বাদী-বিবাদীর সরাসরি সাক্ষ্য লাগবে না
Published: 17th, April 2025 GMT
বাদী ও বিবাদীকে প্রচলিত পদ্ধতিতে সাক্ষ্য দিতে হবে না। এফিডেভিটের মাধ্যমে দাখিলকৃত তাদের আরজি বা জবাবের লিখিত বক্তব্যই সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে এবং তার ওপর হবে জেরা। মামলা মুলতবি চাওয়ার সুযোগেও পরবে লাগাম। আদালতে মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি আইনের কার্যবিধিতে এমন বেশ কিছু সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলা ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭টি। বাদী-বিবাদীর সাক্ষ্য গ্রহণে দেরিসহ নানা কারণে অনেক মামলা ৫০-৬০ বছর ধরে ঝুলছে। সংশোধনী কার্যকর হলে আদালতের কর্মঘণ্টা বাঁচবে; আমূল বদলে যাবে সাক্ষ্য ব্যবস্থাপনা। মামলার সঙ্গে জড়িতদের ভোগান্তি কমে আসবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান নিয়মে দেওয়ানি মামলায় বাদী-বিবাদী আরজি বা জবাবের বক্তব্য মৌখিকভাবে জবানবন্দি হিসেবে দিয়ে থাকেন। দিনের পর দিন আদালত তা গ্রহণ করেন। সংশোধনীতে আরজি এফিডেভিট করলেই তা জবানবন্দি হয়ে যাবে। বাদী-বিবাদীকে নতুন করে আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন জবানবন্দি দিতে হবে না। এফিডেভিটে যা আছে, তার ওপর জেরা করা হবে।
এ ব্যাপারে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সমকালকে বলেন, ‘দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন হলে সাক্ষ্য গ্রহণে সময় অনেক কমে যাবে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা বেড়ে যাবে, কমবে খরচ। বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন।’
এদিকে দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধনী আইন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলা হতে পারে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এ বৈঠক হবে। সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড.
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি খসড়া অধ্যাদেশের ওপর মতামত চেয়ে তা ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়।
১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির বিদ্যমান নিয়মে, প্রতিটি পর্যায়ে এখন মামলা নিষ্পত্তির সময় বেঁধে দেওয়া রয়েছে। তবে সংশোধনী আইনের খসড়ায় এটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্ত করা হচ্ছে অনলাইন পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তির বিধান। সংশোধনের ফলে মূল মোকদ্দমাতে আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য আবেদন করা যাবে।
আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করলে পৃথক মামলার প্রয়োজন পড়বে না। এসএমএস, ভয়েস কল, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সমন জারি করা যাবে। এতে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত ও সহজে মামলার তথ্য সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে।
অর্থ আদায়ের মামলায় বিশেষ বিধান যুক্ত করা হয়েছে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে। এতে বলা হয়েছে, বাদীকে মামলা করতে হলে আরজিতে নিজের ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হবে বিবাদীর এনআইডি, ই-মেইল নম্বর উল্লেখ করতে হবে। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার জরিমানার ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সংশোধনীতে রিমান্ডের সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। আদালত তার আদেশ ও রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে পারবে।
অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু সমকালকে বলেন, গত ১১৭ বছরে জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে; চাপ পড়েছে জমিতে। মামলাও বেড়েছে হাজার হাজার। সময়ের প্রয়োজনে দেওয়ানি আইনের কার্যবিধি সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে। ডিজিটাল যুগে অনলাইন বিধান চালু করার পরামর্শ দেন তিনি।
বিচারাধীন মামলা সাড়ে ১৭ লাখ
সূত্র জানায়, গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। প্রতিদিনই নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। বর্তমানে বিচারিক আদালতে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৯৮ হাজার ৬১৯ ও আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ১৯ হাজার ২৯১টি। বিচারিক আদালতে পাঁচ বছরের বেশি সময় বিচারাধীন ৪ লাখ ১১ হাজার ১১৮ মামলা। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিচার স্থগিত ৪ হাজার ৮৬৪টি মামলার।
জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধে সিলেটের গোয়াইনঘাটের আসিরুন নেসা ১৯৫৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুনসেফ আদালতে মামলা করেন। ১৯৬২ সালের ২৩ আগস্ট বাদীর পক্ষে রায় দেন বিচারিক আদালত। ২০০৫ সালে আসিরুনের মৃত্যুতে নতুন বাদী হন তাঁর মেয়ে হামিদা খাতুন (৭০)। মামলার একাধিক বিবাদীও মারা গেছেন। ৬৩ বছর পর ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ আদালত মামলাটি নিষ্পত্তি করে রায় দেন। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর দখল বুঝে পেতে আরও কয়েক বছর লেগেছে হামিদার। আসিরুন নেসার মতো অনেক মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে।
৩৮ বছরেও হয়নি বাংলা
দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষা চালুর লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এতে বলা হয়, সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক আইনের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু দেওয়ানি কার্যবিধি ইংরেজিতেই রয়ে গেছে।
একাধিক বাদী-বিবাদীর অভিযোগ, ইংরেজি ভাষার কারণে আইনটি তারা বুঝতে পারেন না। আইন বোঝার জন্যও আইনজীবীকে বাড়তি ফি দিতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু বলেন, ‘দেওয়ানি কার্যবিধির মূল আইনও বাংলা হলে জনগণ বেশি উপকৃত হতেন। এটি সংসদে অনুমোদন প্রয়োজন।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আইন প স উপদ ষ ট ন র পর আইন র
এছাড়াও পড়ুন:
শালবনে ছেচরা কই ও পাটখই
বিভতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসে একজন যুগলপ্রসাদ ছিলেন, যিনি লবটুলিয়ার জঙ্গলে সরস্বতী কুন্ডের পাড়ে নানা জায়গা থেকে নানা প্রজাতির গাছপালা এনে লাগাতেন। সেসব গাছে ফুল ফুটলে আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে যেতেন। আমারও একজন যুগলপ্রসাদ ছিলেন, নাম আজাহার। প্রায় আমারই সমবয়সী।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে বিভিন্ন শালবনে ঘুরতে গেলে মাঝেমধ্যে তিনি আমার সাথি হতেন। শালবনে কত গাছ! তেমন কিছুই চিনি না। কিন্তু সেই শালবনের কোলে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা আজাহার ঠিকই সেসব গাছ চিনতেন, আর জিজ্ঞেস করলে টপাটপ নাম বলে দিতেন। কিন্তু গোলমাল বাধত সেসব নাম শুনে। কেননা সেসব নাম বলতেন, তাঁদের স্থানীয় ভাষায়। বইয়ে সেসব নাম খুঁজে পাওয়া যেত না।
একদিন শালবনের মধ্যে একটা ছোট গাছ দেখলাম, গাছের গুঁড়ির চারদিকে তীক্ষ্ণসরু ও সোজা প্রচুর কাঁটা বেরিয়েছে। পাতাগুলো দেখতে কিছুট পেয়ারাপাতার মতো। প্রচুর ডালপালায় গাছটার মাথা ঝাঁকড়া হয়ে আছে। ডালের আগায় শিষের মতো মঞ্জরিতে প্রচুর ঘিয়া ও সাদাটে রঙের খুদে ফুল ফুটেছে। চিনি না। তাই আজাহারকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী? চট করেই বলে দিলেন, ছেচরা কই। মাছের নাম কই হয় জানি, কিন্তু কোনো গাছের নাম কই হতে পারে? অগত্যা ছবি তুলে ওই নামকেই মনে গেঁথে ফিরে এলাম ঢাকায়।
আজাহার বললেন, এখন ফুল দেখছেন। কদিন পরেই ওসব ফুল থেকে ছোট ছোট গুলির মতো প্রচুর ফল ধরবে। ছোটবেলায় আমরা সেসব কাঁচা ফল নিয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ফটকা বানিয়ে তার চোঙে একটা একটা করে ফল দিয়ে বন্দুকের মতো গুলি গুলি খেলতাম। চোঙের ভেতরে একটা সরু কাঠি ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে সেসব ফল গুলির মতো ফাটাতাম। ফটাস করে শব্দ হতো। এ সময় মাসখানেকের জন্য আমরা এ গাছের ফল, পরে জালি খেজুর নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। শালবনে সে সময় এ গাছের অভাব ছিল না। এখন তো দেখতে হলে খুঁজে বের করতে হয়।
ফিরে এসে সে ছবি পাঠালাম জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের সাবেক বোটানিস্ট সামসুল হক ভাইয়ের কাছে। দুই দিন পরেই তিনি জানালেন, গাছটার স্থানীয় নাম ছেচরা কই, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Bridelia retusa, গোত্র ফাইলেনথেসি। বইপত্রে এ গাছের চারটি বাংলা নাম পেলাম—কাঁটাকই, কাঁটাকুশি, কামকই, আকদানা। বাংলাদেশ ছাড়াও এ গাছ আছে নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। সাধারণত উঁচু ও শুষ্ক বনাঞ্চলে এ গাছ দেখা যায়। ছোট বৃক্ষজাতীয় গাছ, প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, দ্রুত বাড়ে। এ গাছের কাঁটা থাকায় বন্য প্রাণীরা এদের ধারে ঘেঁষে না, এমনকি এর বাকল দিয়েও বিষ তৈরি করা হয় বলে শুনেছি।
ফল গোলাকার, ছোট, কাঁচা ফল ময়লা সবুজ, পাকলে খোসায় লাল রং ধরে। ছেচরা কইগাছের কাঠ মাঝারি শক্ত থেকে শক্ত, কাঠের রং ময়লা লাল। রঙে ও গুণে কাঠ উৎকৃষ্ট। নির্মাণকাজ ও গরুর গাড়ির চাকা বানাতে ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও শুষ্ক তৃণভূমিতে যদি কোনো গাছ থাকে, তবে সেসব ঘাসে আগুন দিলে এ গাছ পোড়ে না বলে কথিত রয়েছে। বীজ দ্বারা সহজে বংশবৃদ্ধি বা চারা হয়।
পূর্বাচল উপশহরের শালবনে দেখা পাটখই ফল