উপভোগ করতেন ট্যাঙ্গো নাচ, ফুটবল, ছিলেন বার বাউন্সার, কীভাবে হলেন পোপ
Published: 21st, April 2025 GMT
ফ্রান্সিসের পোপ পদে আরোহণ অনেকগুলো প্রথমের সূচনা করেছিল।
ফ্রান্সিস ছিলেন লাতিন আমেরিকা তথা দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ। ৭৪১ সালে সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া গ্রেগরি তৃতীয়ের মৃত্যুর পর ইউরোপের বাইরে থেকে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি বিশপ অব রোম হন।
ফ্রান্সিস ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের ধর্মীয় গোষ্ঠী যিশু সমাজভুক্ত প্রথম পোপ। ফ্রান্সিসের পূর্বসূরি পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট প্রায় ৬০০ বছরের মধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা প্রথম পোপ ছিলেন। আর প্রথমবারের মতো প্রায় এক দশক ধরে ভ্যাটিকান গার্ডেনে পাশাপাশি বসবাস করেছেন দুজন পোপ—পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ও পোপ ফ্রান্সিস।
অনেক ক্যাথলিক ধারণা করেছিলেন, নতুন পোপ হবেন অপেক্ষাকৃত তরুণ কেউ। কিন্তু আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল বারগোগ্লিও যখন ২০১৩ সালে পোপ নির্বাচিত হন, তখন তাঁর বয়স ৭০ পার হয়ে গেছে অনেক আগে। তিনি নিজেকে একজন মধ্যপন্থী প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন: যৌন নীতিমালার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মতাদর্শের মাধ্যমে রক্ষণশীলদের আকৃষ্ট করেন। আবার সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে উদার অবস্থানের মাধ্যমে সংস্কারপন্থীদের মন জয় করেন।
আশা করা হয়েছিল, তাঁর এই ব্যতিক্রমী পটভূমি ভ্যাটিকানকে নতুন প্রাণ দেবে এবং চার্চের পবিত্র উদ্দেশ্যকে পুনরুজ্জীবিত করবে।
তবে ভ্যাটিকানের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ফ্রান্সিসের কিছু সংস্কার প্রচেষ্টা বাধার মুখে পড়েছিল এবং ২০২২ সালে মৃত্যুবরণ করা তাঁর পূর্বসূরি তখনো রক্ষণশীলদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন।
ভিন্ন হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
নির্বাচিত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই ফ্রান্সিস স্পষ্ট করে দেন, তিনি পোপ হিসেবে ভিন্নভাবে কাজ করবেন। তিনি তাঁর কার্ডিনালদের আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, বরং অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং দাঁড়িয়ে থেকে অভ্যর্থনা জানান—পোপের আসনে বসে নয়।
২০১৩ সালের ১৩ মার্চ পোপ ফ্রান্সিস সাদামাটা সাদা পোশাকে সেন্ট পিটার্স মহাগির্জার বারান্দায় এসে দাঁড়ান। তাঁর আসল নাম ছিল হোর্হে মারিও বারগোগ্লিও। পোপ হওয়ার পর সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ফ্রান্সিস নাম গ্রহণ করেন। সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসি ছিলেন ত্রয়োদশ শতকের একজন ধর্ম প্রচারক ও পশুপ্রেমী।
পোপ ফ্রান্সিস জাঁকজমক আর আড়ম্বরের চেয়ে বিনয়কে প্রাধান্য দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি পোপের জন্য নির্ধারিত লিমুজিন গাড়ি ব্যবহারের চেয়ে অন্য কার্ডিনালদের সঙ্গে বাসে করে বাড়ি ফিরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ পছন্দ করতেন।
নতুন পোপ ১২০ কোটি ক্যাথলিক অনুসারীর জন্য একটি নৈতিক বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আহ, আমি গরিবদের জন্য একটি গরিব চার্চ চাই।’
ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসেবে তাঁর শেষ প্রকাশ্য কার্যক্রম ছিল ইস্টার সানডেতে সেন্ট পিটার্সের বারান্দায় উপস্থিত হয়ে হাজারো খ্রিষ্টধর্ম অনুসারীর উদ্দেশে হাত নাড়া। হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় ভোগার কয়েক সপ্তাহ পর তিনি এই কাজ করেছিলেন।
হোর্হে মারিও বারগোগ্লিও ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তাঁর মা–বাবা ফ্যাসিবাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ইতালি ছেড়ে আর্জেন্টিনায় এসেছিলেন।
তরুণ বয়সে তিনি ট্যাঙ্গো নাচ উপভোগ করতেন এবং স্থানীয় ফুটবল ক্লাব সান লরেঞ্জোর একজন সমর্থক ছিলেন।
একবার গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বেঁচে ফেরেন। তবে এ কারণে তাঁর ফুসফুসের একটি অংশ কেটে ফেলতে হয়েছিল। ফলে সারা জীবনই তিনি সংক্রমণের ঝুঁকিতে ছিলেন।
বৃদ্ধ বয়সে পোপ ফ্রান্সিস ডান হাঁটুতে ব্যথায় ভুগতেন। আর এটিকে তিনি ‘শারীরিক অপমান’ হিসেবে বর্ণনা করতেন।
তরুণ বারগোগ্লিও নাইটক্লাবের বাউন্সার ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। পরে তিনি কেমিস্ট হিসেবে পড়াশোনা শেষ করেন।
একটি স্থানীয় কারখানায় বারগোগ্লিও এস্তের বালেস্ত্রিনোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন, যিনি আর্জেন্টিনার সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেন।
পরে তিনি যিশু সমাজভুক্ত হন। দর্শনে পড়েন এবং সাহিত্য ও মনোবিজ্ঞান পড়ান। এক দশকের মধ্যে তিনি যাজক নিযুক্ত হন এবং দ্রুত উন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে আর্জেন্টিনার প্রাদেশিক প্রধান (প্রভিন্সিয়াল সুপিরিয়র) নিযুক্ত হন।
আছে অভিযোগও
অনেকেই মনে করেন, আর্জেন্টিনার বর্বর সামরিক শাসকদের বিরোধিতা করতে বারগোগ্লিও যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ‘ডার্টি ওয়ার’ নামে পরিচিত সময়ে যখন হাজার হাজার মানুষ নির্যাতনের শিকার হন, নিখোঁজ হন বা নিহত হন—তখন দুই যাজককে সামরিক বাহিনী অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বারগোগ্লিওর সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।
ওই দুই যাজককে নির্যাতন করা হলেও পরে তাঁদের জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাঁরা তখন মাদকাচ্ছন্ন ও আধা-বস্ত্রহীন অবস্থায় ছিলেন।
বারগোগ্লিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ওই দুই যাজকের দরিদ্র পাড়ায় কাজ করতে চার্চের অনুমোদনপ্রাপ্ত ছিলেন বলে তিনি কর্তৃপক্ষকে জানাননি। যদি তা সত্য হয়, তাহলে সেটি তাঁদের শাসকশ্রেণির কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তবে এই অভিযোগ তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, তিনি নীরবে তাঁদের মুক্তির জন্য কাজ করেছিলেন।
২০১৪ সালে শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে পোপ ফ্রান্সিস তৎকালীন ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেস (বাঁয়ে) এবং তাঁর ফিলিস্তিনি প্রতিপক্ষ মাহমুদ আব্বাসকে একত্রিত করেছিলেন.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আর জ ন ট ন র ব রগ গ ল ও কর ছ ল ন র জন য ক জ কর করত ন প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
সব্যসাচী কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন
প্রথিতযশা অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন সব্যসাচী মানুষ। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তাঁর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের ধারণ করতে হবে।
জ্ঞানতাপস কাজী মোতাহার হোসেনের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতা, বৃত্তি, পদক, পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট।
অনুষ্ঠানে ‘যুগলের বন্ধন: কাজী নজরুল ইসলাম-কাজী মোতাহার হোসেন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। তিনি দুই বন্ধুর সম্পর্কের রসায়নের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এই অনুষ্ঠানের দুটো প্রাপ্তি আছে। প্রথমত, মানুষের অবদান ও মেধাকে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই উপমহাদেশের একজন প্রথিতযশা সব্যসাচী মানুষের ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে।
কাজী মোতাহার হোসেন যেকোনো বিবেচনায় একজন দার্শনিক বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রথম সারির পরিসংখ্যানবিদ, বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি অনেকগুলো সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। একজন মানুষের ছোট জীবদ্দশায় এত গুণ সন্নিবেশিত করা কঠিন। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
সবাইকে নিয়ে চলা, প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, নিজের জগতের বাইরে নানা কিছুতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঐতিহ্য কাজী মোতাহার হোসেন করে গেছেন বলে উল্লেখ করেন নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি বলেন, তাঁর সম্মানে যাঁরা আজ স্বীকৃতি পেলেন, তাঁরা এই ঐতিহ্যকে ধারণ করবেন। এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সে বার্তা দেবেন। যেসব শিক্ষার্থী সম্মাননা পাচ্ছেন, তাঁদের ছোট প্রোফাইল তৈরি করে ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মাজেদ বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন একজন সব্যসাচী মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তাঁর পদচারণা ছিল না। তিনি দাবা খুব পছন্দ করতেন। দাবা খেলার কথা শুনলে তিনি ছুটে যেতেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তাঁর শোনা নানা গল্প তিনি স্মৃতিচারণা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাফর আহমেদ খান বলেন, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন। বিজ্ঞান, দাবাচর্চারও পথিকৃৎ ছিলেন। এমন কোনো পুরস্কার নেই যে, তিনি পাননি। তাঁর দেখানো পথে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলোকিত করতে পারেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রওনাক হোসেন। এই আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেরা শিক্ষার্থীদের বই, নগদ অর্থ ও সনদ তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।