প্রতিটি নতুন প্রাণের আগমন যেমন আনন্দের, তেমনি প্রতিটি মায়ের সুস্থভাবে সন্তানের জন্ম দেওয়া যেন এক যুদ্ধ জয়ের নামান্তর। অথচ সেই যুদ্ধে এখনো প্রতিদিন বাংলাদেশে অনাকাঙ্ক্ষিত পরাজয় ঘটে। হারিয়ে যায় একেকটি সম্ভাবনাময় জীবন।
আজ বুধবার (২৮ মে) নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। অথচ এই দিনে যখন মাতৃত্বের মর্যাদা আর সুরক্ষা নিয়ে কথা বলার কথা, তখন পরিসংখ্যান বলছে—দেশের অর্ধেকের বেশি মা এখনো নিরাপদ প্রসবের সেবা থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশে এখনো প্রতি লাখ জীবিত শিশুর জন্মে মারা যান ১৩৬ জন মা। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৭০-এ নামিয়ে আনার অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সেই অঙ্গীকারের ব্যবধান এখনও চোখে পড়ার মতো।
আরো পড়ুন:
মা দিবসে গদ্য-গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় সেরা লেখক হলেন যারা
কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে দাম দিতে হবে : উপদেষ্টা
গর্ভধারণ হওয়ার আগে চিকিৎসকের শরণ নেওয়া বা নিজ দেহ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির চর্চা এখনও অনেক নারীর জীবন থেকে অনুপস্থিত। অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড বা অতিরিক্ত ওজনের মতো শারীরিক সমস্যাসহ গর্ভধারণ করেন। ফলস্বরূপ, ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা.
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, একটি সুস্থ গর্ভাবস্থার জন্য অন্তত চারবার প্রসব-পূর্ব সেবা নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৩৯ শতাংশ নারী এই সেবা পাচ্ছেন। অর্থাৎ ৬১ শতাংশ নারী এখনও সেই ন্যূনতম সেবাটুকুও পান না। গ্রামাঞ্চলে এই অবস্থা আরো শোচনীয়, সেখানে ৬৪ শতাংশ নারী গর্ভকালীন সেবা থেকে বঞ্চিত। শহরেও অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, ৪৩ শতাংশ নারী পাচ্ছেন না এই সেবা। এমনকি ২ শতাংশ নারী একবারও চিকিৎসকের মুখ দেখেননি গর্ভাবস্থায়।
বাসাবাড়িতে প্রসব এবং অদক্ষ ধাত্রীর হাতে জীবন
গবেষণা বলছে, এখনো ৩৬ শতাংশ নারী বাসাবাড়িতেই সন্তান প্রসব করছেন। আর এর অধিকাংশই অদক্ষ ধাত্রীর হাতে। শহরের তুলনায় গ্রামে এই হার ১৪ শতাংশ বেশি। অথচ বাসাবাড়িতে প্রসব মানেই জীবনহানির সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া। এ প্রসঙ্গে ডা. কাজল বলেন, “বাড়িতে প্রসূতি মৃত্যুটা এক ধরনের অপমৃত্যু। এমন মৃত্যু হলে তদন্ত হওয়া জরুরি। নইলে যত কমিউনিটি ক্লিনিকই খোলা হোক, তাতে লাভ হবে না।”
স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও বৈষম্য
অঞ্চলভেদে স্বাস্থ্যসেবার যে বৈষম্য, সেটি মাতৃত্বকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। শহরে যেখানে সরকারি হাসপাতালে সন্তান প্রসবের হার ৩৪ শতাংশ, গ্রামে সেটি ২৪ শতাংশ। মোটের ওপর সরকারি হাসপাতালে সন্তান প্রসব হচ্ছে মাত্র ২৬ শতাংশ মায়ের, যা বাসাবাড়িতে প্রসবের চেয়ে কম। অনেক সময় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে রোগী রেফার করা হলেও, আগের চিকিৎসা কেন্দ্র আর দায়িত্ব নেয় না। ফলে ঝুঁকিতে পড়েন প্রসূতি ও তার পরিবার।
নিরাপদ মাতৃত্বের পথে বড় বাধা
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো- বাল্যবিবাহ। ১৫ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার এখন ৮ দশমিক ২ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয় ৪২ শতাংশ নারীর। এই বয়সে সন্তান ধারণের ফলে শরীর ও মনের উপর যে ভয়াবহ চাপ পড়ে, তা মাতৃত্বকে আরো অনিরাপদ করে তোলে।
এবারের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মাতৃস্বাস্থ্যের সমতা, বাদ যাবে না কোনো মা’। চমৎকার এক স্লোগান। কিন্তু বাস্তবে বাদ পড়ছেন শত শত মা। বাদ পড়ছে সেবার সুযোগ থেকে, সচেতনতার আলো থেকে, আর সবচেয়ে করুণভাবে জীবনের অধিকার থেকে।
গর্ভধারণের আগে ও পরে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে দক্ষ ধাত্রী ও চিকিৎসক নিয়োগ জরুরি। প্রসব-পূর্ব সেবাকে বাধ্যতামূলক করতে সচেতনতা এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা দরকার। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর ও কার্যকর আইনি প্রয়োগ। গর্ভকালীন পুষ্টি ও সচেতনতা বৃদ্ধি পদক্ষেপ জরুরি। বাড়িতে মাতৃমৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত ও দায় নিরূপণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। রেফারেল ব্যবস্থাকে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।
বাংলাদেশ সচিবালয়ের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাবিহা জাহান বলেন, “মাতৃত্ব শুধুই একটি নারীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় দায়। প্রতিটি সুস্থ মা মানে একটি সুস্থ প্রজন্ম। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে সেই দায়বদ্ধতার কথা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে আবারো মনে করিয়ে দেয়ার সময় এখন। নয়তো প্রতিটি বছর দিবস পালিত হবে, আর শত শত মা হারিয়ে যাবেন নীরবে একটি অনিরাপদ সমাজের মূর্ছনাপূর্ণ করুণ ইতিহাসে।”
ঢাকা/এএএম/ফিরোজ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ বস ন র পদ ম ত ত ব প রসব
এছাড়াও পড়ুন:
মঙ্গলবার কুয়াকাটায় রাস উৎসব, গঙ্গা স্নান বুধবার
প্রায় ২০০ বছর ধরে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মদনমোহন সেবাশ্রম মন্দির ও কুয়াকাটার রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরে পৃথক আয়োজনে রাস উৎসব পালন করে আসছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এবছরও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে হবে এ উৎসব। রাস উৎসব উপলক্ষে কলাপাড়ায় বসছে ৫ দিনব্যাপী মেলা।
কলাপাড়ায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শেষ সময়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে মন্দিরের আঙ্গিনাসহ রাধা ও কৃষ্ণের ১৭ জোড়া প্রতিমা।
মঙ্গলবার পূর্ণিমা তিথিতে রাত ৯টা ২২ মিনিটে অধিবাসের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে রাস পূজার আনুষ্ঠানিকতা। পরের দিন বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ৬ মিনিটে এ তিথি শেষ হবে। সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কুয়াকাটা সৈকতে গঙ্গা স্নান করবেন পুণ্যার্থীরা। এর পর মন্দিরের আঙ্গিনায় রাধা-কৃষ্ণের যুগল প্রতিমা দর্শন করবেন তারা। তাই, দুই মন্দিরেই ১৭ জোড়া প্রতিমা বানানো হয়েছে। প্যান্ডেল সাজানোর কাজ শেষ। চলছে লাইটিং ও সাজসজ্জার কাজ।
এ উৎসব উপলক্ষে কলাপাড়ার মন্দির প্রাঙ্গণ, কুয়াকাটার মন্দির প্রাঙ্গণ ও সৈকতে অস্থায়ীভাবে বসছে শতাধিক পোশাক, প্রসাধনী, খেলনা ও গৃহস্থালী সামগ্রীর দোকান। কুয়াকাটায় তিন দিনব্যাপী উৎসব হলেও কলাপাড়ায় এ উৎসব চলবে পাঁচ দিন। এসব দোকানে অন্তত ৩০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির আশা করছেন আয়োজকরা।
কলাপাড়ার শ্রী শ্রী মদনমোহন সেবাশ্রমের রাস উদযাপন কমিটির সভাপতি দিলীপ কুমার হাওলাদার বলেছেন, আজকের মধ্যেই আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। হিন্দু ধর্মালম্বীদের এ উৎসব হলেও এখানে ৫ দিনব্যাপী মেলায় সব ধর্মের মানুষের আগমন ঘটে। আমাদের মন্দির প্রাঙ্গণে অন্তত ৭০টি দোকান বসেছে। আশা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে রাস উৎসব সম্পন্ন হবে।
কুয়াকাটার রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন মন্ডল বলেছেন, আগামীকাল রাতভর মন্দির প্রাঙ্গণে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলবে। পরদিন সকালে গঙ্গা স্নান হবে। লাখো পুণ্যার্থীর আগমনের আশা করছি আমরা। বুধবারও গঙ্গা স্নান হবে। উৎসব উপলক্ষে আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউসার হামিদ বলেছেন, রাস উৎসব উপলক্ষে কুয়াকাটায় ১ লাখ পুণ্যার্থী সমাগমের আশা করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।
ঢাকা/ইমরান/রফিক