অনেকেই মনে করেন যে আমাদের স্বাধীনতা ছিনতাই হয়ে গেছে। মনে করাটা যে একেবারে অযৌক্তিক তাও বলবার উপায় নেই। মুক্তি তো পরের কথা, এমনকি স্বাধীনতাও খুব একটা দৃশ্যমান নয়। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ তো তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনা যদি ঘটেই থাকে, তবে কে করল ওই মর্মান্তিক কাজটা? কেউ কেউ বলেন, ছিনতাই করেছে মৌলবাদীরা।
দেখাই তো যাচ্ছে তাদের জঙ্গি তৎপরতা ক্রমবর্ধমান, কেউ নেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো; হয়তো সামনে এমন সময় অপেক্ষা করছে যখন লেজই বরং কর্তৃত্ব করবে মাথার ওপর, মৌলবাদীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজ ও রাষ্ট্রে। অন্যরা বলেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, স্বাধীনতা চলে গেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাতে। তারা এখন হর্তাকর্তা। সাম্রাজ্যবাদীরা পুঁজিবাদী; এবং পুঁজিবাদী ও মৌলবাদীদের ভেতর একটা আপাতদূরত্ব, বলা যায় প্রায় বৈরিতা থাকলেও অন্তরে তারা পরস্পর থেকে মোটেই দূরে নয়। উভয়ে গণবিরোধী, ব্যক্তিগত মালিকানায় ও মুনাফায় বিশ্বাসী এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের শত্রুপক্ষ। তাদের নিকটবর্তিতা প্রশ্নাতীত।
ওই যে উপলব্ধি, স্বাধীনতা ছিনতাই হয়ে যাবার, সেটা কি সঠিক? আরও একটি মৌলিক জিজ্ঞাসা অবশ্য দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতা কি সত্যিকার অর্থে এসেছিল, নাকি যা ঘটেছিল সেটি হলো ক্ষমতার হস্তান্তর। সাতচল্লিশের ‘স্বাধীনতাটা’ যে মোটেই স্বাধীনতা ছিল না, ছিল ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে-দেওয়া, ছেড়ে দিয়ে সেটি তুলে দিয়ে-যাওয়া তাদের অনুগত পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির হাতে, তা তো আজ আর মোটেই অস্পষ্ট নয়। একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকেরা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ক্ষমতা চলে এসেছে বাংলাদেশি শাসকশ্রেণির হাতে, সরাসরি না-হলেও তাকেও তো এক ধরনের ক্ষমতার হস্তান্তরই বলা চলে। ক্ষমতা যাদের কাছে যাবে বলে আশা ছিল তাদের কাছে যায়নি, যায়নি জনগণের কাছে, রয়ে গেছে ওই শ্রেণির হাতে।
সংখ্যার হিসাবে দল যতই হোক শ্রেণি কিন্তু একটাই, শাসকশ্রেণি। ওই শাসকশ্রেণির বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে, নানা রকম পোশাকে, এমনকি পরস্পরবিরোধী আদর্শের আওয়াজ তুলে ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করে। ওদের ভেতর পারস্পরিক সহনশীলতার অভাব রয়েছে, হিংস্রভাবে তারা একে অপরকে আক্রমণ করে। পারলে শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু এদের মূল আদর্শ ও লক্ষ্য একটাই। সেটি হলো ক্ষমতায় যাওয়া এবং সেখানে টিকে থাকা; আর ক্ষমতায় থেকে তারা যা করতে চায় সেটি হলো অবাধ লুণ্ঠন এবং ক্ষমতাকে যাতে স্থায়ী করা যায় সে-ব্যবস্থা গ্রহণ। তাদের ভেতর যে লড়াইটা সেটি ওই ক্ষমতা দখল ও ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে। সেটি তাদের রাজনীতি; এবং এ বিষয়ে তো সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই যে, ওই রাজনীতিই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশে রাজনীতির মূলধারা। বিশ্ব এখন গণমাধ্যমের (ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট) আওতাধীন।
গণমাধ্যম আসলে প্রচারমাধ্যম। বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম সম্পূর্ণরূপে শাসকশ্রেণির কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে রয়েছে; ফলে আমরা, সাধারণ মানুষেরা, প্রতিনিয়ত তাদের ঝগড়াবিবাদ তো বটেই, আরও যেটি গুরুত্বপূর্ণ সে লুণ্ঠনের আদর্শের সঙ্গে প্রত্যক্ষে-অপ্রত্যক্ষে পরিচিত হই। এই লুণ্ঠনকারীরা আমাদের বীর, তাদের বীরত্বই অনুকরণীয়।
এ দেশে কখনোই জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি জনবিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র শাসকশ্রেণি দেশ শাসন করেছে। এটা ব্রিটিশ আমলে ঘটেছে, পাকিস্তান আমলেও সত্য ছিল, বাংলাদেশের কালেও মিথ্যা নয়। আগের দুই সময়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতর যে বুদ্ধিজীবীরা ছিল, শাসকশ্রেণিকে তারা বলত, ‘তোমরা ও আমরা’; তোমরা শাসক, আমরা শাসিত। এখন মধ্যবিত্তের ছোট একটি খণ্ড শাসকশ্রেণির অংশ হয়ে গেছে, বড় খণ্ড নেমে গেছে নিচে, জনগণের কাছাকাছি। এখনকার প্রধান বুদ্ধিজীবীরা শাসকশ্রেণির সঙ্গে আছে, যদিও দলীয়ভাবে তারা বিভক্ত, রাজনৈতিক নেতাদের মতো। তারা তাই ‘তোমরা ও আমরা’ কথাটা বলতে পারে না, বলে ‘আমরা ও তোমরা’, আমরা শাসকদের সহযোগী, আর তোমরা হচ্ছো জনসাধারণ। সশব্দে বলে না, কিন্তু তাদের অবস্থান, চিন্তাধারা ও বক্তব্য ওই বিভাজনটাকে জানিয়ে দেয়।
এই যে শাসকশ্রেণি, সেটি অখণ্ড বটে। তাদের ভেতরকার যে কলহ সেটি শরিকদের যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে শত্রুতা হয়, রাজনীতিকে-রাজনীতিকে লড়াই বাধবে না কেন। এই শ্রেণি নানা উপাদানে গঠিত। এদের ভেতর ব্যবসায়ী, আমলা, পেশাজীবী সবাই রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যেটুকু স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তা যে এরা এনেছে তা নয়; ‘স্বাধীনতা’ এনেছে জনগণ, একবার ভোট দিয়ে; দ্বিতীয়বার ভোট এবং রক্ত দুটোর বিনিময়ে।
শাসকশ্রেণির একাংশ তো স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল; কেউ কেউ প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে। ঘোরতর শত্রুতা করেছে জামায়াতিরা। পরে তারা ক্ষমতার একাংশ হয়ে গেছে। এই যে আপাত-অদ্ভুত ঘটনা, এর ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা অন্য কিছু নয়, সেটি এই যে, শ্রেণিগতভাবে এ মৌলবাদীরাও শাসকশ্রেণির বাইরে নয়, ভেতরেই আছে। আওয়ামী লীগ এদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে, তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি, যদিও ইতিহাসের নির্দেশ মানলে দু’পক্ষের থাকার কথা ছিল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। বিএনপির তো কথাই নেই, তারা তো জামায়াতকে কোলে টেনে নিয়েছে। দল সত্য নয়, সত্য হচ্ছে শ্রেণি। দল বা ইতিহাস দিয়ে লোক চেনা যায় না, খুব সহজে চেনা যায় শ্রেণিগত পরিচয় দিয়ে।
আন্দোলন সংগ্রাম যা করবার তা মূলত জনগণকে করতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে এটা সত্য ছিল, পাকিস্তান আমলেও সত্য থেকেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুতে জনগণ ছিল; কেবল ছিল না, তাদের কারণে ওইসব ঘটনায় সাফল্য এসেছে, দুর্ভোগ যা তাদের পোহাতে হয়েছে। কিন্তু সংগ্রামের যা অর্জন সেটি তাদের ঘরে যায়নি, পৌঁছে গেছে এখন যারা শাসক অর্থাৎ জনগণের শত্রু তাদের হাতে, তারাই ক্রমাগত হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়েছে জনগণ থেকে এবং নিপীড়ন চালিয়েছে ওই জনগণের ওপরই।
ব্রিটিশ শাসনের কালে এই শাসকশ্রেণির যাত্রার সূত্রপাত ঘটে। সে সময়ে তারা উঠতি শ্রেণি, তারা চাইছিল ব্রিটিশ যখন চলে যাবে তখন তাদের হাতে যেন ক্ষমতা দিয়ে যায়; ক্ষমতা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল, যে দ্বন্দ্ব রূপ নিয়েছিল নির্মম সাম্প্রদায়িকতার। জনগণের ভেতর সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, প্রতিবেশীকে তারা প্রতিবেশী হিসেবে দেখত, শাসনক্ষমতা পাবার জন্য লোলুপ শ্রেণিটি সাধারণ মানুষকে আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। দুর্ভোগ যা সেটা সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হয়েছে, আর দুই দিকের দুই বিত্তবান শ্রেণি শাসনক্ষমতা পেয়ে নিজেদের বিত্তবেসাত বাড়িয়ে তুলেছে।
পাকিস্তান আমলে শাসনক্ষমতা ছিল অবাঙালিদের হাতে; বাঙালি মধ্যবিত্ত কিছুটা সুযোগ-সুবিধা পেল ঠিকই, কিন্তু অবাঙালিদের তুলনায় সে প্রাপ্তিটা ছিল সামান্য; অবধারিত রূপেই একটা দ্বন্দ্ব বেধে উঠল দু’পক্ষের মধ্যে। জনগণের অসন্তোষটা ছিল আরও বড়; তারা কিছুই পায়নি, তারা ছিল বিক্ষুব্ধ। বাঙালি মধ্যবিত্ত চেয়েছে স্বায়ত্তশাসন, জনগণ চেয়েছে মুক্তি। কিন্তু জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক দল ছিল না। তারা ওই স্বায়ত্তশাসনকামী জাতীয়তাবাদীদের পেছনে যেতে বাধ্য হয়েছে। এবং তাদের কারণে অবাঙালি শাসকেরা এই দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। যুদ্ধটা ছিল জনযুদ্ধ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স র জ ল ইসল ম চ ধ র স ব ধ নত র জন ত ক জনগণ র ছ নত ই ক ষমত শ সনক
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ
আওয়ামীলীগ দেশের মানুষের অধিকার হনন করেছে। তাই, দেশে এক গণবিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে। ২৪এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ এ দেশ থেকে বিতারিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও রূপগঞ্জ আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মোহাম্মদ দুলাল হোসেন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভোলাব ইউনিয়নের আতলাপুর বাজার এলাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লিফলেট বিতরণকালে মোহাম্মদ দুলাল হোসেন এসব কথা বলেন।
লিফলেট বিতরণকালে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ, বিএনপি-যুবদলসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
মোহাম্মদ দুলাল হোসেন আরও বলেন, “গত ১৭ বছর ধরে এ দেশের জনগণ একদলীয় শাসন ও ফ্যাসিবাদের শিকার হয়ে জিম্মি হয়ে ছিল। মানুষের বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের গণজাগরণের মধ্য দিয়ে জনগণ আবারও তাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। এখন সময় এসেছে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার, একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার।”
তিনি আরও বলেন, “তারেক রহমানের ৩১ দফা দেশের পুনর্গঠনের পথনির্দেশনা। এই দফাগুলোতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।”
এসময় স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদল নেতৃবৃন্দও লিফলেট বিতরণে অংশগ্রহণ করেন। তারা সাধারণ মানুষকে বিএনপির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করেন যে, দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত এবং জনগণের পাশে থাকবে।
স্থানীয়রা জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা করছেন তারা। এ ধরনের লিফলেট বিতরণ কার্যক্রমে জনগণ আরও বেশি সচেতন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
প্রসঙ্গত, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চলতি বছরের শুরুতে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যেখানে রাষ্ট্র সংস্কার ও জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তুলে ধরা হয়।