আমরা সাধারণত চাঁদকে রাতের পর রাত তারার আকাশে রুপালি থালার মতো ঝুলে থাকতে দেখি। তবে মাঝেমধ্যে এটি কিছু অসাধারণ রূপ ধারণ করে, যা তার অর্ধচন্দ্র বা পূর্ণিমার অবস্থার চেয়েও আশ্চর্যজনক। কখনও কখনও এটি সম্পূর্ণরূপে অপ্রত্যাশিত লাল রং ধারণ করে। এটিকে অনেকটা অতিপ্রাকৃত কিছু বা বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তনের প্রভাব বলে মনে হতে পারে; কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন– এই কথিত ‘ব্লাড মুন’ কোনো অশনিসংকেত নয়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে।
ব্লাড মুন আসলে কী?
জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা জানান, চাঁদ শুধু একটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় লাল হয়। যখন সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ প্রায় সরলরেখায় সারিবদ্ধ হয় এবং চাঁদ সম্পূর্ণরূপে পৃথিবীর ছায়ায়
ঢেকে যায়। ফলে সৃষ্ট লাল আভাযুক্ত চাঁদ, যা শুধু এই ছায়াবৃত অবস্থায় দৃশ্যমান তাকে ‘ব্লাড মুন’ বলা হয়।
ব্লাড মুন তুলনামূলকভাবে বিরল। গড়ে প্রতিবছর এক থেকে তিনটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হয়। তবে কোনো কোনো বছর একটিও হয় না। আবার সব চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর সব অংশ থেকে দেখা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ দৃশ্যমান পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল চলতি বছরের মার্চ মাসে। সেই পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়েছিল। কখনও কখনও এটি মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। তার আগে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল ২০২২ সালে।
চাঁদ কেন লাল হয়?
টোলেডো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষক জিলিয়ান বর্নাক বলেন, ‘পৃথিবীর ছায়ায় রং থাকাটা অদ্ভুত। কারণ আপনি ভাবতে পারেন, পৃথিবী সম্পূর্ণরূপে আলো আটকে দেয়। পৃথিবী আসলে এমনটাই করে। সব দোষ আমাদের বায়ুমণ্ডলের।’ এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘একটি সহজ বিজ্ঞান পাঠের জন্য প্রস্তুত হোন। প্রথমে আপনাকে যা জানতে হবে তা হলো– বাতাস আলোকে প্রতিসরণ বা বাঁকাতে পারে। একটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের ক্ষেত্রে, সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের সময় বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে সরাসরি আসা কিছু আলো বেঁকে যায় এবং পৃথিবীর ছায়ায় পুনঃনির্দেশিত হয়। পৃথিবীর ছায়ার সবচেয়ে অন্ধকার অংশ, যেখানে চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ অবস্থান করে তাকে বলা হয় আম্ব্রা।’ জিলিয়ান বলেন, ‘সূর্যের রশ্মি বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গ দিয়ে তৈরি। নীল আলোর তরঙ্গ সবচেয়ে ছোট এবং পৃথিবীতে আঘাত করলে তা ছড়িয়ে পড়ে; কিন্তু লাল আলোর তরঙ্গ দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। এই আলো ছায়ার মধ্য দিয়ে যেতে পারে। আপনি বলতে পারেন, পৃথিবীর ছায়ায় সবসময় গ্রহজুড়ে একই সময়ে ঘটতে থাকা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের একটি ক্ষুদ্র অংশ থাকে। যখন এই লাল আলো আম্ব্রায় চাঁদে আঘাত করে, তখন চাঁদ লাল দেখায়। এটিই ব্লাড মুনের কারণ!’
ব্লাড মুন কতটুকু লাল হয়?
একটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের রং গাঢ় কমলাবর্ণ থেকে লালচে হয়। মজার বিষয় হলো– প্রতিটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় এই বর্ণ কিছুটা পরিবর্তিত হয়। কারণ প্রতিবার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কিছু পার্থক্য থাকে। আকাশে দূষণ, মেঘ, ধুলো বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কণার কারণেও এই পরিবর্তন হতে পারে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান লাডা। পরবর্তী ‘ব্লাড মুন’ হবে এ বছরের ৭ সেপ্টেম্বর, যা এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার কিছু অংশে দৃশ্যমান হবে। যুক্তরাষ্ট্রে দৃশ্যমান পরবর্তী ব্লাড মুন হবে আগামী বছরের ৩ মার্চ।
নাসা জানিয়েছে, ব্লাড মুন দেখতে আপনার কোনো বিশেষ সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই। একমাত্র জিনিস যা বিষয়টি জটিল করতে পারে, তা হলো মেঘ।v
রিডার্স ডাইজেস্ট অবলম্বনে
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি