সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নের জন্য নয়: আলী রীয়াজ
Published: 22nd, June 2025 GMT
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “সংস্কার কমিশনগুলোর সব সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই বাস্তবায়ন করতে হবে-এমন নয়। কিছু সুপারিশ বর্তমান সরকার গ্রহণ করছে, কিছু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হবে, বাকিগুলো ভবিষ্যতের জন্য দিক-নির্দেশনা হিসেবে থাকবে।”
রবিবার (২২ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘ফার্স্ট পলিটিক্যাল সায়েন্স কনফারেন্স'-এর কি-নোট স্পিচ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
কনফারেন্সের উদ্বোধনী সেশন ও কি-নোট স্পিস সেশন পরিচালনা করেন কনফারেন্সের আহ্বায়ক অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
আরো পড়ুন:
রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের ওপর কনফারেন্স রবিবার, মূল বক্তা আলী রিয়াজ
ফিলিস্তিন-ইরানে হামলার প্রতিবাদে ঢাবিতে ইসরাইলি পতাকায় অগ্নিসংযোগ
কি-নোট স্পিসে আলী রীয়াজ বলেন, “স্বৈরশাসক যেকোনো ধরনের অসন্তোষ, যেমন ভিন্নমত ও বিরোধীদল দমন করে শাসনব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভিন্নমত প্রকাশ পায়। যেটা অনেকক্ষেত্রে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে। যেটাকে বলা হয় অটোক্রেটিক নস্টালজিয়া। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দুইটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করা বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। একটি বিচার বিভাগ এবং অন্যটি সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনী। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন এই দুই প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেয়। অনেক সময় এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে। যেমনটা আমরা বিগতে বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে দেখেছি। এছাড়া, পতিত শাসকের সমর্থকরা ট্রানজিশনাল সময়ে অস্থিরতা তৈরি করে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থিতিশীল রাখা শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নয়। বরং রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব। কারণ নিকট ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর ভর করে শাসনকার্য পরিচালনা করবে।”
তিনি বলেন, “অনেক সময় যেসব সরকার ক্ষমতা হারিয়েছে, তাদের সমর্থকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আটকে দিতে চায় এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করে। তারা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়। যদি সরকার সত্য তথ্য দিয়ে এর জবাব না দিতে পারে এবং কিছুটা স্থিতিশীলতা বা সদিচ্ছা দেখাতে না পারে, তাহলে এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ দেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যেতে ব্যর্থ হয়েছে, আর ৪০ শতাংশ দেশ সফল হয়েছে। যেখানে এসব সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবিলা করা গেছে, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। আর যেখানে মোকাবিলা করা যায়নি, সেখানে আবার পিছিয়ে যাওয়া বা গণতন্ত্র থেকে সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।”
শ্যাডো রিফর্ম কমিশন, শ্যাডো ন্যাশনাল কনসেনসাস কমিশন এবং পলিটিক্যাল অ্যান্ড পলিসি সায়েন্স রিসার্চ ফাউন্ডেশনের যৌথভাবে কনফারেন্সটি আয়োজন করেছে। এরআগে, দুপুর আড়াইটায় কনফারেন্সে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান।
তিনি বলেন, “জুলাই এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আমরা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে এ সময় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন দূর করে আমাদের একযোগে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”
পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার ও নেটওয়ার্ক বৃদ্ধিতে এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অত্যন্ত সময়োপযোগী বিষয়কে উপজীব্য করে এই সম্মেলন আয়োজন করায় তিনি আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, “রাষ্ট্র যখন ট্রানজিশনাল পর্যায়ে থাকে, তখন তা শক্তিশালী ও স্বচ্ছ ইনস্টিটিউশন গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করে। যদি আমরা এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল ও আশাব্যঞ্জক।চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে তরুণ প্রজন্ম ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার, স্বচ্ছ নির্বাচন এবং দুর্নীতির অবসানের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। এই অভ্যুত্থান লাখো মানুষের মনে নতুন আশা ও প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে।”
এছাড়া, সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক নাছিমা খাতুন।
কনফারেন্সের আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন। এসব প্রবন্ধ বর্তমান বাংলাদেশে রাষ্ট্রসংস্কার ও নির্বাচনকে ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা থেকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ খুঁজে পেতে সহায়ক হবে।”
তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে আমি দেশ-বিদেশ থেকে আগত সব প্রবন্ধ উপস্থাপক, অংশগ্রহণকারী, স্বেচ্ছাসেবক এবং সম্মানিত অতিথিদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানাই। এই সম্মেলনকে আমরা যেন একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করি এবং জ্ঞান আহরণ, ভাবনার বিনিময়, ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের লক্ষ্যে একসাথে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করি।”
কনফারেন্সে প্রথমদিন দশটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন সেশনে চেয়ার ও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক মো.
কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন সোমবারে (২৩ জুন) বাকি সেশনগুলো অনুষ্ঠিত হবে। এ দিন সমাপনী বক্তব্য রাখবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ইয়াহইয়া আখতার।
ঢাকা/সৌরভ/সাইফ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর কনফ র ন স র গণত ন ত র ক গণতন ত র র জন ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আমার জুলাই সনদ
জুলাই গণঅভ্যুত্থান হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি, বরং দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের দুঃশাসনের প্রতিক্রিয়া। গুম-খুন, ভোটাধিকার হরণ, বিচারহীনতা, দলীয় দমননীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্য—সব মিলিয়ে এক চরম নিষ্পেষণমূলক বাস্তবতা এই আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছে।
এই আন্দোলনের পেছনে ছিল বিএনপি ও বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ইসলামি দলসমূহ, পেশাজীবী সংগঠন, মানবাধিকার ও নারী সংগঠন, পরিবেশবাদী ও প্রবাসী সমাজ, এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ। এই বহুমাত্রিক অংশগ্রহণই ছিল আন্দোলনের মূল শক্তি— ‘সবার আন্দোলন’।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর অবস্থার পরিবর্তন খুব একটা হয়নি। দমনপীড়ন, হামলা-মামলা, সন্ত্রাস, খুন, নির্যাতনের ধারা এখনও চলমান। গুম হওয়া মানুষ ফেরে না, দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ে না, অর্থ পাচারকারী ফেরে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা—খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, শিক্ষা, বাসস্থান— সব কিছুতেই ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রশাসনিক সংস্কারের নামে র্যাব-পুলিশ-আনসারের পোশাক বদলানো হলেও, তাদের চরিত্রের কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? প্রতিহিংসার রাজনীতি, দলীয়করণ, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির শিকলে প্রশাসন এখনো বন্দি।
অথচ এই অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল—একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গঠন। কিন্তু আজ, সেই চেতনার পরিবর্তে আমরা দেখতে পাচ্ছি—ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে একদল ছাত্রনেতা, এনজিও প্রতিনিধি ও আমলাভিত্তিক তথাকথিত ‘সুশীল’ শ্রেণির হাতে। ফলে গণআকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত না হয়ে বরং আমরা ব্যর্থতার এক ঘূর্ণিতে আটকে গেছি।
আরো পড়ুন:
‘আমার ছেলেকে হত্যা করা এসআই এখনো কীভাবে চাকরি করে?’
খুলনায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ ও উন্মুক্ত আলোচনা
জনগণের এই আত্মত্যাগ, প্রতিবাদ, আশা ও স্বপ্ন যেন বিফলে না যায়—সেই আহ্বানেই আজ এই লেখা। কারণ আমরা জানি, ইতিহাস কখনো নীরব থাকে না।
আমার জুলাই সনদ জনগণের রক্তে লেখা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নতুন চুক্তিপত্র। কোনো একক রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের দলিল নয়—এটি আমার, আপনার, আমাদের সবার। এটি একটি স্বপ্নের মানচিত্র, যা ছাত্রদের রক্তে, শ্রমিকের ঘামে, কৃষকের মাটিতে আর সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষায় আঁকা। এই সনদ শুধু দাবির তালিকা নয়, এটি আমাদের অধিকার ও কর্তব্যের একটি নৈতিক চুক্তি।
এই সনদে আকাঙ্ক্ষা—শিক্ষা হোক সবার জন্য, স্বাস্থ্যসেবা হোক নাগালের মধ্যে, শ্রমিকের মজুরি হোক ন্যায্য, কৃষকের ফসলের দাম হোক নিশ্চিত। নাগরিক হিসেবে সবাই থাকুক সমান মর্যাদায়; ধর্ম, জাতি বা অঞ্চলের বিভাজন ছাড়া।
