‘বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি—/ ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্ণ ভ’রে’—ধান আর অগ্রহায়ণ বহুকাল এভাবে পরস্পর জড়িয়ে আছে। অগ্রহায়ণের কোনো এক বিকেলে কৃষকের উঠান ভরা ধান দেখেই হয়তো রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ একদিন বুনেছিলেন অমন পঙ্ক্তিগুলো। ঘরে ঘরে ফসল তোলার এই ছবি আর কার কবিতায় এত মায়াময় হয়ে ধরা পড়েছে?
হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ–পূর্বের বিস্তীর্ণ এ প্লাবন সমভূমিতে ধান চাষের ইতিহাস বহু প্রাচীন। শত শত নদীবিধৌত উর্বর জনপদটির কৃষকেরা সেই কবে পানি সেচে ধান চাষ শুরু করেছিলেন—তা খ্রিষ্টের জন্মেরও দেড় হাজার বছর আগে। এই ধানের সঙ্গে বাংলার কৃষকের সম্পর্ক রক্তে মেশা।
কৃষকেরা যখন ধান কাটা, মাড়াই আর শুকানোর কাজে ব্যস্ত, তখন ৯০ শতাংশ নারীই হয়ে ওঠেন ডোলের শিল্পে সচল।সেই ধান চাষে কত রকমের বন্ধন আছে, মায়া আছে। আছে সংরক্ষণের কত মাধ্যম। সময়ের সঙ্গে ধান চাষ, ধান তোলা ও সংরক্ষণের ধরন বদলেছে। তবু কিছু আছে—সেই পুরোনো, সেই আদিম, সংসারের সঙ্গে মিলেমিশে। ধান রাখার এ রকম আদি উপকরণের একটি ডোল। ধান সংরক্ষণের জন্য বাঁশের তৈরি বিশেষ এই উপকরণের এখনো দেখা মেলে অনেক কৃষকের ঘরে। এ দেশের প্রধান ফসল ধান এই ডোলেই যেন নিশ্চিত আশ্রয়ে থাকে।
গোলাকার ডোল সাধারণত তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু। নিচের অংশ চার কোণাকৃতির। ছোট আকারের ডোলে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মণ এবং বড় আকারের ডোলে ২০ মণ পর্যন্ত ধান রাখা যায়। ঘরের এক কোণে নিভৃতে তার ঠাঁই।
এই ডোল তৈরি করে পাবনার বেড়া পৌরসভার অনেক নারী বাড়তি আয় করেন, জীবিকার নির্ভরতা খোঁজেন। পাকা ধানের মৌসুমে পৌরসভার শেখপাড়া মহল্লায় ডোল তৈরির ধুম পড়ে। কৃষকেরা যখন ধান কাটা, মাড়াই আর শুকানোর কাজে ব্যস্ত, তখন ৯০ শতাংশ নারীই হয়ে ওঠেন ডোলের শিল্পে সচল।
সারা বছর বাঁশজাত সামগ্রী বানিয়ে যা আয় হয়, বোরো মৌসুমের মাত্র দু-তিন মাসে শুধু ডোলেই তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আয় করেন তাঁরা।বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার কৃষকদের ডোলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি পূরণ করেন শেখপাড়ার নারীরা। মহল্লার প্রায় ২০০ পরিবারের মধ্যে অন্তত ১৮০টি পরিবারের প্রায় সব নারীই ডোল বোনার কাজে জড়িত। সারা বছর তাঁরা বাঁশের চাটাইসহ বাঁশজাত অন্যান্য সামগ্রীও তৈরি করেন। বোরো মৌসুমে ডোল তৈরিই প্রধান কাজ। ধান কাটার মাস দুয়েক আগেই শুরু হয় ডোল বানানো।
সম্প্রতি শেখপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী নারী ডোল বুনছেন। কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ বেতি বা শলা চাঁচছেন, কেউ ব্যস্ত ডোল বোনা ও বাঁধার কাজে। বারান্দা, উঠান ও গাছের ছায়ায় যে যেখানে পারেন সেখানে বসেই এ কাজ করছেন। মহল্লাটির নারীরা ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ডোল বোনার কাজ করছেন।
ডোল তৈরির নারীরা জানান, ডোলসহ বাঁশজাত সামগ্রী তৈরির কাজ মূলত নারীরাই করেন। পুরুষেরা বাঁশ কেনা ও তৈরি করা সামগ্রী বিক্রিতে সহায়তা করেন। সারা বছর বাঁশজাত সামগ্রী বানিয়ে যা আয় হয়, বোরো মৌসুমের মাত্র দু-তিন মাসে শুধু ডোলেই তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আয় করেন তাঁরা।
দুই উপজেলার কয়েকটি হাটে গিয়ে দেখা গেল, সারি সারি করে ডোল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিক্রি হচ্ছে। আকারভেদে একেকটির দাম ৪০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। সাঁথিয়ার করমজা চতুরহাটে শহীদনগর গ্রামের কৃষক আজগার আলী বড় আকারের দুটি ডোল কিনেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ বিঘা জমিতে ১২০ মণের বেশি ধান হয়েছে তাঁর। দুই ডোলে প্রায় ৪০ মণ ধান সংরক্ষণ করবেন, বাকিটা বিক্রি করে দেবেন।
