রাজধানীর গু‌লিস্তা‌নে এক‌টি জুতার কারখানার কাজ কর‌তেন জ‌হিরুল ইসলাম রা‌সেল। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবি‌রোধী ছাত্র আ‌ন্দোলন চলাকা‌লে পুলি‌শের গু‌লি‌তে নিহত হন ‌তি‌নি। এরপর অ‌ভিভাবকশূন্য হ‌য়ে প‌ড়ে রা‌সে‌লের বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর ছোট্ট মে‌য়ে জুমা। রা‌সেল না থাকায় ঈ‌দের আনন্দও নেই প‌রিবার‌টি‌তে।

রাসেলের মা মোরশেদা বেগম জানান, রাসেলের সা‌ড়ে তিন বছ‌রের মেয়ে জুমা এখ‌নও অ‌পেক্ষায় আ‌ছে তার বাবা ফি‌রে আস‌বে। তার জন্য ঈ‌দের নতুন জামা নি‌য়ে আস‌বে, সেই জামা প‌রে সে বাবার সঙ্গে ঈদগাহে যাবে। অথচ অবুঝ জুমা জা‌নে না যে, তার এই অ‌পেক্ষার প্রহর ফুরাবার নয়। কথাগু‌লো বল‌তে গি‌য়ে কান্নায় ভে‌ঙে প‌ড়েন রাসেলের মা।

ঈদের দিন সোমবার দুপু‌রে শহীদ জহিরুল ইসলাম রাসেলের পরিবারের খোঁজ-খবর নি‌তে তার বা‌ড়ি‌তে যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। উপজেলার ইউসুফপুর ইউনিয়নের ম‌হেশপুর গ্রা‌মে রা‌সে‌লের বা‌ড়ি‌তে গে‌লে এমন হৃদয়বিদারক মুহূর্তের সৃ‌স্টি হয় সেখা‌নে।

রাসেলের শিশু মেয়ে জুমাকে কোলে নিয়ে ‌বেশকিছু সময় ব‌সে থা‌কেন হাসনাত। রাসেলের মা মোর্শেদা বেগম ও স্ত্রী জান্নাত ফেরদৌসের সঙ্গে নানা বিষ‌য়ে কথা বলার সময় তাদের হা‌তে নগদ অর্থ সাহায্য তুলে দেন হাসনাত।

জহিরুল ইসলাম রাসেল ম‌হেশপুর গ্রা‌মের মৃত শাহ আলম সরকারের একমাত্র ছেলে। সে ছৈয়দপুর কামিল মাদ্রাসার ফাযিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। বাবার অবর্তমা‌নে সংসা‌রের খরচ জোগা‌তে ঢাকায় একটি জুতার কারখানায় কাজ করতেন। বৈষম্যবি‌রোধী আ‌ন্দোলন চলাকা‌লে ৪ আগস্ট সকা‌লে গু‌লিস্তান এলাকায় পু‌লি‌শের গু‌লি‌তে শহীদ হন তি‌নি। সোমবার হাসনাত আব্দুল্লাহ তার নিজ গ্রাম উপ‌জেলার গোপালনগরে ঈদুল ফিতরের নামাজের পর শ‌হীদ রা‌সে‌লের বা‌ড়ি‌তে যান।

এর আগে তি‌নি উপ‌স্থিত মুসল্লিদের সঙ্গে ঈ‌দের শু‌ভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং ঈদগাহের পাশে গোপালনগর কেন্দ্রীয় কবরস্থান জিয়ারত ও স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। নামাজের পূর্বে হাসনাত আবদুল্লাহ সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।

এসময় হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর নতুন বাংলা‌দে‌শে আমার এলাকাবাসীর সঙ্গে ঈদুল ফিতরের নামায আদায় করতে পেরে ভাল লাগ‌ছে। গ্রামের মানুষ যে আমাকে এতো ভালোবাসেন ঈদগাহে না আসলে বুঝতে পারতাম না। জুলাই বিপ্লবে সারাদেশের মতো এই দেবিদ্বারেও অসংখ্য মানুষ ফ্যাসিস্টদের হাতে নির্মমভাবে খুনের শিকার হয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। সরকার এ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন কর‌তে কাজ করছে।’

তিনি ঐক্য ও সাম্যের দেবিদ্বার গড়ে তোলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তি‌নি একটি ফ্যাসিবাদ মুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত ক‌রেন। এসময় হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসন থেকে হাসনাত আবদুল্লাহর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ

১৮৮৬ সালের ১ মেÑএকটি দিন, একটি দাবি, আর হাজারো শ্রমিকের আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে রক্তাক্ত দাগ কেটে দিয়েছিল যে মুহূর্ত, তা আজ বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তখনকার দাবিটি ছিল স্রেফ ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের দাবি শুধু সময়
নয়Ñমর্যাদা, সুরক্ষা ও ন্যায্যতার প্রশ্নও।

এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য “শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে”Ñএ যেন সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বার্তা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, বরং তা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য এক যৌথ দিকনির্দেশনা।

বাংলাদেশের শ্রমচিত্র ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ, কৃষি ও নির্মাণ খাতে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিয়োজিত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে শ্রমনির্ভর খাত থেকে। কিন্তু যাঁরা এই অর্থনীতির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছেন, সেই শ্রমিকরা কি পেয়েছেন তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা?

দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও বহু শ্রমিক পান না ন্যূনতম মজুরি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা কিংবা ছুটি সংক্রান্ত মৌলিক সুবিধা। নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও জটিলÑযত্রতত্র হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব, কিংবা নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে না তোলার ফলে এই খাতেও স্থিতিশীলতা আসছে না।

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক: দ্বন্দ্ব নয়, দরকার সহমর্মিতা

এক সময় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক মানেই ছিল দ্বন্দ্ব, ধর্মঘট ও হুমকি। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছেÑসহযোগিতাই টেকসই উৎপাদনের চাবিকাঠি। মালিকপক্ষ যখন শ্রমিককে কেবল “ব্যয়” হিসেবে না দেখে “সম্পদ” হিসেবে  বিবেচনা করেন, তখন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। একইভাবে শ্রমিকও যদি বুঝেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মানে তার কর্মস্থলের স্থায়িত্বÑতাহলে দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের
ভিত্তি গড়ে ওঠে।

এই বিশ্বাস গঠনের জন্য প্রয়োজন তিনটি স্তম্ভ: 

নীতিগত স্বচ্ছতা Ñ ন্যায্য মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা দায়িত্বশীল মালিকপক্ষ Ñ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে উদ্যোগ সচেতন শ্রমিকশ্রেণি Ñ অধিকার আদায়ের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের মানসিকতা

নীতি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত ২০১৮ সংস্করণ অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে  অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেমন কৃষি, গৃহপরিচারিকা, গিগ-ওয়ার্কার) শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনও প্রায় উপেক্ষিত।

এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা বীমা, এবং পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হওয়া জরুরি। সরকার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলেও তা অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে’ দেশ গড়ার বার্তাটি যেন শুধুই স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এটি হোক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক বিনিয়োগ ও মানবিক বিবেচনার এক বাস্তব প্ল্যাটফর্ম।
প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও নতুন শ্রম বাস্তবতা

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শ্রমবাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ও গিগ-ইকোনমি অনেক চাকরি বিলুপ্ত করছে, আবার নতুন দক্ষতা চাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়, তাহলে  শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পুনঃস্কিলিং এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এখানে মালিক ও রাষ্ট্র উভয়ের উচিত হবে, শ্রমিককে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিনিয়োগ করা, কারণ দক্ষ শ্রমিক ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকে না।

মে দিবস: উৎসব নয়, দায়বদ্ধতার প্রতীক

মে দিবস কেবল লাল পতাকা হাতে শোভাযাত্রার দিন নয়, এটি আমাদের মানবিক চেতনার প্রতিফলন। যে শ্রমিক ঘাম ঝরিয়ে ভবন গড়ে, কৃষি জমি চষে, রপ্তানি পণ্য তৈরি করেÑতার জন্য আমাদের উচিত মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।

এবছর, আসুন আমরা সবাই রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকÑএকটি মানবিক, উৎপাদনশীল ও  শীদারিত্বভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যাই। শ্রমিকের হাতে গড়া এই বাংলাদেশ হোক তার জন্যই গর্বের জায়গা। 


লেখক পরিচিতি:

মীযানুর রহমান
সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক
মোবাইলঃ ০১৭৫৪১০৯০৭২
যোগাযোগ: : [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
  • মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ
  • বিদ্যালয়ের ১৮টি গাছ বিক্রি করলেন প্রধান শিক্ষক 
  • কর্ণাটকে ক্রিকেট খেলার সময় বচসা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা
  • দেশে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে চালুর দাবি 
  • রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডোর’ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন প্রেস সচিব
  • কানাডায় আবারও লিবারেল পার্টির সরকার গঠনের আভাস
  • আ.লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে
  • আ.লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে: ড. ইউনূস
  • অন্তর্বর্তী সরকারকে মানুষ এখনও ভালো সমাধান মনে করছে: আল জাজিরাকে