‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ সাংগ্রাইয়ের প্রাণ
Published: 17th, April 2025 GMT
পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি তিন জেলায় চলছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসব সাংগ্রাই। এ উৎসব ঘিরে পাহাড়ি জনপদের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় বেজে উঠেছে এক পরিচিত সুর ‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’।
মারমা ভাষায় লেখা একটি গানের প্রথম লাইন এটি। এর বাংলা অর্থ হলো ‘এসো হে সাংগ্রাইতে সবাই মিলেমিশে একসাথে পানি খেলি।’
মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাইং উৎসবের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে আছে ‘মৈতা রিলং পোয়ে’ বা ‘মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব’। এই উৎসবে পরস্পরের দিকে পানি ছিটিয়ে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন মারমারা। ‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ (এসো হে সাংগ্রাইতে সবাই মিলেমিশে একসাথে পানি খেলি) গানটিও দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আছে এই উৎসবের ‘থিম সং’।
মারমা জনগোষ্ঠীর প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসবের শুরু গত শতকের সত্তরের দশকে। কিছু তরুণ মিয়ানমারে সাংগ্রাই উৎসবে এ ধরনের আয়োজন দেখে দেশেও এর প্রচলন শুরু করেন। আর ‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ গানটি আশির দশক থেকে উৎসবের থিম সং হয়েছে আসছে।
মারমা ভাষার এই গান শুধু মারমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন একটি সর্বজনীন প্রিয় গান। চাকমা, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, ম্রো, খিয়াংসহ পাহাড়ি-বাঙালি সবার কাছেই এ গান অত্যন্ত প্রিয় ও হৃদয়স্পর্শী। গানে যেমন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার কথা বলা আছে, তেমনি বর্ষবরণের আনন্দের কথাও উঠে এসেছে।
গানে বলা আছে, ‘‘আসো ভাই- বোনেরা ঐতিহ্যের পানি খেলা করি/ পানি যেভাবে শরীরকে পরিষ্কার করে, তেমনি পুরোনো বছরের ভুল, দুঃখ ও গ্লানি দূর করে মনের মাঝে বিশুদ্ধতা ও নির্মলতা এনে দেয়/ আসো আমরা সেই উদ্দেশ্যেই পানি খেলি/ নতুন বছর আসছে, আসো পূণ্যের কাজ করি/ যে পূণ্য আমাদের আগামী দিনগুলোকে সুন্দর করে তুলবে/ মন্দিরে গিয়ে পঞ্চ শীল গ্রহণ করব, বুদ্ধ পূজা করব, গুরুজনদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পূণ্যের পথে চলব।”
এই গানটির ইতিহাসও বেশ পুরোনো। গানের গীতিকার ও সুরকার হলেন প্রয়াত উ পঞ্ঞা জোত মহাথের ওরফে উচহ্লা ভান্তে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এ গানের পেছনের গল্প। সালটা ছিল ১৯৭৫, তখন বান্দরবান সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন তিনি কলেজে পড়তেন। সেই সময় সাংগ্রাই উৎসবের আগে তাঁর মনে দোলা দেয় সাংগ্রাইকে কেন্দ্র করে একটি গান লেখা দরকার, কারণ এটি শুধু মারমা সম্প্রদায়ের নয় বরং সমগ্র বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব। তখন বান্দরবানের বোমাং রাজবাড়ীর পুকুরপাড়ে এক টুকরো কাগজ, কলম ও গিটার নিয়ে বসে গানটি রচনা করেন তিনি।
প্রথমে গানটি সাংগ্রাই উৎসবে মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হত। পরে বান্দরবান বেতারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই গান মানুষ মুখে মুখে গেয়ে সাংগ্রাই উৎসবে মেতে উঠত। ১৯৯৯ সালে বান্দরবান মারমা শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা গানটি অডিও রেকর্ড করেন। এরপর থেকে সাংগ্রাই উৎসব এলেই এই গানের সুর ছড়িয়ে দেয় আনন্দের আমেজ এবং তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উচ্ছ্বাস।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই গানটি সাংগ্রাই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিবারের মতো এবারও জলকেলি বা মৈত্রীয় পানি বর্ষণের উৎসবে সব বয়সের মানুষ এ গানের তালে তালে নেচে-গেয়ে আনন্দে মেতে উঠবে। সাংগ্রাই ও এই গান যেন একে অপরের পরিপূরক।
মারমা শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মারমার সংগীত শিল্পী চথুইপ্রু মারমা বলেন, “সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ গানটি রচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। সেই সময় থেকেই গানটি গ্রাম থেকে গ্রামে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে মারমা শিল্পীগোষ্ঠীর অডিও ক্যাসেট প্রকাশের পর গানটি আরও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাংগ্রাই উৎসব এলেই এই গানটির সুরে ও তালে মেতে ওঠে সবাই। গানটি যেন উৎসবের আবহ তৈরি করে। এই গান শুনলেই মন ভরে যায়, প্রাণ জেগে ওঠে সাংগ্রাই উৎসবের আনন্দে।”
আজও এই গান দিয়েই শুরু হয় মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এটি শুধুমাত্র একটি গান নয়, বরং সাংগ্রাই উৎসবের আনন্দের প্রতীক।
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গ র ই উৎসব র জনগ ষ ঠ র ব ন দরব ন ই গ নট এই গ ন আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।