দেশে আবার সোনার দাম বেড়েছে। তাতে রেকর্ড দামে পৌঁছেছে মূল্যবান এ ধাতু। এ দফায় প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০৩ টাকা।

ফলে ভালো মানের ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম হবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭ টাকা। দেশের বাজারে এটিই এখন পর্যন্ত সোনার সর্বোচ্চ দাম।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) আজ বৃহস্পতিবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোনার দাম বাড়ার কথা জানায়। এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার (পিওর গোল্ড) দাম বেড়ে যাওয়ায় দাম সমন্বয় করা হয়েছে। নতুন দাম আগামীকাল শুক্রবার থেকে কার্যকর হবে।

সর্বশেষ ৮ এপ্রিল রাতে সোনার দাম ভরিপ্রতি ১ হাজার ২৪৮ টাকা কমানোর কথা জানিয়েছিল বাজুস। তাতে এক ভরি সোনার সর্বোচ্চ দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৪ টাকা। এ দামেই আজ পর্যন্ত সোনা বিক্রি হয়েছে। এর আগে গত ২৯ মার্চ সোনার দাম ভরিপ্রতি সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৭২ টাকায় উঠেছিল। এত দিন দেশের বাজারে সেটিই ছিল সোনার সর্বোচ্চ দাম।

বাজুসের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে আগামীকাল শুক্রবার থেকে দেশের বাজারে হলমার্ক করা প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ২২ ক্যারেট মানের সোনা ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭ টাকা, ২১ ক্যারেট ১ লাখ ৫১ হাজার ৭৯৫ টাকা, ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ৩০ হাজার ১১২ টাকায় বিক্রি হবে। এ ছাড়া সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়ে হবে ১ লাখ ৭ হাজার ৩৪৪ টাকা।

আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনা ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৪ টাকা, ২১ ক্যারেট ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৯৮ টাকা, ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ২৮ হাজার ১৪১ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনা ১ লাখ ৫ হাজার ৬৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কাল থেকে প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনায় ২ হাজার ৪০৩ টাকা, ২১ ক্যারেটে ২ হাজার ২৯৭ টাকা, ১৮ ক্যারেটে ১ হাজার ৯৭১ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনায় ১ হাজার ৬৮০ টাকা দাম বাড়বে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২২ ক য র ট

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাইয়ের ভয়াবহতা: সরকার প্রধানের কণ্ঠে হত্যার নির্দেশ

ইতিহাসের কিছু মুহূর্ত থাকে যা একটি জাতির গতিপথ চিরতরে বদলে দেয়। কিছু ঘটনা এতটাই ভয়াবহ যে তা রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের মূল ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি বিবিসির ফাঁস করা একটি ফোনালাপ দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন তুলেছে, যেখানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর শনাক্ত করা হয়েছে। এই ফোনালাপে শোনা যায় একটি নির্দেশনা। শেখ হাসিনা বলছেন: "আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি। এখন ‘লিথাল ওয়েপন’ ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে, সেখানে গুলি করবে।"

এই কথাগুলো কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের নির্দেশ নয়, যেখানে শত্রু সেনার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চলছে। এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল একটি দেশের নির্বাচিত সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকে, তাঁর নিজের দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে, তাঁরই দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে; যাদের একটি বড় অংশ ছিল অধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী।

এই ফাঁস হওয়া নির্দেশটি কেবল একটি রাজনৈতিক বিতর্ক বা স্ক্যান্ডাল নয়। এটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দর্শন, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং সভ্যতার মৌলিক নীতির ওপর এক চরম আঘাত। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া দুর্বল ও কৌশলী অস্বীকৃতি (নন-ডিনায়াল ডিনায়াল) বিষয়টির ভয়াবহতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। 

আরো পড়ুন:

কনসার্টে ‘অশ্লীল’ শব্দ: আসিফ বললেন, এটা আমাদের সংস্কৃতি না

কুবিতে শহীদ আব্দুল কাইয়ূমের শাহাদাত বার্ষিকী পালন

যে কোনো ভয়াবহ সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রথম চেষ্টা হয় সেটিকে "মিথ্যা" বা "সাজানো" বলে উড়িয়ে দেওয়া। শেখ হাসিনার ফোনালাপের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিবিসিকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তা এক কথায় ক্লাসিক "নন-ডিনায়াল ডিনায়াল" বা কৌশলী অস্বীকৃতি। বিবৃতিতে বলা হয়, "আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না রেকর্ডিংটি আসল কিনা, তবে যদি হয়ও, এটি শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কোনো বেআইনি উদ্দেশ্য প্রমাণ করে না।"

