বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ। এখানকার বনজ, জলজ ও খনিজ সম্পদের বৈচিত্র্য আমাদের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি নাগরিক অসচেতনতার কারণে পরিবেশের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

এ বাস্তবতায় পরিবেশ রক্ষায় নানা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে বটে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই আইনগুলো কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং তা বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রেই–বা কোন কোন সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আইন রয়েছে, যেমন ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত), ১৯২৭ সালের বন আইন, ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, একই বছরের পানি আইন এবং ২০২১ সালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা।

এসব আইনের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ), বনভূমি সংরক্ষণ, বায়ু ও পানিদূষণ রোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে।

এসব আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

যদিও এসব আইনে পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু তা প্রধানত পরোক্ষ এবং সহায়ক।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরই পরিবেশ সংরক্ষণের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

আরও পড়ুন‘গণতান্ত্রিক’ পুলিশি ব্যবস্থার রূপরেখা যেমন হতে পারে২০ মার্চ ২০২৫

এই আইনের ৪ ক(১) উপধারায় বলা হয়েছে, মহাপরিচালক বা তাঁর অধীন কোনো কর্মকর্তা প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাইতে পারবেন এবং উক্ত সংস্থাকে তা প্রদান করতে হবে।

তবে এখানেও পুলিশের ভূমিকাকে নির্ধারিত কোনো কর্তৃত্বের রূপে বিবেচনা করা হয়নি।

বন আইন, ১৯২৭-এ কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এই আইনের ৫২ ধারায় পুলিশের বাজেয়াপ্তযোগ্য সম্পত্তি জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

৬৪ ধারায় পরোয়ানা ব্যতীত বন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সুযোগ আছে এবং ৬৬ ধারায় বন অপরাধ প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

৭৯ ধারায় স্থানীয় জনগণ বন অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে, এমন বিধান রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বন আইনের ক্ষেত্রে পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা কিছুটা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।

অন্যদিকে ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং বন বিভাগের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা আইন প্রয়োগের ক্ষমতা রাখেন।

তবে এই আইনে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরাসরি কোনো ভূমিকার উল্লেখ নেই।

আরও পড়ুনপুলিশ সংস্কার কি আদৌ হবে, কতটুকু হবে২৯ মার্চ ২০২৫

একই অবস্থা দেখা যায়, ২০১৩ সালের পানি আইন এবং ২০২১ সালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালাতেও। পানি আইনের নির্বাহী কমিটিতে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিত্ব থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের অংশগ্রহণের কোনো স্থান নেই।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে; পুলিশের উল্লেখ নেই।

সার্বিকভাবে বলা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণে প্রচলিত আইনে পুলিশকে সহায়ক ভূমিকায় রাখা হয়েছে, তবে তাদের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ সীমিত।

ফলে এসব আইনের বাস্তবায়নে প্রশাসনিক সমন্বয় এবং আন্তপ্রতিষ্ঠানিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

তবে আশাব্যঞ্জক কিছু দিকও রয়েছে। যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) বাধ্যতামূলক হওয়ায় প্রকল্প গ্রহণের আগেই তার পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (ইটিপি) স্থাপন করা হয়েছে। বন আইন প্রয়োগ করে কয়েকটি অঞ্চলে সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষণা করাও সম্ভব হয়েছে।

আরও পড়ুনপুলিশ কোথাও নরম, কোথাও কেন গরম?২১ জানুয়ারি ২০২৫

তবে সীমাবদ্ধতাগুলো বেশ সুস্পষ্ট। আইন প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পরিবেশবিরোধী কাজকে প্রশ্রয় দেয়।

সাধারণ মানুষ ও অনেক উদ্যোক্তার মধ্যেই পরিবেশ সংরক্ষণসংক্রান্ত আইন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল সীমিত, প্রযুক্তি স্বল্পতায় দূষণের প্রকৃত অবস্থা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবও পরিবেশবিরোধী প্রকল্প অনুমোদনে ভূমিকা রাখছে।

পরিবেশবিষয়ক আইন বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আইন প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো—পুলিশ বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরাসরি অভিযানে পাঠানো বা মামলা করার সুযোগ না থাকায় বাস্তবিক প্রয়োগ দুর্বল থেকে যাচ্ছে।

এ বাস্তবতায় কিছু সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় নিশ্চিত করে, তাদের যথাযথ ক্ষমতায়ন করে পরিবেশ আইনের কঠোর প্রয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্যোগ আরও কার্যকর হতে পারে।

শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়িয়ে জনগণের মধ্যে পরিবেশবিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধি জরুরি। পরিবেশ অধিদপ্তরের বাজেট ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সরাসরি সাধারণ জনগণ, আইনজীবী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণ এবং সে ভিত্তিতে পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তদন্ত ও মামলা করার সুযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর আইন আছে, তবে বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি প্রকট।

এ আইনের প্রয়োগকে শক্তিশালী করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনসচেতনতার সমন্বয় ছাড়া উপায় নেই।

পরিবেশ রক্ষা শুধু আইন বা উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয় নয়—এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। সেই লড়াইয়ে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।

মো.

শাহ্জাহান হোসেন পিপিএম, উপপুলিশ কমিশনার, সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ, ডিএমপি, ঢাকা।
[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত এসব আইন অন য ন য পর ব শ র ই পর ব শ গ রহণ র বন আইন ক ষমত ন আইন আইন র

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের তারিখ এখনো জানা যায়নি, তবে সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। এখন সরকার বা কোনো দলের পক্ষেই নির্বাচনের বাস্তবতা থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। কোন দল কতটা প্রস্তুত, কোন দলের জনসমর্থন কেমন এবং কে আসবে ক্ষমতায়—চায়ের কাপের আড্ডা থেকে শুরু করে সর্বত্র এ নিয়েই আলোচনা চলছে।

এ আলোচনা হচ্ছে পারিবারিক খাবার টেবিলে, গ্রামগঞ্জে, চায়ের দোকানে, শহরের ক্যাফেতে; আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো বটেই। ইন্টারনেটের যুগে এসব আলোচনার কোনো ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নেই।

তবে বেশির ভাগ আলোচনাই এখনো সাময়িক বা টেনটেটিভ—পরিপক্বতার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ আলোচনা।

রাজনীতিতে জনগণ খুঁজছে কিছু আকাঙ্ক্ষিত ফ্যাক্টর

জনগণ এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না—দলগুলোর অবস্থান তাদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে কতটা মেলে এবং কোন দল সত্যিকারে দেশের শাসনক্ষমতা নিয়ে একটি সম্ভাবনাময় সরকার গঠন করতে পারবে। তবে অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যেও কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশির ভাগ মানুষ এখনো দলগত সমর্থনে স্থায়ী বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। জনগণ তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার উপাদানগুলোকে দলগুলোর সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করছে।

যেসব দল শৃঙ্খলাবোধ প্রদর্শন করতে পারছে এবং নিজেদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারছে, এখন পর্যন্ত তারাই তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান বলে মনে হচ্ছে।

একটা বিষয় স্পষ্ট—দেশের জনগণ চায়, প্রতিটি দল তাদের নেতিবাচক কার্যকলাপ থেকে বেরিয়ে আসুক। রাজনীতিতে ক্রমাগত বিশৃঙ্খলা দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আরেকটি বিষয়, যা সাধারণ জনগণের খুবই অপছন্দ, তা হলো রাজনীতিবিদদের বাগাড়ম্বর। যাঁরা সফল হতে চান, তাঁদের শৃঙ্খল ও শালীন হতে হবে।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘রাজনীতিতে ডান ও বামের বিভাজন মুছে যাচ্ছে।’

সত্যিকার অর্থে দেশের মানুষ এখন আর আদর্শিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। গত ৩৫ বছরে আদর্শিক রাজনীতি ‘প্রমোট’ ও প্রচার করতে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা দেশে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের সেই আদর্শ জনগণের কোনো উপকারে আসেনি।

তাই আপাতত আদর্শ ও দফাভিত্তিক রাজনীতি সম্ভবত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বামপন্থী দলগুলো। তারা আদর্শের কলহে রাজনীতির বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছে।

আরেকটি বিষয় এখনো খুব আলোচনায় আসেনি, সেটি হলো, বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পদচারণকে দেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে দেখছে। তবে এককভাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণ আগে কখনো পূর্ণমাত্রায় সমর্থন দেয়নি।

আরও পড়ুনবিএনপি-জামায়াতের চার যুগের বন্ধুত্বের কী হলো১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলো (পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত) প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য। কোনো রাজনৈতিক দলের নামে ‘ইসলাম’ শব্দটি থাকলেই যে আমাদের দেশের ধর্মভীরু মানুষ দলবদ্ধভাবে তাদের ভোট দেবে, তা কখনো হয়নি এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও হবে না।

যেসব রাজনৈতিক দল বৃহত্তর পরিসরে সাংগঠনিকভাবে আমাদের সমাজ ও জনগণের মতোই দেখতে, তারাই সব সময় ব্যাপকভাবে জনগণের স্বীকৃতি পাবে।

যেসব উপাদান বা ফ্যাক্টর বিবেচনা করে জনগণ এবার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচার করতে পারে, সেগুলো হলো—

১. সুশৃঙ্খল ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার;

২. নেতিবাচক কার্যকলাপ পরিহার এবং শুদ্ধ রাজনীতির ধারক হওয়া;

৩. ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুত্ববাদী সংমিশ্রণে দলীয় সংগঠন গঠন;

৪. আদর্শের রাজনীতি নয়, বরং দেশ পরিচালনায় বাস্তব সক্ষমতা।

এ পর্যায়ে আমরা বর্তমান বড় দুই রাজনৈতিক দল—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নিয়ে কথা বলব এবং দেশের রাজনৈতিক সংলাপে তাদের অবস্থানকে এই চার ফ্যাক্টরের নিরিখে মূল্যায়ন করব।

এনসিপি: ‘চাপের রাজনীতি’ ছাড়তে হবে

এ আলোচনা থেকে আমরা এনসিপিকে বাইরে রাখব দুটি কারণে। প্রথম কারণ হলো, এনসিপির রাজনৈতিক পরিচিতি এখনো বিকশিত হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হলো, এখন পর্যন্ত এনসিপির সব কার্যক্রম শুধু জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের খুব উৎসাহভরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এনসিপি নিশ্চয়ই বাস্তবতা মেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের আরও প্রসারিত করবে।

এনসিপি সম্বন্ধে একটা মন্তব্য এখানে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সেটি হলো, তারা দলীয়ভাবে ‘চাপের রাজনীতি’কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যেমন শাপলা প্রতীক দিতেই হবে এবং অন্য সব বিষয়ও তাদের চাওয়ামতো হতে হবে। তাদের এই ‘চাপের রাজনীতি’ যে জনগণ খুব পছন্দ করছে না, তা তাদের বুঝতে হবে।

বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন। সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বিএনপির ঘাটতি ও শক্তি কোথায়

বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলাভিত্তিক নেতারা গত ১৫ বছর সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছেন, যেদিন অনুকূল পরিবেশে কে কোথায় শীর্ষ প্রতিনিধি বা সংসদ সদস্য হবেন, তা নির্ধারিত হবে। কোনো কোনো এলাকায় বিএনপির ১৫ থেকে ২০ জন সম্ভাব্য প্রার্থী দাঁড়িয়ে আছেন। একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে তারা যত বেশি বিশৃঙ্খলা দেখাবে, ততই দলের নেতিবাচকতা বাড়বে।

বিএনপির চাঁদাবাজি, দখলদারি—এসব নেতিবাচক দিক এমনিতেই দিন দিন ‘আয়তনে’ বাড়ছে। দলকে শুদ্ধ করার তাদের ‘দন্তহীন’ প্রচেষ্টাগুলো কোনো কাজ দেয়নি। ডাকসু নির্বাচনের পরেই বলেছিলাম, বিএনপিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। পরবর্তী সময়ে জাকসু, চাকসু ও রাকসুর ফলাফলেও তা প্রতিফলিত হয়েছে।

ধারণা করি, শিবিরের ‘ভালোত্ব’ নয়, আদতে বিএনপির জন্যই ছাত্রদল তলিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদলের দুর্ভোগ বিএনপির নির্বাচনী ভাগ্যেকে কতটুকু পিছিয়ে দেবে, সেদিকে সবারই চোখ থাকবে।

আরও পড়ুনবিএনপি ও এনসিপির টানাপোড়েনে ‘প্রিজনার্স ডিলেমায়’ পড়তে পারে দেশ ১৩ আগস্ট ২০২৫ডাকসুতে ছাত্রদলের হার, বিএনপিকে যা ভাবতে হবে

বিএনপির সবচেয়ে বড় সুবিধা, তারা আমাদের দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের ছোট-বড় যেকোনো সমাবেশে গেলে সেগুলোকে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর একটা ভালো নমুনা মনে হবে। তাদের মধ্যে কিছুটা মৌলবাদী ঘরানার, কিছুটা ভাসানী–সমর্থক ঘরানার, কিছুটা মুজিবীয় ঘরানার, কিছুটা জাতীয়তাবাদী, কিছুটা বামপন্থী—সবই পাওয়া যাবে।

বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি—দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিএনপির এই বহুত্ববাদী রঙে আশ্বস্ত হবে। বৃহত্তর সমাজের ভারসাম্য বজায় না রাখতে পারলে যে উত্তাল অবস্থা হবে, তাতে কেউ–ই নিরাপদ থাকবে না।

বিএনপি আগেও ক্ষমতায় ছিল। তাদের দলে অনেক পরিচিত নেতা রয়েছেন, যাঁরা আগেও দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার চালিয়েছেন। এটাও সত্য, তাদের কিছু নেতার বিতর্কিত অতীত রয়েছে। বিএনপিতে তরুণ একটা উচ্চশিক্ষিত গ্রুপও অপেক্ষা করছে নেতৃত্বে যোগ দিতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের মা–বাবার হাত ধরে বিএনপিতে এসেছেন।

সব মিলিয়ে বিএনপি দাবি করতে পারে, তারা দেশ পরিচালনায় সক্ষম একটা রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে এ দাবি করা সহজ হবে না। যতই ভোটের সময় কাছে আসবে, ততই ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’ ফ্যাক্টর বিএনপির জন্য সহায়ক হবে।

দুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।জামায়াতে ইসলামী কোথায় এগিয়ে

দুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াত নিজেদের জন্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইমেজ অনেকটা তুলনামূলক। যেমন ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের যত নেতিবাচক ঘটনা জনগণের চোখে ধরা পড়েছে, সে তুলনায় জামায়াতের ঘটনা অনেক কম। সিলেটের সাদাপাথর দুর্নীতিতে দুদকের প্রতিবেদনে যেহেতু সব দলই জড়িত ছিল, সেহেতু সে ঘটনা জামায়াতকে এককভাবে কলঙ্কিত করেনি।

জামায়াতকে তাদের মনোনীত প্রার্থী নিয়ে খুব বিশৃঙ্খলায় পড়তে হবে না। দলের নেতারাও মোটামুটি একই সুরে কথা বলবেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে যত বেশি বিশৃঙ্খলায় পড়বে, ততই জামায়াতের ইমেজ ভালো দেখাবে। শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার জামায়াতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে।

জামায়াতে ইসলামীর বিগত কয়েকজন আমিরকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলবেন, বর্তমান আমির শফিকুর রহমানই তুলনামূলকভাবে অধিক নমনীয় এবং পরিবর্তনীয়। তিনি লেখাপড়া করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে, ছাত্রাবস্থায় জাসদের রাজনীতি করতেন। তিনি যেহেতু ডগমা বা প্রচলিত সূত্র ধরে জামায়াতের রাজনীতিতে আসেননি, তাই তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত।

শফিকুর রহমানের কিছু কিছু উদ্যোগ জামায়াতের জন্য ইতিবাচক মনে করা হয়।

সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তায় শফিকুর রহমানের উদ্যোগ—তাদের মন্দিরে গিয়ে অভয় প্রদান—অনেকের কাছে নির্ভেজাল মনে হয়েছে। তিনি হিন্দু জনগণকে জামায়াতকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাঁদের জামায়াত থেকে মনোনয়ন দেওয়ার কথাও বলেছেন। তবে জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও অবকাঠামো যত দিন না বদলাবে, শফিকুর রহমানের একক প্রচেষ্টা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই জামায়াত এখনো একটা সমজাতীয় বা হোমোজেনাস দল এবং এটা তাদের জন্য নেতিবাচক হয়েই থাকবে।

আরও পড়ুনজামায়াত এগিয়ে, বিএনপি কেন পিছিয়ে ০৪ অক্টোবর ২০২৫

জামায়াতকে এখনো বিশেষ আদর্শ বা মতবাদের বাহক হিসেবে গণ্য করা হয়। জামায়াত তাদের আদর্শ ও মতবাদের ভিত্তিতে বড় কোনো সুবিধা পাবে না। আবার যাঁরা জামায়াতকে পাকিস্তানপন্থী বা একাত্তরে পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে পরাস্ত করতে চান, তাঁরাও খুব সুবিধা করতে পারছেন না।

তবে এটা এখনকার অবস্থা—ভবিষ্যতে ‘একাত্তরের ইতিহাস’ হাওয়াইয়ের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো যে কখন জামাতের জন্য বিস্ফোরিত হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। তবে এখন অন্য ফ্যাক্টরগুলোই বেশি গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসছে।

আরেকটা ফ্যাক্টর জামায়াতের বিপক্ষে কাজ করবে। সেটি হলো, দলের ওপরের সারির দু-চারজন নেতা ছাড়া অন্যরা সাধারণ জনগণের কাছে একদম অপরিচিত। একটা কর্মশীল সরকার গঠন এবং সুষ্ঠুভাবে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁরা কতটুকু সক্ষম? কারা দেশের নেতা হবেন?

নির্বাচন যত কাছে আসবে, এই প্রশ্নগুলো আরও সামনে আসবে এবং অধিকতর গুরুত্ব পাবে।

চাই শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণ

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, জনগণের মধ্যে এই উপকরণগুলোর যাচাই-বাছাই আরও বাড়বে। কোন কোন উপকরণের গুরুত্ব আস্তে আস্তে বাড়বে কিংবা কোনগুলোর গুরুত্ব কিছুটা কমবে, তার ফয়সালা হতে আরও সময় লাগবে।

কিছু কিছু অনুমান হয়তো করা যায়, তবে এক্ষুনি কোনো শেষ কথা বলা ঠিক হবে না। যেমন একটা পর্যায়ে জনগণ শুধু ‘শুদ্ধ রাজনীতি’ কিংবা ‘দেশ পরিচালনায় সক্ষমতা’-কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে যাবে। আবার এমনটা না–ও হতে পারে; হয়তো তারা সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করেই ভোট দেবে।

আরেকটি দেখার বিষয় হলো, ৫ আগস্টের আগে বিএনপি ৪০ শতাংশ জনসমর্থন অধিকারে রাখা দল ছিল। এখন তাদের যারা প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই জামায়াত ছিল ৫ শতাংশ লোকের সমর্থন পাওয়া দল। শুধু বিএনপির নেতিবাচকতা দিয়ে জামায়াত কি জনসমর্থনের এই বিরাট ব্যবধান এত সহজে ঘুচাতে পারবে?

বিশ্বজুড়ে এখন একটা অস্থিরতা চলছে। বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের জনগণ নিজেদের দারুণভাবে প্রতারিত ভাবছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের জনগণ রাজনীতিতে খুঁজছে শুদ্ধতা ও বাস্তববাদী সংমিশ্রণ। যেসব রাজনৈতিক দল জনগণের চাওয়া–পাওয়ার ফ্যাক্টরগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের নির্বাচনে এগিয়ে আসবে, তারাই বেশি সুফল পাবে এবং সফল হবে।

সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই-মেইল: salehpublic711@gmail

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ, নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা
  • জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিতে সংগ্রাম, শপথ যুব সংসদের সদস্যদের
  • ‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা
  • বন্দরে বিএনপি নেতা তাওলাদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম
  • গণভোট নিয়ে উত্তাপ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না: প্রেস সচিব
  • বিএনপি ও জামায়াত কে কোন ফ্যাক্টরে এগিয়ে
  • অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
  • কথার আগে গুলি চালায় ‘কাকন বাহিনী’, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল
  • ঢাকাসহ সারা দেশে এক সপ্তাহে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ১৪৯