শেখপাড়ার রেখা বেগম, রূপা খাতুন, রোকেয়া খাতুন, ফুলমতি, কুলসুম বেগমসহ কয়েকজন নারী জানান, সারা বছর তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন, কখন আসবে বোরো মৌসুম। ধান কৃষকের ঘরে ওঠা মানেই ডোলের চাহিদা বেড়ে যাওয়া। এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। ডোলের চাহিদাও বেড়েছে। দামও পাচ্ছেন বেশি। সংসারের কাজ করেও প্রত্যেকে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ শ টাকা আয় করছেন।
স্থানীয় মৈত্রবাঁধা মহিলা সমবায় সমিতির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক শিখা রাহা বলেন, ধানের ফলন ও দাম ভালো হলে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। সেই হাসি শেখপাড়ার নারীদেরও ছুঁয়ে যায়। কারণ, ধানের সঙ্গে রয়েছে এখানকার নারীদের ডোলের এক নিবিড় বন্ধন। মহল্লাটির বেশির ভাগ নারী বাঁশজাত হস্তশিল্পের কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। ডোল বানিয়ে অনেক পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মুঘল ঐতিহ্যের মিষ্টি নিয়ে যাত্রা শুরু করল ‘হেরিটেজ সুইটস’
মুঘল ঐতিহ্যের মিষ্টি নিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হলো ‘হেরিটেজ সুইটস’-এর। মঙ্গলবার (২৭ মে) বসুন্ধরা আবাসিকের সি ব্লকে (আপন মার্ট-২-এর পাশে) ‘হেরিটেজ সুইটস’-এর আউটলেট উদ্বোধন করা হয়।
মুঘল সম্রাটদের রাজসভা ও উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল বাহারি ও সুস্বাদু মিষ্টান্ন। সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে হেরিটেজ সুইটস-এ পরিবেশিত হবে আদি রসগোল্লা, কমলাভোগ, দিল্লী চমচম, ভোগসাগর, গুলাব-জমুন, ছানার জিলেবিসহ আরো নানান ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি।
প্রতিটি মিষ্টি তৈরি করা হয়েছে প্রাচীন মুঘল রেসিপি অনুসারে, যেখানে আধুনিক স্বাস্থ্যবিধি, দক্ষ কারিগর ও উৎকৃষ্ট মানের উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে স্বাদ ও গুণগতমান। গ্রাহকদের স্বাস্থ্য ও স্বাদ দুটোই মাথায় রেখে, প্রতিটি পদে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বোচ্চ মানের উপকরণ ও পরীক্ষিত প্রাচীন পদ্ধতি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে আইসিসিবি-র চিফ অপারেটিং অফিসার এম এম জসীম উদ্দীন বলেন, “আইসিসিবি হেরিটেজ সুইটস শুধু একটি মিষ্টির আউটলেট নয়, বরং এটি একটি অভিজ্ঞতা—যেখানে আপনি ফিরে পাবেন মুঘল আমলের রাজকীয় আতিথেয়তা ও স্বাদের ঐতিহ্য। বাংলার মুঘল ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অনন্য নিদর্শন হচ্ছে আমাদের মিষ্টান্ন। সেই ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে আমরা আইসিসিবি হেরিটেজ সুইটস-এর যাত্রা শুরু করেছি।”
তিনি আরো বলেন, “মুঘল যুগের অনবদ্য স্বাদ, পরিবেশনা ও সৌন্দর্যকে আধুনিক স্বাস্থ্যকর উপায়ে পরিবেশন করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা বিশ্বাস করি, খাদ্য শুধু স্বাদ বা পুষ্টির উৎস নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিরও বাহক। তাই, আমাদের প্রতিটি মিষ্টি তৈরি হয়েছে প্রথাগত রেসিপি ও উৎকৃষ্ট উপকরণে, যাতে পুরোনো দিনের স্বাদ ও গুণ বজায় থাকে।”
আইসিসিবি হেরিটেজ সুইটস এর আউটলেটের পরিবেশে ফুটে উঠেছে মুঘল আমলের স্থাপত্য ও সৌন্দর্য, যা গ্রাহকের মুহূর্তকে করে তুলবে আরো স্মরণীয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ঢাকা/চিশতী/ফিরোজ