এই বিবৃতির দুটি অংশ:
১. সন্দেহ তৈরি: "আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না" – এই বাক্যটি দিয়ে সরাসরি মিথ্যা বলার ঝুঁকি না নিয়ে রেকর্ডিংটির সত্যতা নিয়ে একটি ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে।
২. অপরাধ লঘুকরণের চেষ্টা: বলা হয়েছে "...তবে যদি হয়ও..." – এই অংশটি কার্যত মেনে নিচ্ছে যে রেকর্ডিংটি আসল হলেও হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও এর পেছনের "উদ্দেশ্য" খারাপ ছিল না।
কিন্তু আধুনিক ফরেনসিক বিজ্ঞানের সামনে এই ধরনের দুর্বল প্রতিরক্ষা খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। বিবিসি এই রেকর্ডিংটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যে কোনো আইনি বা ঐতিহাসিক পর্যালোচনার জন্য যথেষ্টর চেয়েও বেশি।

বিবিসি প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-কে দিয়ে কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করায়, যেখানে শেখ হাসিনার পরিচিত কণ্ঠের সঙ্গে রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু বিবিসি এখানেই থেমে থাকেনি। তারা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত এবং স্বাধীন অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ইয়ারশট (Earshot)-কে দিয়ে রেকর্ডিংটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করায়। ইয়ারশট একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনায় অডিও প্রমাণ নিয়ে কাজ করে এবং তাদের নিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত।

ইয়ারশটের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ কোনো সাধারণ পর্যবেক্ষণ ছিল না। তাদের প্রাপ্ত ফলাফলগুলো নিম্নরূপ:

১/ কোনো বিকৃতি নেই: রেকর্ডিংটিতে কোনো ধরনের সম্পাদনা (editing), কাটাছেঁড়া (splicing) বা বিকৃতির (manipulation) প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অডিওটি একটি অখণ্ড রেকর্ডিং।
২/ কৃত্রিম কণ্ঠ নয়: এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি (synthetically generated) কোনো কণ্ঠ নয়। আধুনিক AI বা ডিপফেক প্রযুক্তির সম্ভাবনাকেও তারা নাকচ করে দিয়েছে।
৩/ ENF (Electric Network Frequency) বিশ্লেষণ: এটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ। যে কোনো ডিজিটাল রেকর্ডিংয়ে বিদ্যুতের লাইনের একটি সূক্ষ্ম ফ্রিকোয়েন্সি (সাধারণত ৫০ বা ৬০ হার্জ) রেকর্ড হয়ে যায়। যদি অডিওটি একাধিক ক্লিপ জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়, তবে এই ফ্রিকোয়েন্সি প্যাটার্নে অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। ইয়ারশট রেকর্ডিংটি জুড়ে একটি নিরবচ্ছিন্ন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ENF প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছে, যা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে অডিওটি একবারেই রেকর্ড করা হয়েছে।
৪/ বাচনভঙ্গির মিল: বিশেষজ্ঞরা শেখ হাসিনার পরিচিত কথার ছন্দ (rhythm), স্বরের ওঠানামা (intonation), শ্বাসের শব্দ এবং রেকর্ডিংয়ের পরিবেশগত নয়েজ (consistent noise floor) বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে এটি তাঁরই স্বাভাবিক কণ্ঠ।

সুতরাং, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে রেকর্ডিংটির সত্যতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। এটিকে অস্বীকার করা মানে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা। এখন মূল প্রশ্নটি হলো— রেকর্ডিং-এ যা বলা হয়েছে, তার তাৎপর্য কী?

আওয়ামী লীগ এখন দাবি করছে, এই নির্দেশে কোনো "বেআইনি উদ্দেশ্য" ছিল না। এই দাবিটি কেবল হাস্যকরই নয়, এটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের মৌলিক স্তম্ভগুলো সম্পর্কে চরম অজ্ঞতার পরিচায়ক। জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা (UDHR) এবং বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICCPR)-এর প্রাণকেন্দ্র হলো জীবনের অধিকার। বাংলাদেশ ICCPR-এ স্বাক্ষরকারী একটি দেশ এবং এই চুক্তি মেনে চলতে আইনত বাধ্য। "যেখানে পাবে, সেখানে গুলি করবে" – এই নির্দেশ জীবনের অধিকারকে কেবল লঙ্ঘনই করে না, এটিকে উপহাস করে। এটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটি খোলামেলা লাইসেন্স দেয়, যা আধুনিক সভ্যতায় একটি চরম অপরাধ।

 আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি অনুযায়ী, যখন কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালানো হয়, তখন তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। 

অডিওতে শোনা যায় হাসিনার এই নির্দেশ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা আকস্মিক ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ নয়। "আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিছি" – এই কথাগুলো প্রমাণ করে এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত নীতি। এটি নিরাপত্তা বাহিনীকে পরিস্থিতি অনুযায়ী শক্তি প্রয়োগের স্বাধীনতা দিচ্ছে না, বরং একটি পূর্বনির্ধারিত হত্যাকাণ্ড চালানোর নির্দেশ দিচ্ছে।

আমরা জানি এ ধরনের অপরাধের মামলায় অভিযুক্তের অপরাধমূলক উদ্দেশ্য বা প্রমাণ করা সবচেয়ে কঠিন। শেখ হাসিনার নিজের কণ্ঠের এই রেকর্ডিংটি সেই উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য একটি অকাট্য দলিল। তিনি পরিষ্কারভাবে প্রাণহানির উদ্দেশ্যেই "প্রাণঘাতী অস্ত্র" ব্যবহারের কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানের মতে, এ কারণেই এই রেকর্ডিংটি এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি সরাসরি শীর্ষ পর্যায় থেকে আসা অপরাধমূলক অভিপ্রায়ের প্রমাণ।

ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ছিল মূলত তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রকাশ। সেই অধিকারকে সম্মান জানানোর বদলে প্রাণঘাতী শক্তি দিয়ে তা দমন করার নির্দেশ দেওয়া শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারের ওপর একটি নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। আমরা জানি, যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে কিছু মৌলিক ধারণার ওপর। শেখ হাসিনার নির্দেশ সেই ধারণাগুলোকেই ধ্বংস করে দেয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম মূল ভিত্তি হলো সামাজিক চুক্তি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জনগণ তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে বলপ্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার দেয়। এর বিনিময়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু যখন রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই নাগরিকদের হত্যার নির্দেশ দেন, তখন সেই চুক্তি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। রাষ্ট্র তখন রক্ষকের ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এটি রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের মৌলিক বিশ্বাসে আঘাত হানে।

এই নির্দেশনা আইনের শাসনের মৃত্যু। আইনের শাসন মানে হলো, একটি দেশে ব্যক্তির ইচ্ছা বা খামখেয়ালি নয়, বরং আইনই হবে সর্বোচ্চ। কখন, কোথায় এবং কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করা যাবে, তা আইনে কঠোরভাবে নির্ধারিত থাকে। "যেখানেই পাবে, গুলি করবে" – এই নির্দেশ সেই আইনের শাসনকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এটি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে বিচারবহির্ভূত জল্লাদে (extrajudicial executioner) পরিণত করে। এটি বিচারব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে, কোনো প্রমাণ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে, সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার শামিল।

ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনো শাসক তাঁর জনগণকে দমন করার জন্য এমন চরম ভাষা ব্যবহার করেছেন, তখনই সেখানে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। শেখ হাসিনার এই নির্দেশ তাঁকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেইসব স্বৈরশাসকদের কাতারে দাঁড় করায়, যারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নিজ দেশের মানুষের রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করেননি।

লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি তার জনগণের একাংশকে "ইঁদুর" আখ্যা দিয়ে নির্মূলের ডাক দিয়েছিলেন, যার পরিণতি ছিল এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।
চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর ট্যাংক চালানো হয়েছিল, যা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ও গুম করা হয়েছিল।

শেখ হাসিনার এই নির্দেশ প্রমাণ করে, তাঁর কাছে আন্দোলনকারীরা ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিক ছিলেন না, ছিলেন নির্মূলযোগ্য শত্রু। এই মানসিকতা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং স্বৈরতন্ত্রের সুস্পষ্ট লক্ষণ।

একটি নির্দেশের প্রভাব কেবল আইনি বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এর সুদূরপ্রসারী নৈতিক এবং সামাজিক পরিণতিও থাকে। একজন প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধান সমগ্র জাতির অভিভাবক। তাঁর দায়িত্ব হলো বিভেদ দূর করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু যখন তিনি দেশেরই একটি অংশকে গুলি করার নির্দেশ দেন, তখন তিনি নিজেই বিভাজনের প্রধান স্থপতি হয়ে ওঠেন এবং রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে একটি স্থায়ী অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরি করেন। তিনি আর সমগ্র জাতির নেতা থাকেন না, একটি পক্ষের রক্ষক এবং অন্য পক্ষের দমনকারী হয়ে ওঠেন।

এই ধরনের বেআইনি হুকুম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়। তাদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিক মনোবল ভেঙে পড়ে। আইন অনুযায়ী নাগরিককে রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তাদের যখন নিজ দেশের ছাত্র-জনতাকে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীকে ঠেলে দেয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে এবং জনগণের চোখে তাদের ভাবমূর্তি চিরতরে নষ্ট করে দেয়।

শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া ফোনালাপটি নিছক কোনো টেপ রেকর্ডিং নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল—যে দলিলে খোদাই করা আছে একটি রাষ্ট্রের তার নাগরিকদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার মুহূর্ত। এটি প্রমাণ করে, ক্ষমতা রক্ষার আকাঙ্ক্ষা যখন মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে অনেক বড় হয়ে ওঠে, তখন একজন শাসক কতটা নিচে নামতে পারেন!

এই রেকর্ডিংটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে গণতান্ত্রিক মুখোশের আড়ালে স্বৈরাচারের বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে এবং কীভাবে একজন নেতার একটি মাত্র নির্দেশ একটি দেশকে সভ্যতার পথ থেকে বহু দূরে ঠেলে দিতে পারে। এই কণ্ঠস্বর কেবল একজন ব্যক্তির নয়, এটি ক্ষমতার সেই ভয়াল রূপের প্রতিচ্ছবি যা মনে করিয়ে দেয়, নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসন কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়, এটিকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি প্রজন্মকে সচেতন ও সোচ্চার থাকতে হয়।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