আমার জুলাই সনদ গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রগঠন, নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপায়ণ। এটি সেই প্রতিচ্ছবি আঁকে, যেখানে গুম-খুন থাকবে না, যেখানে সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সত্য প্রকাশ করতে পারবে, যেখানে ভোটের দিন মানুষ ভয় নয়, আশা নিয়ে কেন্দ্রে যাবে এবং যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভ জনগণের অধিকার ও মর্যাদাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কাজ করবে। এটি কারো দয়ার দান নয়—এটি জনগণের অর্জিত রাষ্ট্র, আর এই রাষ্ট্র চলবে জনগণের ইচ্ছায়, ভোটে এবং জবাবদিহিতে। এটি ক্ষমতা নয়, ন্যায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দাবি তোলে। এটি শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও চিন্তার আমূল সংস্কার চায়—যেখানে মানুষ থাকবে কেন্দ্রে, দল নয়; অধিকার থাকবে অগ্রভাগে, শোষণ নয়, দমন নয়; সম্মান থাকবে সকলের জন্য। জনগণের রক্তে লেখা দলিল, যা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে জানিয়ে দেবে, একদিন এই মাটিতে একদল মানুষ বেঁচে থাকার মর্যাদা, স্বাধীন চিন্তা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করেছিল, জীবন দিয়েছিল।
আমার জুলাই সনদ সবাইকে নিয়ে গড়া একটি নতুন সামাজিক চুক্তি, যেখানে কারো অধিকার হরণ করা যাবে না, কেউ আন্দোলনের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। এটি একটি অঙ্গীকার—গণতন্ত্র, সমতা ও ন্যায়বিচারের পথে অবিচল থাকার।
জুলাই অভ্যুত্থান ছিল কেবল সরকারের বিরুদ্ধে নয়, পুরো শোষণভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে এক গণজাগরণ। এই অভ্যুত্থান রাষ্ট্রের চেতনাকে পাল্টে দেওয়ার ডাক দিয়েছিল—দেয়ালজুড়ে, রাস্তায়, ক্যাম্পাসে এবং মঞ্চে। সেই সময় সারাদেশের ছাত্র সমাজ ও জনগণ লিখে দিয়েছিল, তারা কেমন বাংলাদেশ চায়: ‘বাংলাদেশ কারো বাপের নয়, সবার। স্বৈরশাসন মানি না। ধর্ম যার যার, দেশ সবার। আমরা চাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাস থাকবে নিরাপদ। আমরা চাই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হোক, যেন কেউ ক্ষুধায়, বেকারত্বে, অনিশ্চয়তায় হারিয়ে না যায়। শিক্ষা শেষে চাকরি চাই, বেকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই। এই দেশ হবে বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত—যেখানে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটেরাদের পকেটে যাবে না, বরং জনগণের কল্যাণে ব্যয় হবে। তারা বলেছে: খুন-ধর্ষণের বিচার চাই, সমান অধিকারের বাংলাদেশ চাই, ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ চাই, মানুষের মতো বাঁচতে চাই। কৃষক যেন তার ফসলের ন্যায্য দাম পায়, শ্রমিক যেন ন্যায্য মজুরি পায়, আর সকলের জন্য গুণগত শিক্ষা ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত হোক—এই ছিল তাদের স্বপ্ন।
তারা দাবি করেছে: স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, আমার ভোট আমি দিতে চাই, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই, ফ্যাসিবাদের অবসান চাই। এইসব শ্লোগান ছিল জনগণের রক্তে লেখা রাজনৈতিক ইশতেহার।
গণঅভ্যুত্থানের বছর পেরিয়ে আজ যারা জুলাই সনদের দাবি তুলছেন, প্রশ্ন ওঠে গত এক বছরে নিজেরাই কি সেই সনদের বিপরীত পথে হাঁটেননি? তাদের ভাষা, আচরণ ও রাজনৈতিক কৌশল কি ঠিক সেই রূপ নেয়নি, যার বিরুদ্ধে একসময় তারা শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল? ‘জনগণের রাষ্ট্র, জনতার অধিকার, নির্বাচনই একমাত্র বিকল্প’—এই কথাগুলো যারা উচ্চারণ করেছেন, তারাই পরে দলীয় সংকীর্ণতা, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ববাদ, ষড়যন্ত্রমূলক কৌশল ও আন্দোলন বিভক্ত করার খেলায় মেতেছিলেন!
