রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে
Published: 23rd, June 2025 GMT
প্যানেল আলোচক:
আলী রীয়াজ, সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও প্রধান, সংবিধান সংস্কার কমিশন।
বদিউল আলম মজুমদার, প্রধান, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
আনু মুহাম্মদ, শিক্ষক ও অধিকার কর্মী; সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
মাহীন সুলতান, সদস্য, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
আসিফ মোহাম্মদ শাহান, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রশান্ত ত্রিপুরা, কান্ট্রি ডিরেক্টর, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট; সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ফজলুল হক, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)।
তাসলিমা আখতার, সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন।
সূচনা বক্তব্য: ইমরান মতিন, নির্বাহী পরিচালক, বিআইজিডি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন: মির্জা এম হাসান, জ্যেষ্ঠ গবেষক, বিআইজিডি।
ধন্যবাদ জ্ঞাপন: মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো।
সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো ।
আলোচনাআলী রীয়াজ
সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও প্রধান, সংবিধান সংস্কার কমিশন
প্রথমেই বলে রাখি, আমার বক্তব্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বা সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে নয়, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
২০২৪ সালে আমাদের সামনে যে সম্ভাবনাটা তৈরি হয়েছে সেটা হচ্ছে, আমরা রাষ্ট্রটাকে বদলাতে পারি, সেই আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। চব্বিশের আন্দোলনটা এক অর্থে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এই স্বতঃস্ফূর্ততা একটা ফোর্স তৈরি করেছে, কিন্তু নেতৃত্ব তৈরি করেনি, কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। সেটা ঘটলে কোনো কমিশনের প্রয়োজন হতো না।
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো তৈরি হয়নি। এ মুহূর্তে গণতান্ত্রিক উত্তরণে দুটি করণীয় শনাক্ত করা যায়। প্রথমত, আসল কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করানো, কার্যকর করা। দ্বিতীয় হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সম্মিলিত শক্তির একটা সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করা। এটা এখনকার যেসব রাজনৈতিক শক্তি আছে, তাদের মাধ্যমে করার সম্ভাবনা আমি প্রায় দেখি না।
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে ঠেকা কাজ চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে খানিকটা হলেও ঠিকঠাক করতে হবে। রাজনীতিবিদদের যদি একমত করানো যায়, তাহলে সেটা কিছুটা হবে। বাকিটা দীর্ঘ মেয়াদে একটা রাজনৈতিক শক্তির উত্থান প্রয়োজন। যে শক্তির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের একটা দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সেটা না হলে ঘুরেফিরে আবার ৭–১০ বছর পর এই সংকট দেখা দেবে।
প্রশ্ন রাখতে চাই, এক দিনের নির্বাচনী গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে ডেলিবারেটিভ ডেমোক্রেসিতে যাওয়া সম্ভব কি না? আপনাকে একটা নির্বাচনী গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পাঁচ বছরে এক দিনের গণতন্ত্র আমরা বলি। কিন্তু গত ১৬ বছর বা তারও কিছু বেশি সময় ধরে ওই এক দিনও নেই। আমাদের তো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, নির্বাচন কমিশনও নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো তিনটি কাজ করার চেষ্টা করেছে। প্রথমত, কমিশনগুলো একটা এলিট পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়ত, পুরো জিনিসটাই বিবেচনা করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকভাবে। প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করলে এটা অকস্মাৎ সমাধান দেবে না, কিন্তু সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের রূপান্তরের প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এই অ্যাপ্রোচের যে দুর্বলতা আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ৩ নম্বর হচ্ছে, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু কীভাবে চায়, জানতে চাওয়া হলে স্পষ্ট কিছু পাওয়া যায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়ার মানে এই নিশ্চয়তাটা তারা চাইছে যে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা পদ্ধতি থাকতে হবে।
বদিউল আলম মজুমদার
প্রধান, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
আমরা অনেকগুলো ‘এক দিনের গণতন্ত্র’ পেয়েছি—নির্বাচনী গণতন্ত্র। এর মাধ্যমে গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দুর্বৃত্তায়িত একটি সমাজ গড়ে উঠেছে। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা চরমভাবে দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গন চরমভাবে দুর্বৃত্তায়িত। এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে টাকার খেলা। ‘এক দিনের গণতন্ত্রের’ জন্যও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে হবে। এ জন্য কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার করতে হবে।
দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটাতে হলে আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত—এই তিন ধরনের সংস্কারই করতে হবে।
আমাদের বড় বড় যেসব দুর্নীতি হয়, বড় বড় যেসব অপকর্ম হয়, সেগুলো একধরনের রাজনীতিবিদ, একধরনের ব্যবসায়ী ও একধরনের আমলাদের যোগসাজশে হয়। আমাদের এর থেকে উত্তরণের পথ অবশ্যই খুঁজতে হবে।
গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি পথ নাগরিক সমাজ। নাগরিক সমাজকে কার্যকর করার মাধ্যমে এখন আমাদের আরও পথ খুঁজতে হবে, যাতে সত্যিকার অর্থে ডেলিভারেটিভ ডেমোক্রেসি (আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্র) আমরা করতে পারি। এ জন্য আমাদের নাগরিকদের সক্রিয় করা, সচেতন করা, সোচ্চার করা, সংগঠিত করা প্রয়োজন। নাগরিকদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা করতে হলে নির্বাচনী অঙ্গনকে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে জবাবদিহির প্রতিষ্ঠানগুলোতে নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে না। আমাদের এক দিনের গণতন্ত্রেও এটি প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কার্যকর করার জন্য আমরা কিছু সুপারিশ করেছি।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণের যে বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে সংসদের উচ্চকক্ষ। আমরা প্রস্তাব করেছি, উচ্চকক্ষের আনুপাতিক পদ্ধতিতে অর্ধেক হবে দলীয়, অর্ধেক হবে নির্দলীয়। দলীয় সদস্যদের দল মনোনয়ন দেবে। কিন্তু নির্দলীয় সদস্যরা আসবেন কীভাবে? আমরা বলছি, এটাও দলই মনোনয়ন দেবে, কিন্তু তাঁরা দলীয় সদস্য হতে পারবেন না। আমরা দলের গণতন্ত্রায়ণের কথা বলেছি। দলগুলো এই সদস্যদের গোপন ভোটের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবে। ফলে কারা দলীয় সদস্য আর কারা নন, তা সহজেই জানা যাবে।
ইমরান মতিন
নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)
একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক বিস্ফোরণের ফলে আমরা বর্তমানে বড় কিছু পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হচ্ছে সময় যত গড়াচ্ছে, সে সম্ভাবনা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে।
আফ্রিকান একটি লোকপ্রবাদ আছে অনেকটা এ রকম যে ‘আপনি যদি দ্রুত গন্তব্যে যেতে
চান, একা যান। কিন্তু যদি আপনি দূরে যেতে চান, দলবদ্ধভাবে যান।’ কিন্তু আমাদের সমস্যা হচ্ছে
আমাদের দ্রুতও যেতে হবে, আবার দূরেও
যেতে হবে। এখন বাকি যে সময়টা আছে, সে সময়ের মধ্যে অনেক দূরে যেতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে যেতে হবে। যে অমূল্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা সুবর্ণ এ সময় পেয়েছি, তার মর্যাদা রক্ষার্থে আমাদের একযোগে ও সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত।
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু অনেক বৃহৎ। বিভিন্ন ফোরাম থেকে এ বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি দৃষ্টিভঙ্গি
আছে। আমাদের মূল যে দৃষ্টিভঙ্গি তা হলো আমরা কেবল নির্বাচনী গণতন্ত্রেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না, আমরা এর বাইরেও যেতে চাই। নির্বাচনী গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এই নির্বাচনী গণতন্ত্রের বাইরেও চিন্তা করতে হবে। গণতন্ত্রের অন্য ধরনগুলো আমাদের বুঝতে হবে, নির্বাচনের নেপথ্যে কী কী হয়, তা–ও আমাদের বুঝতে হবে।
এটিই আমাদের মূল চিন্তা ও কাজের জায়গা। এ জায়গায় আমরা জ্ঞানভিত্তিক, তাত্ত্বিক এবং কার্যনির্ভর জ্ঞান
তৈরি করতে চাই, এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে প্রস্তাবনা তৈরি করতে চাই।
আমাদের মূল বিষয় হচ্ছে একটা কাউন্টার ভ্যালিং সিটিজেন পাওয়ার (পাল্টা নাগরিক শক্তি) তৈরি করা। কারণ, সংস্কারটা শুধু রাষ্ট্রের বিষয় নয়, এটি হলো মূলত রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক। এ সম্পর্কের রূপান্তর ঘটাতে হবে। আমরা এমন একটা পাল্টা নাগরিক শক্তি তৈরি করতে চাই, যা নাগরিককেন্দ্রিক, সমষ্টিগত, ফলপ্রসূ ও কাঠামোবদ্ধ হবে। এটা একটা দীর্ঘ সংগ্রামের বিষয়। তাই আমরা কিছু শুরুর জায়গা তৈরি করতে চাই, যার মাধ্যমে এ সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাব।
আনু মুহাম্মদ
শিক্ষক ও অধিকারকর্মী; সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের ওপর চেপে বসা একটি দীর্ঘদিনের স্বৈরতান্ত্রিক, দুর্নীতিবাজ ও সম্পদ পাচারকারী সরকারের পতন ঘটেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন গণ–অভ্যুত্থান মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা এবং নতুন সম্ভাবনার পথ অনুসন্ধানের একটি শক্তি ও উদ্দীপনা জাগিয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের একটা স্বপ্ন বা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কোন পথে গণতন্ত্র আসতে পারে, সেটা নিয়ে এখন যে আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে, সেখানে মাঝেমধ্যে আমরা ডান, বাম, সেক্যুলার, মধ্যপন্থী, ইসলামপন্থী—এ কথাগুলো শুনি। ‘বৈষম্যবাদী’ ও ‘বৈষম্যহীন’ রাজনীতি বা মতাদর্শ নিয়ে যারা
কাজ করে, এ দুই পক্ষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য কীভাবে সম্ভব? আমাদের সমাজে শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য ও জাতিগত বৈষম্য বিদ্যমান। গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার জন্য এই বৈষম্যগুলো মোকাবিলা করতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজে যাওয়ার পথ ও পদ্ধতির সঙ্গে একমত হয়ে যারা কাজ করতে চেষ্টা করবে, তারাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক শক্তি।
রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন ও চরিত্র নিয়ে আলোচনা জরুরি। একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল হতে হলে সব ধর্ম, জাতি, লিঙ্গের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। শুধু পুরুষ, শুধু বাঙালি বা শুধু মুসলমানকেন্দ্রিক দল জাতীয় হতে পারে না। দলের সব পর্যায়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়া থাকতে হবে। বর্তমানে সম্মেলনের নামে কমিটি গঠন ও বাণিজ্য চলে, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। নেতৃত্বে বয়সসীমা ও শীর্ষ নেতৃত্বের অবসরের ব্যবস্থা থাকা দরকার, যাতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে পারে। নারী ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ থাকা উচিত।
গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য কিছু বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। প্রথমত, মানুষের মধ্যে স্বপ্ন দেখার ও প্রত্যাশা জাগানোর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দীর্ঘদিনের নিপীড়ন ও দমনের কারণে মানুষের প্রত্যাশার মাত্রা কমে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান—এগুলো মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
মূল প্রবন্ধমির্জা এম হাসান
জ্যেষ্ঠ গবেষক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড
ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)
আমরা যদি একটি সুদৃঢ়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাই, তাহলে গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ আমাদের বুঝতে হবে। মূলধারার রাজনীতিবিদেরা রাজনৈতিক স্বার্থে গণতন্ত্রকে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ্ব ধারণার ভেতর আটকে দিয়েছেন, সেখান থেকে বেরোতে হলে এই আলোচনা এখনই শুরু করা প্রয়োজন। তাঁদের মতে গণতন্ত্র মানেই হলো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে নির্বাচনী গণতন্ত্র।
এই বয়ানের বিপরীতে আমরা গণতন্ত্রের আদি অর্থে ফেরত যেতে চাই—গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব আর নির্বাচন হচ্ছে এর প্রয়োগের একটি পদ্ধতি, যাকে আমরা পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে পারি। এ ছাড়া আরও প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে, যেমন গণভোট, রিকল পদ্ধতি, ডেলিবারেটিভ বা আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্র, নাগরিক অ্যাসেম্বলি ইত্যাদি। এগুলো নির্বাচনী গণতন্ত্রের বিকল্প নয় বরং সম্পূরক হিসেবে কাজ করে।
জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণাটিকে আরেকটু ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটিকে একটি নেতিবাচক ধারণা হিসেবে দেখা হয়। যেমন বলা হয়, এটি ধর্মতান্ত্রিক শাসন নয়, বিশেষজ্ঞদের শাসন নয় বা একনায়কতন্ত্র নয়। আমরা এর বিপরীতে শুধু এই নেতিব্যাক ধারণাটিকে চিরন্তন সত্য হিসেবে না দেখে পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে চাই। এই সার্বভৌমত্বের স্বরূপ নির্ধারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দুটি—এই ‘জনগণ’ কে? এবং তাঁরা কীভাবে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করবে? এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পেতে হলে আমাদের ভাবতে হবে এমন একটি সার্বভৌমত্বের কথা যেটি উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমতাভিত্তিক।
আমরা কেমন গণতন্ত্র চাই? আমরা চাইব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ। বর্তমান সংস্কার প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপগুলো হতে পারে প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে বিভিন্ন লিঙ্গ, পেশা ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সামষ্টিক প্রতিনিধিত্ব; স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক অ্যাসেম্বলি যা স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করবে; স্বাধীন সাংবিধানিক কমিশনগুলো যেখানে নাগরিক প্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। এ ছাড়া আমরা গণতন্ত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে দেখতে চাই—কমিউনিটি পুলিশিংয়ের প্রবর্তন, যার মাধ্যমে পুলিশি ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটবে; লিঙ্গীয় সম্পর্ক, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জনকল্যাণ সেবাগুলোর গণতান্ত্রিকীকরণ।
জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে সংগতি রেখে চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সকে আমরা দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং বাস্তবতার আলোকে এবং জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। বর্তমানে সংস্কার প্রচেষ্টায় এ বিষয়টিকে শুধু রাষ্ট্রকেন্দ্রিক করে রাখা হয়েছে। এর বিপরীতে আমরা চাইব এটি রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্ককেন্দ্রিক হবে। যার অর্থ হচ্ছে, ক্ষমতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে শুধু রাষ্ট্রের ভেতরে নয়, সমাজের ভেতরেও। এতে সমাজের ভেতরেও সংঘবদ্ধ পাল্টা নাগরিক শক্তির উদ্ভব ঘটবে। এই শক্তির প্রতিফলন ঘটবে যখন নাগরিক-প্রতিনিধিরা (নাগরিকদের প্রতিনিধি নয়) রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে ঢুকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি অংশ নেবেন।
মাহীন সুলতান
সদস্য, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন
নারীর নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের দিকে আমরা জোর দিয়েছি।
নারীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য গণতন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য, চাহিদা বা স্বার্থ উপস্থাপন হতে পারে। আমরা শুরুতে যে আশা নিয়ে কাজ শুরু করেছি, পরে দেখা গেল ইনক্লুসিভনেসের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। আমরা আমাদের কমিশনের সুপারিশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে এনেছি। যেমন আমরা বলেছি, বিভিন্ন লিঙ্গ, বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা আরও বলেছি, ধর্ম হবে মানুষের, রাষ্ট্রের নয়। নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে কোনো একটি ধর্মকে প্রাধান্য দিতে পারি না।
সংসদে যেসব নারী নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন, তাঁরা যেন স্বতন্ত্র একটা বক্তব্য দিতে পারেন। তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক দলের কথাও বলবেন, আবার নারীর স্বার্থসংক্রান্ত কথাও বলবেন। সেখানে নারীসমাজের সঙ্গে একটা জবাবদিহি থাকতে হবে। দেখা গেছে, অন্যান্য দেশে যেসব নারী রাজনীতিতে আসেন, তাঁদের সঙ্গে যদি বাইরের নারীদের নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা থাকে, তাহলে তাঁরা অনেক জোরগলায় কথা বলতে পারেন। তাঁদের ভূমিকা আরও বেশি বলিষ্ঠ হয়।
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেখানে নারী সংগঠন বা নারী সমাজের প্রতিনিধিত্বসহ বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। আমরা নারীদের জন্য একটি স্বাধীন সাংবিধানিক কমিশনের প্রস্তাব রেখেছি। এ বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
স্থানীয় সরকার গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল জায়গা, বিশেষ করে নারীদের জন্য। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোয় সবার সঙ্গে নারীও যেন সমানভাবে তাঁর কথাগুলো তুলে ধরতে পারেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে জোর দিতে হবে।
ঐকমত্য কমিশনে কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হচ্ছে। সেখানে নারী অধিকার সংস্থার কমিশনের প্রতিবেদন তুলে ধরার সুযোগ আমরা পাইনি। একই ভাবে নাগরিকদের মতামত ঐকমত্য কমিশনে কোনো জায়গা পাচ্ছে না। এভাবে আমাদের কথা বলার সুযোগ না থাকাটা উদ্বেগের, হতাশার কারণ।
আসিফ মোহাম্মদ শাহান
অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা যখন ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তনের কথা বলছি, তখন আমরা কেবল কেন্দ্রীয় বা জাতীয় পর্যায়ের সাংবিধানিক বিধান বা সংসদীয় কাঠামোর পরিবর্তনের কথা বলছি। আমরা যদি কেবল এসব নিয়মকানুন বদলাই, কিন্তু সেই নিয়ম বাস্তবায়নের জন্য সংগঠন তৈরি না করি, তাহলে ওই পরিবর্তন অর্থহীন থেকে যাবে।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হলে আমাদের প্রয়োজনীয় কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা বলতে প্রশাসনিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা, অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ায় তারা কাজ করবে, তা বোঝানো হয়েছে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। সাংবিধানিক বা জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জনসাধারণের কার্যকর যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জনগণ কীভাবে তাদের সমস্যাগুলো এখানে জানাতে পারে, তার কোনো ব্যবস্থা আমরা এখানে দেখিনি। ধরা যাক, কেউ তার মানবাধিকার হরণ করা নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়েও সমাধান পাননি। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে মানবাধিকার কমিশনের সে বিষয়টি সমাধান করা উচিত। কিন্তু সে জন্য তো মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে জনগণের সংযোগ থাকতে হবে।
জনগণের সংগঠিত কণ্ঠস্বরের কাঠামোটাও দরকার। এই কণ্ঠস্বর আসতে পারে ‘সিটিজেন অ্যাসেম্বলি’, ‘ট্রেড ইউনিয়ন’, ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ বা ‘সিটিজেনস কমিটি’-এর মতো কাঠামোর মাধ্যমে। জনগণ যখন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেবা না পায়, তখন এই সংগঠিত কণ্ঠস্বর যেন সেই অভিযোগ নিয়ে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে দাঁড়াতে পারে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোরও একটি জবাবদিহির পরিবেশ তৈরি হবে। কোনো অভিযোগ যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান না মেটায়, তখন স্ট্যান্ডিং কমিটি সেসব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে। তারা মানবাধিকার কমিশনের কাছে প্রশ্ন রাখতে পারে, ‘আপনার কাছে এ অভিযোগ এসেছে, আপনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?’
সামগ্রিকভাবে আমরা একটি বিকল্প কাঠামোর প্রস্তাব দিতে চাচ্ছি, যা একদিকে নাগরিক সংগঠনকে শক্তিশালী করবে, অন্যদিকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। এটি হয়তো পুরোপুরি একটি র্যাডিক্যাল পরিবর্তন নয়, তবে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে থেকেই একটি অর্থপূর্ণ, জনমুখী, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার একটি পথ হতে পারে।
চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস
সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কীভাবে প্রতিষ্ঠা, পুনর্গঠন বা নতুন করে তৈরি করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। গণতন্ত্র চর্চার জন্য প্রথমত প্রয়োজন নাগরিকের ক্ষমতায়ন। আমরা সব সময় অধিকার নিয়ে কথা বলি, কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে বলি না। কেন বাংলাদেশকে রক্তক্ষয়ী গণ–অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হতে হলো? আমরা কি জানি আমাদের দায়িত্ব ও ব্যর্থতা কোথায় ছিল?
নাগরিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। নীরবতায় গণতন্ত্র সম্ভব নয়। জবাবদিহি ছাড়া নির্বাচনও ব্যর্থ হয়। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে এখন কী হচ্ছে? এর অর্থ কি যা ইচ্ছা তা–ই বলা? মানুষকে অপমান, হয়রানি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বদনাম বা হেনস্তা—এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীত।
আগে শিক্ষাব্যবস্থায় বিতর্কচর্চাকে উৎসাহ দেওয়া হতো। বিতর্ক শেখাত যুক্তি দিয়ে তর্ক করতে, যা সহনশীলতা তৈরিতে সহায়ক। এখন কী দেখি? তির্যক মন্তব্য, ব্যঙ্গ, ব্যক্তিগত আক্রমণ। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই আক্রমণাত্মক অপসংস্কৃতি প্রচারিত হচ্ছে। আমরা শিখেছিলাম যুক্তি দিয়ে তর্ক করতে, মেনে নিতে। মেনে নেওয়া হার নয়, বরং বেড়ে ওঠা। অন্য দেশে শিশুদের ছোটবেলা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থা শেখানো হয়। আমরা কেন করি না? শিক্ষাব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক বোঝাপড়া একীভূত করতে হবে। শুধু তত্ত্বে নয়, চর্চায়।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কীভাবে হবে? সংরক্ষিত আসন নাকি সরাসরি নির্বাচন? আমরা সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে। যে পদ্ধতিতেই তা হোক না কেন, যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ জরুরি। যোগ্যতা বিবেচনা না করলে অযোগ্যদের প্রমোশন নারীদের জন্য বিব্রতকর।
প্রশান্ত ত্রিপুরা
কান্ট্রি ডিরেক্টর, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট; সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
গণতান্ত্রিক রূপান্তর বা সমাজের রূপান্তর একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। এটি তিন মাস বা ছয় মাসে সম্পন্ন হওয়ার বিষয় নয়। আমাদের সামনে যে সময় আছে, তাকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাব, সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত।
জুলাইয়ের পর বাংলাদেশ যে অবস্থায় আছে, সেখানে অধিকার ও সেবার অবস্থা কী? গণতান্ত্রিক রূপান্তর তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়। সংস্কার বলতে আমরা কী বুঝি? কাগজে-কলমে সংস্কার, নাকি আমাদের আচরণগত ও চিন্তার সংস্কার? এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা দরকার। আমরা যাঁরা এ আলোচনায় অংশ নিচ্ছি, আমাদের মধ্যে একধরনের তাগিদ কাজ করছে। আমি নিজে উপলব্ধি করছি, এটা আমাদের প্রজন্মের ব্যর্থতা। নতুন প্রজন্ম গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু তারাও কি একই চক্রে ঢুকে পড়ছে? আমরা আমাদের ব্যর্থতা ও হতাশা প্রকল্প করে কাটিয়ে উঠতে চাই।
রাষ্ট্র ও সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর একটি যুগল প্রক্রিয়া। আজকের শিরোনাম যদি ‘সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ হতো, তাহলে আমরা ভিন্নভাবে চিন্তা করতাম। সমাজের রূপান্তর ছাড়া রাষ্ট্রের স্থায়ী রূপান্তর সম্ভব নয়। আমাদের পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের চর্চা দরকার। যদি আমাদের নজর শুধু রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে, তাহলে ঘুরে-ফিরে একই জায়গায় ফিরে আসব। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ধৈর্য প্রয়োজন। আমাদের ভাবতে হবে না যে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের বারবার শুরু থেকে শুরু করতে হবে।
ফজলুল হক
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)
আমার মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, আমরা কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? আমাদের সমাজ হিসেবে আমরা কি দায়িত্বশীল? ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর এ প্রশ্নের বিস্তৃতি আরও ব্যাপক হয়েছে।
আজ আমি এখানে একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি। গত দুই দশকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অধঃপতন দেখেছি। এর জন্য আমি সরকারের চেয়ে আমাদের নিজেদেরই বেশি দায়ী করি। আমাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা—কে কত তাড়াতাড়ি ‘জিন্দাবাদ’ বা ‘জয় বাংলা’ বলে সুবিধা নিতে পারে—এ প্রতিযোগিতা চলেছে সবখানে।
আমাদের দেশে আইনের অভাব ছিল না কিন্তু তার সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত প্রয়োগ দেখিনি। এখানেই স্বৈরাচার ও দুর্বৃত্তায়নের জন্ম হয়েছে। আমার নিজস্ব বিবেচনা হলো, ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণ করে এগিয়ে যাওয়া। গত ৫ দশকে আমরা যা অর্জন করতে পারিনি, তা কয়েক মাসে অর্জন করা বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের ধাপে ধাপে এগোতে হবে।
