সমুদ্রের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে।
দ্বীপে কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এবার জলোচ্ছ্বাস পূর্ণমাত্রায় আঘাত করতে পেরেছে! ফলে পুরোপুরি অনিরাপদ দ্বীপটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।
দ্বীপের ভাঙন শুরু মূলত ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে। ওই দুই ঘূর্ণিঝড় দ্বীপের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ আশপাশের পাথরের স্তূপ নড়বড়ে করে দেয়। ফলে দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের স্রোত সমুদ্রগর্ভের পরিবর্তে সৈকত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়।
এতে দ্বীপের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব পাশে ব্যাপক ভাঙন হয়। উত্তর পাড়া ও ডেইল পাড়া নামের দুটি পাড়া বিলীন হয়ে যায়। বাসিন্দাদের ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গুচ্ছগ্রাম করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?সেই ১৯৯১ সাল থেকে আজ অবধি দ্বীপের ভাঙন চলমান। কিন্তু কোনো বেড়িবাঁধ নেই। আবার নতুন করে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণেও সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়া ঝোপ উজাড় হয়েছে। এতে দ্বীপের ঢেউ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মুরব্বিদের কথায় এবারের মতো জলোচ্ছ্বাস তাঁদের জীবনে দেখেনি। তাঁরা দ্বীপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। আদৌ দ্বীপে অদূর ভবিষ্যতে বসবাস করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা মনে করেন, এ রকম আর দু–তিনটি জলোচ্ছ্বাস সহ্য করার মতো শক্তি সেন্ট মাটিনের নেই। দ্রুত স্রোতপ্রতিরোধী বাঁধ নির্মাণ করতে না পারলে সেন্ট মার্টিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে!
দ্বীপবাসী মনে করে, একটা টেকসই বেড়িবাঁধ যেটা সচরাচর উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধের মতো না। কারণ, এখানে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান। ফলে কাছিমের ডিম দিতে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সেভাবে সৈকত থেকে সমুদ্রের দিকে লম্বালম্বি করে বাঁধ দিয়ে স্রোত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিতে হবে। দক্ষিণ ভারতে এ রকম বাঁধ অনেক কার্যকর প্রমাণিত।
পাশাপাশি দ্বীপের মানুষের আয়ের বিকল্প কর্মসংস্থান বা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে পর্যটননির্ভরতা কমাতে হবে। একটা আবাসন নীতিমালা করে দ্বীপে পরিবেশবান্ধব বাড়ি ও ইকো রিসোর্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। যত্রতত্র রিসোর্ট করা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত রিসোর্ট কমিয়ে ফেলতে হবে আর যেসব রিসোর্টের বিরুদ্ধে আইনি বাধা আছে, সেগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।
সৈকত, জঙ্গল, খাল ও জলাভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বা ক্ষতিপূরণ হলেও সৈকতের ১০০ ফুট পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সে জমিতে বনায়ন করতে হবে। ঝাউগাছের পরিবর্তে ভাঙনপ্রতিরোধী কেয়াগাছ, নারকেল ও সাগরলতা রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?
তৈয়ব উল্লাহ, আন্দোলনকর্মী ও সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা