বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ। এখানকার বনজ, জলজ ও খনিজ সম্পদের বৈচিত্র্য আমাদের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি নাগরিক অসচেতনতার কারণে পরিবেশের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

এ বাস্তবতায় পরিবেশ রক্ষায় নানা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে বটে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই আইনগুলো কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং তা বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রেই–বা কোন কোন সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আইন রয়েছে, যেমন ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত), ১৯২৭ সালের বন আইন, ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, একই বছরের পানি আইন এবং ২০২১ সালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা।

এসব আইনের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ), বনভূমি সংরক্ষণ, বায়ু ও পানিদূষণ রোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে।

এসব আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

যদিও এসব আইনে পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু তা প্রধানত পরোক্ষ এবং সহায়ক।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরই পরিবেশ সংরক্ষণের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

আরও পড়ুন‘গণতান্ত্রিক’ পুলিশি ব্যবস্থার রূপরেখা যেমন হতে পারে২০ মার্চ ২০২৫

এই আইনের ৪ ক(১) উপধারায় বলা হয়েছে, মহাপরিচালক বা তাঁর অধীন কোনো কর্মকর্তা প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাইতে পারবেন এবং উক্ত সংস্থাকে তা প্রদান করতে হবে।

তবে এখানেও পুলিশের ভূমিকাকে নির্ধারিত কোনো কর্তৃত্বের রূপে বিবেচনা করা হয়নি।

বন আইন, ১৯২৭-এ কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এই আইনের ৫২ ধারায় পুলিশের বাজেয়াপ্তযোগ্য সম্পত্তি জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

৬৪ ধারায় পরোয়ানা ব্যতীত বন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সুযোগ আছে এবং ৬৬ ধারায় বন অপরাধ প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

৭৯ ধারায় স্থানীয় জনগণ বন অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে, এমন বিধান রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বন আইনের ক্ষেত্রে পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা কিছুটা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।

অন্যদিকে ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং বন বিভাগের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা আইন প্রয়োগের ক্ষমতা রাখেন।

তবে এই আইনে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরাসরি কোনো ভূমিকার উল্লেখ নেই।

আরও পড়ুনপুলিশ সংস্কার কি আদৌ হবে, কতটুকু হবে২৯ মার্চ ২০২৫

একই অবস্থা দেখা যায়, ২০১৩ সালের পানি আইন এবং ২০২১ সালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালাতেও। পানি আইনের নির্বাহী কমিটিতে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিত্ব থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের অংশগ্রহণের কোনো স্থান নেই।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে; পুলিশের উল্লেখ নেই।

সার্বিকভাবে বলা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণে প্রচলিত আইনে পুলিশকে সহায়ক ভূমিকায় রাখা হয়েছে, তবে তাদের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ সীমিত।

ফলে এসব আইনের বাস্তবায়নে প্রশাসনিক সমন্বয় এবং আন্তপ্রতিষ্ঠানিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

তবে আশাব্যঞ্জক কিছু দিকও রয়েছে। যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) বাধ্যতামূলক হওয়ায় প্রকল্প গ্রহণের আগেই তার পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (ইটিপি) স্থাপন করা হয়েছে। বন আইন প্রয়োগ করে কয়েকটি অঞ্চলে সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষণা করাও সম্ভব হয়েছে।

আরও পড়ুনপুলিশ কোথাও নরম, কোথাও কেন গরম?২১ জানুয়ারি ২০২৫

তবে সীমাবদ্ধতাগুলো বেশ সুস্পষ্ট। আইন প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পরিবেশবিরোধী কাজকে প্রশ্রয় দেয়।

সাধারণ মানুষ ও অনেক উদ্যোক্তার মধ্যেই পরিবেশ সংরক্ষণসংক্রান্ত আইন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল সীমিত, প্রযুক্তি স্বল্পতায় দূষণের প্রকৃত অবস্থা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবও পরিবেশবিরোধী প্রকল্প অনুমোদনে ভূমিকা রাখছে।

পরিবেশবিষয়ক আইন বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আইন প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো—পুলিশ বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরাসরি অভিযানে পাঠানো বা মামলা করার সুযোগ না থাকায় বাস্তবিক প্রয়োগ দুর্বল থেকে যাচ্ছে।

এ বাস্তবতায় কিছু সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় নিশ্চিত করে, তাদের যথাযথ ক্ষমতায়ন করে পরিবেশ আইনের কঠোর প্রয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্যোগ আরও কার্যকর হতে পারে।

শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়িয়ে জনগণের মধ্যে পরিবেশবিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধি জরুরি। পরিবেশ অধিদপ্তরের বাজেট ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সরাসরি সাধারণ জনগণ, আইনজীবী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণ এবং সে ভিত্তিতে পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তদন্ত ও মামলা করার সুযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর আইন আছে, তবে বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি প্রকট।

এ আইনের প্রয়োগকে শক্তিশালী করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনসচেতনতার সমন্বয় ছাড়া উপায় নেই।

পরিবেশ রক্ষা শুধু আইন বা উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয় নয়—এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। সেই লড়াইয়ে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।

মো.

শাহ্জাহান হোসেন পিপিএম, উপপুলিশ কমিশনার, সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ, ডিএমপি, ঢাকা।
[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত এসব আইন অন য ন য পর ব শ র ই পর ব শ গ রহণ র বন আইন ক ষমত ন আইন আইন র

এছাড়াও পড়ুন:

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এবি পার্টির চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লেখা বা বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের। আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করেছি, হয়তো কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও “নোট অব ডিসেন্ট” (দ্বিমত) আছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনটা হবে, তা নির্ধারণের মূল ক্ষমতা জনগণের।’

কমিশনের আজকের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদকে রেফারেন্স আকারে উল্লেখ করায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতা জুলাই ঘোষণাপত্রের বৈধতা নিয়ে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলছেন, কাল তাঁরা সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন এবং এই সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?

এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক বলেন, সংবিধানে এটা নেই, ওটা নেই বলে সংবিধান সংস্কার করা যাবে না—এই ধারণা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাপরিপন্থী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান থেকে নমনীয় না হয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পুরো প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।

আশঙ্কা প্রকাশ করে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, এমন পরিস্থিতি জাতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি; অন্যথায় গণভোট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুনবর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ৪ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • ‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
  • নুরুল হকের ওপর হামলার ঘটনায় জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
  • ১৭ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ, নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই হাজার সদস্য
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
  • ফরিদপুরে অবরোধ শনিবার পর্যন্ত স্থগিত
  • ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি
  • আসন্ন নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশ ডিএমপি কমিশনারের