এই এক বছরে অনেকেই আন্দোলনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ডানে-বাঁয়ে দুলেছেন, নেতৃত্বের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার বদলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আধিপত্যে লিপ্ত হয়েছেন! এই আত্মঘাতী দ্বিচারিতা আন্দোলনের চেতনায় শুধু চিড় ধরায়নি, জনগণের মধ্যেও আস্থার সংকট তৈরি করেছে। শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ, শহীদের রক্ত আর সাধারণ মানুষের ত্যাগকে তারা রাজনৈতিক সুবিধার বাণিজ্যে পরিণত করেছে।
আজ যারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ডাক দিচ্ছেন, তাদের প্রতি জনগণের প্রশ্ন—আপনারা কি সত্যিই নেতৃত্বে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করেছেন? শিক্ষার্থীদের প্রতি দেখিয়েছেন যথাযথ শ্রদ্ধা? আন্দোলনের পথকে স্পষ্ট রেখেছেন? নাকি নিজেরাই বিভ্রান্তি, বিভাজন এবং দমনমূলক কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন? যখন সেই একই ভাষা ও মনোভাব ফিরে আসে, যা একসময় স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিচ্ছবি ছিল, তখন জনগণ বিভ্রান্ত হয় না—তারা বুঝে নেয়, কারা আন্দোলনের সাথী, আর কারা ছদ্মবেশী।
জুলাই সনদ কোনো রাজনৈতিক দলের একক মালিকানা নয়। এটি জনগণের সংগ্রাম, ত্যাগ ও স্বপ্নে লেখা এক নৈতিক ঘোষণা। ছাত্রদের রক্ত, শ্রমিকের ঘাম, মায়ের কান্না আর সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাসে গড়া এই সনদ কোনো দলের দলিল হতে পারে না। যারা নিজেদের সুবিধা পেতে এই সনদের নাম ব্যবহার করছে, তারা এই দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ—কে এই সনদের যোগ্য উত্তরাধিকারী। এখানে কোনো দলের নাম, অতীত জনপ্রিয়তা বা কথার ফুলঝুরি কাজে আসবে না। কেবল নেতৃত্বের জবাবদিহি, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা এবং আন্দোলনের প্রতি সম্মানই নির্ধারণ করবে কে থাকবে জনগণের পাশে, আর কে হারিয়ে যাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
‘জুলাই সনদ’ এখন এক রকমের নৈতিক ও মানবিক মানদণ্ড, একটি জবাবদিহির রেফারেন্স। যারা শুধু মুখে এর কথা বলেন, কিন্তু নিজের রাজনীতিতে এর প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হন, তারা জনগণের পক্ষ থেকে কথা বলার ন্যূনতম অধিকার হারান। কারণ এই জাতি আর আগের মতো না—এখন তারা দেখছে, বিচার করছে এবং চিহ্নিত করছে—কারা কেবল স্লোগান তুলে নিজেদের আড়াল করতে চায়, আর কারা সত্যিকারের রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সহযাত্রী।
‘জুলাই সনদ’ কেবল অতীতের দলিল নয়, এটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। এটি রাজনৈতিক ঘোষণার চেয়েও বেশি—একটি নৈতিক চুক্তি, যার ব্যত্যয় মানে জনগণের সাথে প্রতারণা। তাই যারা এই সনদের দাবিদার, তাদের আগে নিজের আয়নায় মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন—তাদের রাজনীতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ কি সত্যিই এই সনদের মূল দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি তারা শুধু ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে নাটকের মুখ্য চরিত্র হওয়ার চেষ্টা করছে?
জাতি ভুলে যায় না—কে মুক্তিযুদ্ধের নাম নিয়ে ব্যবসা করেছে, কে গণঅভ্যুত্থানকে ক্ষমতার সিঁড়ি বানিয়েছে, আর কে জনগণের আত্মত্যাগকে বেচে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ইতিহাস তাদের বিচার করবেই। কারণ জনগণ কখনো নিরব বিচারক নয়।
আমি ‘জুলাই সনদ’কে আমার হৃদয়ের শপথ মনে করি। আমি অঙ্গীকার করছি—আমার প্রত্যেক কাজ, আমার রাজনীতি, আমার ভাষা ও কর্মকাণ্ড হবে এই সনদের প্রতি দায়বদ্ধ। আমরা একসঙ্গে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের বাংলাদেশকে সত্যিকার অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের মডেলে রূপান্তর করব। ‘জুলাই সনদ’ আমাদের collective প্রতিজ্ঞা, জনগণের রক্তে লেখা গণতন্ত্রের চুক্তিপত্র। বিভাজন নয়, ঐক্য চাই। আমাদেরকে ধর্ম, ভাষা, বর্ণ বা শ্রেণি নির্বিশেষে মিলেমিশে চলতে হবে। সকলের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে হবে। আমার ‘জুলাই সনদ’ হলো আমার সংগ্রাম ও অশিংদারিত্বের গর্ব, আমার পরিচয়, অহংকার, আমার অঙ্গীকার।
লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক
তারা//