সংস্কার কমিশনগুলো যে কাজ করছে, সাধারণ জনগণের বেশির ভাগই এই প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। এটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও উন্নয়নপ্রক্রিয়ার জন্য বাধা হতে পারে। পরবর্তী সময়ে মানুষ অনুভব করতে পারে, এটি তাদের এজেন্ডা নয়। তা্ জনগণের সঙ্গে আরও বেশি মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের সম্পৃক্ত করা দরকার। জনগণকে আরও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা গেলে তা উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় সহায়ক হতো।
তাসলিমা আখতার
সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন
গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে বারবার যে প্রশ্নগুলো উঠে আসছে, তা হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা। গত বছরের গণ–অভ্যুত্থানে ঐক্যের মূল বিষয় ছিল স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা, আইন ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে এগুলো সামনে আনা দরকার।
শ্রম সংস্কার কমিশনে আইন, প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, আইনের স্বীকৃতি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে। শ্রমিকদের জবাবদিহি, মজুরিকাঠামো, ত্রিপক্ষীয় কমিটির চরিত্র, নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে সুপারিশ তৈরি করেছি।
শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বল হলে গণতান্ত্রিক রূপান্তরও ব্যাহত হবে। দিন শেষে সবকিছুই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। শ্রম সংস্কার কমিশনে আমরা আইন, প্রতিষ্ঠান, জবাবদিহির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রশ্ন তুলেছি। যেমন শ্রমিকদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ নয়, ‘আপনি’ বলা। এই ছোট পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রম বিষয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ‘শোভন কাজ’ বা ‘শোভন মজুরি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। আমরা শ্রম সংস্কার কমিশনে শোভনের সঙ্গে ‘মর্যাদাপূর্ণ’ শব্দ যুক্ত করেছি, যা একটি পরিবর্তন এনেছে। ‘মহিলা’র পরিবর্তে ‘নারী’ শব্েদর ব্যবহার, নারী-পুরুষের পাশাপাশি অন্যান্য লিঙ্গ এবং ‘আদিবাসী’র বিকল্প হিসেব ‘বহু জাতি’ শব্দ যুক্ত করেছি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ব গণতন ত র র প দল য় সদস য র র প ন তর ক ব যবস থ জনগণ র স একধরন র আম দ র ব র র জন য আম দ র ম র ব পর ত প রক র য় প রস ত ব র র জন ত আম দ র স ম হ ম মদ সরক র র ব আইজ ড র কর র ব তর ক র ভ তর তত ত ব ক জ কর জন য ক চ ত কর র পর ব ক ত কর র ক কর আরও ব গ রহণ দরক র র একট স গঠন ষ গণত ক গণত ত করত ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে জনগণ, অংশ নিলেন প্রেসিডেন্টও
ইরানের তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিমান হামলার প্রতিবাদে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। দেশটির রাজধানীজুড়ে রোববার সকাল থেকেই বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। পরে সেখানে যোগ দেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান।
বিক্ষোভ ‘আমেরিকার আগ্রাসনের জবাব চাই’, ‘আমেরিকা নিপাত যাক’, ‘ইসরায়েল ধ্বংস হোক’- ইত্যাদি নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়।
প্রতিবাদকারীদের হাতে ছিল ইরানি পতাকা, নিহতদের ছবি এবং ট্রাম্প ও ইসরায়েলি নেতাদের কুশপুতুল। অনেকে হাতে ধরে রেখেছিলেন ব্যানার যাতে লেখা ছিল:
‘আমরা প্রতিরোধ করবো, আত্মসমর্পণ নয়’, ‘হামলা হলে জবাব আসবেই’, ‘পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের রক্ত বৃথা যাবে না’
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই হামলা কেবল ইরানের নয়, সমস্ত মুসলিম বিশ্বের ওপর আঘাত। আমেরিকা জানে না, ইরান কখনও মাথানত করে না।’
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বিক্ষোভের লাইভ সম্প্রচার করে। অনেক জায়গায় ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থেকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রতিরোধে সক্রিয় থাকতে।
তেহরানের আজাদি স্কয়ার, ফার্দৌসি স্কয়ার, ইমাম হোমেইনি মসজিদের সামনে এবং পার্লামেন্ট ভবনের সামনে ছিল প্রধান বিক্ষোভস্থল। তবে দেশটির বিভিন্ন স্থানেও ছোটখাটো করে বিক্ষোভ হয়। তেহরানের আজাদি স্কয়ারে আসেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। পরে তিনি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে অংশ নেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিক্ষোভগুলো শুধু সরকার সমর্থিত নয়—বিশেষ করে ইরানে পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর হামলার পর সাধারণ জনগণের মধ্যেও জাতীয় ঐক্য ও ক্ষোভ উভয়ই দৃশ্যমান।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে সামরিক অভিযানে ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এর পরই দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।