বাংলাদেশের জনগণের অণুপুষ্টি (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতি মোকাবিলা তথা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিঃসন্দেহে এটি একটি মাইলফলক। দেশে ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হয়। ভোক্তারা তেলের রং দেখে নিশ্চিত হয়ে সেটি কিনতে চান। স্বচ্ছ প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের আড়ালে অজান্তে কী ঘটে যাচ্ছে সেই স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে অনেকেই জানেন না।

কী দোকানে, কী রান্নাঘরে সর্বত্রই ভোজ্যতেলের স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বোতলটি আলোতেই রাখা হয়। ভোজ্যতেলে মিশ্রিত ভিটামিন এ প্রত্যক্ষ সূর্যালোক, পরোক্ষ আলো (সেমি-ডার্ক) এবং সাধারণ বাল্বের আলোর সংস্পর্শে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্বচ্ছ বোতলে সংরক্ষিত ভিটামিনযুক্ত ভোজ্যতেলের ভিটামিন কয়েক মাসের মধ্যেই কমে যায়। এমনকি অক্সিজেনের উপস্থিতি এবং তেলের পারঅক্সাইড মান (অক্সিডেটিভ স্ট্যাটাস) বেশি হলে এই ক্ষয় আরও ত্বরান্বিত হয়ে গুণগত মান কমে যায়। ফলে, আমাদের অজ্ঞতার কারণে জনগণের পুষ্টির ঘাটতি পূরণের সরকারি প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে কোনো তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের স্বাভাবিক আলো এবং অতিবেগুনি (ইউভি) রশ্মি ভোজ্যতেলের ভিটামিনের জন্য ক্ষতিকর। রেটিনল এবং রেটিনাইল পালমিটেট, ভিটামিন এ-এর রূপ। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে আলোর প্রভাবে আইসোমারাইজেশন প্রক্রিয়ায় ভিটামিনের আণবিক বিন্যাস পরিবর্তন অর্থাৎ ‘ট্রান্স’ থেকে ‘সিস’ হওয়াতে ভোজ্যতেলের অনেক ক্ষতি হয়, যথা (ক) ভিটামিন ‘এ’-এর কার্যকারিতা কমে যায়; (খ) জৈবলভ্যতা (বায়োঅ্যাভেইলেবিলিটি) কমে যায় এবং (গ) সুগন্ধ, দুর্গন্ধ এবং সার্বিক সংবেদনশীল বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আসে।  

ভোজ্যতেলে অণুপুষ্টি বজায় রাখতে আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ প্যাকেজিং ব্যবহার একটি কার্যকরী সমাধান। ব্যয় সাশ্রয়ী সমাধানও অনেক আছে। এ ক্ষেত্রে, ভোজ্যতেলের মান অক্ষুণ্ন রাখতে পাউচপ্যাক, লেমিনেটেড পিইটি বোতল, এইচডিপিই জার, ইউভি দ্রব্য মিশ্রিত বোতল ব্যবহার করা যায়। অস্বচ্ছ বোতলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি আলোক রশ্মিকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। সাধারণ স্বচ্ছ বোতলে আলো সহজেই ঢুকে পড়ে, কিন্তু অস্বচ্ছ বোতল বাইরের আলোক রশ্মিকে আটকে দেয় এবং তেলের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন রাখতে সাহায্য করে। এই ধরনের প্যাকেজিং অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তেলকে রক্ষা করে। এর ফলে তেলের ভেতরে থাকা ভিটামিন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুলো দীর্ঘসময় ভালো থাকে। পণ্যের শেলফ লাইফ বা সংরক্ষণ সময় বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ বোতলে সংরক্ষিত তেলে ভিটামিনের স্থায়িত্বকাল প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, অস্বচ্ছ প্যাকেজিং ব্যবহারের ফলে তেলের স্বাদ, গন্ধ এবং রঙেরও কোনো পরিবর্তন হয় না, যা ভোক্তার জন্য একটি বাড়তি সুবিধা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোজ্যতেলে আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ প্যাকেজিংয়ের ব্যবহার আলোক রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তেলকে রক্ষা করতে পারে, যা পুষ্টির ঘাটতি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। 

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, অনেক উন্নত দেশেও ভোজ্যতেলের স্বচ্ছ প্যাকেজিং আছে। এ কথা ঠিক, তবে ওই সব দেশে ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতি যদি না থাকে সে ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ প্যাকেজিংয়ের প্রয়োজন হয় না বা ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতি থাকলেও অন্য খাদ্য ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ করে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশেই ভোজ্যতেল সংরক্ষণের জন্য অস্বচ্ছ প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সৌদি আরব, ভারত ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যে অস্বচ্ছ বোতল ব্যবহার শুরু করেছে, যা ভিটামিন সংরক্ষণে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া, সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ভোজ্যতেলের সঠিক সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে অস্বচ্ছ বোতল ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর সুপারিশ অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্যের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আলো প্রতিরোধী প্যাকেজিং ব্যবহার করা উচিত, যা বাংলাদেশেও দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

ভোজ্যতেলে গুণগত প্যাকেজিং ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারকে এখনই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি ব্রান্ডিংয়ের সুবিধা নেওয়ার জন্য উৎপাদক এবং রিফাইনারি কোম্পানিগুলো নিজ স্বার্থে অস্বচ্ছ প্যাকেজিং চালুর উদ্যোগ নিতে পারে। সরকার ২০২২ সালে একটি নির্দেশনায় ভোজ্যতেল শতভাগ প্যাকেজিং করার কথা বলেছে কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। এ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা পর্যালোচনা করে সরকার উৎপাদক এবং রিফাইনারি কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, অস্বচ্ছ প্যাকেজিং ব্যবস্থায় উত্তরণে গড় খরচ বেড়ে যেতে পারে। তা কত হতে পারে এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তদুপরি, বর্তমানের স্বচ্ছ প্যাকেজিংয়ের কারণে যে রোগের আক্রমণ হতে পারে তাতে কত টাকার ক্ষতি হতে পারে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। অর্থাৎ উভয় প্রক্রিয়ার কস্ট বেনিফিট বা সুবিধা আর ক্ষতির বিশ্লেষণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এসব হিসাবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে দেখা যাবে এ কাজটি ‘করার ব্যয়, না করার ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম’। প্রয়োজনে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতিগত সহায়তা দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভোজ্যতেল প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে আলোপ্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যের ওপর আরও বেশি জোর দেন। ভোক্তার মধ্যে এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তা যদি সচেতন হন এবং স্বচ্ছ বোতলের তেল ক্রয় করতে নিরুৎসাহিত হন তাহলে উৎপাদক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত হবে। প্রসঙ্গত, ইতোমধ্যে দেশে কিছু কিছু স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা এ নিয়ে প্রচারাভিযান শুরু করেছে। সেসব সংগঠন দেশব্যাপী সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। 

বাংলাদেশে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে দেশের আপামর জনসাধারণের অণুপুষ্টির ঘাটতি পূরণ হয়। মানবদেহের জন্য ভিটামিন ‘এ’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এখন সচেতন কারও অজনা নেই। কিন্তু ভালোর জন্য গৃহীত একটা সিদ্ধান্ত স্রেফ সঠিক ধারণার অভাবে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়। ভোজ্যতেলের অস্বচ্ছ প্যাকেজিং নিশ্চিত করা হলে জনগণই তার সুফল পাবে এবং একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ স্বাস্থ্যবান জাতি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
 
মুশতাক হাসান মুহ.

ইফতিখার, স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব
mustak.iftekhar@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জনস ব স থ য ভ জ যত ল র ন শ চ ত কর স রক ষ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব: সালাহউদ্দ

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুর সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব।’’

তিনি মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান এলে যেকোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া ঠেকানো যাবে।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘আগামী নির্বাচনকে যদি অনিশ্চিত করা হয় বা বিলম্বিত করা হয়, তাহলে তার সুযোগ নেবে ফ্যাসিবাদী বা অসাংবিধানিক শক্তি। এর পরিণতি জাতি অতীতে বহুবার ভোগ করেছে। আমরা আবার সে পরিস্থিতি চাই না।’’

অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে পৃথক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সাংবিধানিকভাবে এই সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সে দেওয়া সেই মতামত এখনো বহাল আছে। এর বিপরীতে সুপ্রিম কোর্ট কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তাই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা আসলে রাজনৈতিক বক্তব্য, এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’’

সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘যেকোনো সাংবিধানিক আদেশ জারি হলে তা আগামীকাল বা পরশু চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমরা এমন খারাপ নজির জাতির সামনে আনতে চাই না। তাই সমাধানের বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। সবাইকে বিবেচনায় নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’’

পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের অধিকার আছে। তবে পিআর পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, শেষ পর্যন্ত জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।’’

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘‘পিআর পদ্ধতিতে ঝুলন্ত পার্লামেন্টের ঝুঁকি থেকে যায়। তাতে রাষ্ট্র ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব হয় না। আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারি না।’’

সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘জনগণই হলো সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। এই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বারবার গণতন্ত্রকে সংকট থেকে উদ্ধার করেছে।’’

আগামী সংসদে কিছু মৌলিক বিষয়ে সংশোধনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘‘আমরা কিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে একমত হয়েছি। তবে, ঐকমত্য কমিশনের সনদের ভেতরে যেসব পরিবর্তন হবে, সেগুলোতে অবশ্যই গণভোট নিতে হবে।’’

ঢাকা/আসাদ/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব: সালাহউদ্দ
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • হুংকার দিয়ে জাতীয় নির্বাচন ঠেকান যাবে না: জাহিদ হোসেন
  • মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন 
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
  • জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে
  • ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি
  • জামায়া‌তের তিন‌ দি‌নের কর্মসূচি ঘোষণা