সরকার সর্বশেষ জানিয়েছে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনা করে একটা সমঝোতা করে সরকারকে জানাতে, না হলে তারা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবে। এটা নিঃসন্দেহে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়। কারণ, এই দলগুলো গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রায় আট মাসে অনেকবার আলোচনায় বসলেও ঐকমত্য হয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, অর্থাৎ ওখানে সমঝোতাকারীও ছিল ঐকমত্য কমিশন। সেই আলোচনায় যখন অনেকগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, এখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা নিজেরা বসে ঐকমত্যে আসবে; যেটা আট মাসেও হয়নি, সেটা আট দিনের কম সময়ে কীভাবে হবে? এটা মোটেও সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ নয়।

ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ করেছে গণভোট হবে, সংবিধানের আদেশ জারি হবে—এ পরামর্শগুলো বাস্তবসম্মত নয়। আইনের ইতিহাসে এ রকম প্রস্তাব কখনো চোখে পড়েনি। গণভোট হয় আগের প্রতিনিধিত্বমূলক একটা প্রতিষ্ঠান, যেমন সংসদ; সংসদ কোনো একটা প্রস্তাব পাস করল, সেটা যদি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়, তখন সেটার ব্যাপারে জনগণের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য গণভোট হয়। সাধারণত আগে গণভোটের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়। তারপর সেটা জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে হচ্ছে উল্টো। এটা আমার দৃষ্টিতে অবাস্তব।

এখানে গণভোটের জন্য ৪৮টি প্রস্তাব আছে, এত বড় দলিল পড়ে, বুঝে জনগণের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা বা সিদ্ধান্তে আসা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া এসব প্রস্তাবের মধ্যে কেউ ৭টি বিষয়ে একমত হলো, ২৪টি বিষয়ে একমত হলো না, তখন কী হবে? প্রথমত, এই ৪৮টি বিষয় পড়ে বোঝা একটা ব্যাপার। সেটা আমার মনে হয় না যে ১০ ভাগ লোক এটার জন্য প্রস্তুত আছে। প্রায় সবাই কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হবে, কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত করবে।

সংবিধান–সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো যদি পস করতে হয়, তাহলে বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া আগামী সংসদ কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা গণভোটের মাধ্যমে বেঁধে দেওয়া এবং ২৭০ দিনের মধ্যে পাস না করলে অটো পাস হয়ে যাবে, এটা আইনের ইতিহাসে নেই। সংসদ হলো সার্বভৌম। ত্রয়োদশ সংসদ যদি কোনো আইন পাস করে বলে পরবর্তী চতুর্দশ বা পঞ্চদশ সংসদ এই আইন বাতিল করতে পারবে না বা পরিবর্তন করতে পারবে না, এটা কখনো হয় না। কারণ, একটা সংসদ আরেকটা সংসদের হাত-পা বেঁধে দিতে পারে না। এটা আইনের মৌলিক ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখন ২৭০ দিনের মাথায় যদি এটা পাস বলে গণ্য ধরেই নেওয়া হয়, তাহলে ২৭০ দিন আলোচনার মূল্য কী? তাহলে এই আলোচনাও সম্পূর্ণ অর্থহীন, কোনো যৌক্তিকতা নেই।

‘আমাদের সংবিধান খারাপ, সংবিধানের কিছু মৌলিক সংস্কার করতে হবে’—এসব আলোচনা থেকে সংবিধান সংস্কারের ধারণাটি এসেছে। সংবিধান সংস্কার করলে ভবিষ্যতে কখনো স্বৈরাচারী সরকার আসবে না, গণতন্ত্র থাকবে, জবাবদিহি থাকবে, আইনের শাসন থাকবে—এই বিষয়গুলো যদি সংবিধানের ধারার ওপর নির্ভর করত, তাহলে দুনিয়ার সব দেশেই গণতন্ত্র থাকত, ন্যায়বিচার থাকত, স্বৈরশাসন থাকত না। অনেক দেশ আছে—যুক্তরাজ্য, কানাডা, ওদের সংবিধানই নেই, কিন্তু ওদের দেশে গণতন্ত্র আছে, স্বৈরাচার নেই।

অন্যদিকে আমাদের মতো বহু দেশে অনেক ভালো ভালো সংবিধান আছে। রাশিয়ার সংবিধানে অনেক ভালো কথা লেখা আছে। কিন্তু রাশিয়ায় কি কোনো গণতন্ত্র আছে?
অতএব, সংবিধান ভালো হলে দেশ ভালো হয়ে যাবে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। দেশে গণতন্ত্র থাকবে, স্বৈরাচার থাকবে না, ন্যায়বিচার থাকবে—এগুলোর জন্য সংবিধানের গুরুত্ব কম। এটা রাজনৈতিক চর্চার বিষয়।

দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন থাকলে এবং বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন হয়, তাহলে গণভোটের পর সাংবিধানিক আদেশ জারি আদালতের মুখোমুখি হতে পারে। এর থেকে বের হওয়ার উপায় হলো দ্রুত সংসদ নির্বাচন দেওয়া। একটা রাজনৈতিক দল নিশ্চয়ই বলবে, আমরা সংসদে গেলে এই সংবিধানে যেসব গলদ আছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করব। এটি পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণতন ত র প রস ত ব র জন ত ক গণভ ট র ঐকমত য র জন য আইন র

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশন কী হলো না হলো কিছু আসে যায় না: আমীর খসরু

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ব‌লে‌ছেন, “৩১ দফার মধ্যে সংস্কারের সম্পূর্ণ একটা রূপরেখা আছে। তো তারা সংস্কার চাক, আর না চাক। বলুক, আর না বলুক। আমরা সবাই মিলে যুগপৎ আন্দোলনে যারা ছিলাম, আমরা কিন্তু আমাদের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করব। ওই কমিশন কী বলে, ঐকমত্য কমিশন কী হলো না হলো, এটাতে আমাদের কিছু আসে যায় না।”

বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা ব‌লেন তিনি।

এ আলোচনা সভার আয়োজন করে গণফোরাম। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি  কামাল হোসেন।

তিনি অসুস্থ থাকায় তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দলের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান।

জামায়াতকে ইঙ্গিত করে খসরু ব‌লেন, “অন্য কারও (রাজনৈতিক দল) যদি কিছু থাকে, তারাও জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারে।...ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে আসেন। সংসদে আপনি পরিবর্তন করেন, এটাই তো নিয়ম। কিন্তু আপনি জোর করে ঢাকা শহরে বসে, আপনার দাবি মানতে হবে, এটার জন্য আবার ঐকমত্য কমিশনকে ব্যবহার করবেন, অথবা সরকারের ব্লেসিং (আশীর্বাদ) নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এটার জন্য তো বাংলাদেশের মানুষ এত ত্যাগ স্বীকার করেনি।”

গণভোট বর্তমান সংবিধানের পরিপন্থী উল্লেখ করে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ফোরামের এই নেতা বলেন, “এই সংবিধানে গণভোটের কোনো প্রভিশন (অনুমতি/বিধান) নেই, ক্লিয়ারলি (পরিষ্কার)। আপনার যদি গণভোট করতে হয়, তাহলে এই সংবিধান পরিবর্তন করে গণভোটের প্রভিশন আগে আনতে হবে। তাহলে এই পরিবর্তনটা আপনাকে কোথায় করতে হবে? সংসদে করতে হবে এবং সংসদ হচ্ছে জনগণের রিপ্রেজেন্টেটিভ (প্রতিনিধি)।”

তিনি বলেন, “বিএনপি দেশে সহনশীলতা ও রাজনৈতিক ঐক্যের প্রেক্ষাপটে এই গণভোটের পক্ষে মত দিয়েছে, তা–ও নির্বাচনের দিন। কিন্তু আসলে নির্বাচনের দিনও তো গণভোট হতে পারে না। এটা তো বিএনপির উদারতা এবং এই উদারতাটা দেখানো বিএনপির ঠিক হয়নি। কারণ, এটা সাংবিধানিকভাবে কারেক্ট (সঠিক) না। এটা নৈতিকভাবে কারেক্ট না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কারেক্ট না যে উদাহরণটা দেখিয়েছে, এটার জন্য আজকে আমরা সমস্যা ফেস করতেছি।”

গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরীর সভাপ‌তি‌ত্বে, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নারী পক্ষের সভাপতি শিরীন হক প্রমুখ।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঐকমত্য না হলে দেশে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হবে
  • আজ জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস
  • ঐকমত্য কমিশনের আপ্যায়ন ব্যয় ৪৫ লাখ টাকা
  • সংবিধান ও আইন অনুযায়ী সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ বিএন‌পি 
  • ঐকমত্য কমিশন কী হলো না হলো কিছু আসে যায় না: আমীর খসরু
  • সংবিধান সংস্কার জনগণের মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিত: ড. কামাল হোসেন
  • চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের মধ্যে বাড়ছে মানসিক সমস্যা
  • দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জন্য বিএনপিকে দায়ী করলেন আখতার হোসেন
  • সরকারের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে