১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে রাজশাহীতে এলেন কবি বন্দে আলী মিয়ার ছেলে জাহিদুল ইসলাম। সঙ্গে আনেন বোনের মেয়েকে। দেখাবেন রাজশাহীতে কোথায় তাঁদের বাড়ি ছিল। কোথায় তাঁরা বড় হয়েছেন। মুখস্থ পথে হেঁটে ঠিক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন; কিন্তু বাড়ির সামনে এসেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁদের সেই স্মৃতিঘেরা বাড়ি ভেঙে সেখানে উঠেছে বহুতল ভবন। ভাগনি বুঝতে পারলেন, মামার ঠিকানা হারিয়ে গেছে। বলল, ‘মামা, চলো বাড়ি যাই।’ কিন্তু জাহিদুল ইসলাম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৬৫ সাল থেকে মৃত্যুর (১৯৭৯) আগপর্যন্ত রাজশাহীতে ছিলেন। কাজ করতেন রাজশাহী বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে। সেই সুবাদে সরকারি বাসা পেয়েছিলেন। নগরের কাজীহাটা এলাকায় ছিল সেই বাসা। দীর্ঘদিন রাজশাহী থাকায় কবি ও তাঁর সন্তানদের অনেক স্মৃতি ছিল সেখানে। সেই স্মৃতি হাতড়াতে সান্তাহার থেকে ছুটে এসেছিলেন কবিপুত্র জাহিদুল ইসলাম। ডাকনাম চাঁদ। বয়স ৭১। তাঁরা আট ভাই ও চার বোনের মধ্যে এখন তিন ভাই ও তিন বোন বেঁচে আছেন।

সেদিন জাহিদুল ইসলামের সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল এ প্রতিবেদকের। রিকশায় উঠেই তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বেতারের সামনে যাও।’ কাজীহাটা এলাকায় বেতারের সামনে রিকশা থামল। নেমেই হনহন করে উত্তর দিকের একটি গলিতে হেঁটে গেলেন। কিছুদূর গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলেন। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। মাঝবয়সী একজন লোককে থামিয়ে জানতে চাইলেন, স্থানীয় কি না? লোকটি মাথা নাড়াতেই জানতে চাইলেন, এখানে কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়ি ছিল না? লোকটি এবার জোরে মাথা নেড়ে আঙুল তুলে দেখালেন, ওই যে ওখানে বাড়ি ছিল। সেই বাড়ি ভেঙে এই দালান উঠেছে।

জাহিদুল এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু সময় নিয়ে লোকটিকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে ফারুক ভাইয়ের বাড়ি কোনটা? কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটি জানালেন, ফারুক ভাই তো মারা গেছেন। এবার জাহিদুল পাড়ার দু-একজন মেয়ের নাম বললেন। লোকটি তাঁদেরও চিনতে পারলেন। কেউ কেউ মারা গেছেন এবং অন্যরা কোথায় আছেন বলে দিলেন। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলেন, ফারুক ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের চেম্বার পাশের একটি ভবনে।

অগত্যা সেখানে ছুটে গেলেন জাহিদুল ইসলাম। তখন ভেতরে টুপি পরে এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। ভেতরে ঢুকেই জাহিদুল বলে উঠলেন, ‘বাবু ভাই, আমাকে চিনতে পেরেছেন।’ লোকটি ইতস্তত করতে লাগলেন। এবার আরেকটু পরিষ্কার করার জন্য বললেন, ‘ভাই আমার নাম চাঁদ, আমি চাঁদ।’ তখন লোকটি আমতা-আমতা করে বললেন, ‘ও আচ্ছা, বসেন বসেন।’ তাঁকে চিনতে পেরেছেন দেখে অতি উৎফুল্ল হয়ে জাহিদুল নাম ধরে তাঁর অন্য সব ভাইবোনের কথা জানতে চাইলেন। লোকটি সংক্ষেপে কথাবার্তার উত্তর দিলেন। এমন সংক্ষিপ্ত উত্তরের জন্য কবিপুত্র বোধ হয় প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি হেসে হেসে আরও অনেক কথা বলতে চাইলেন। এবার লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘ভাই আর সময় দিতে পারব না। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।’

বের হওয়ার পর ভাগনি আর একদণ্ডও দাঁড়াতে চাইল না। বারবার বলছিল, ‘মামা রাত হয়ে যাবে। চলো, ফিরে যাই।’ কিন্তু জাহিদুল ততই গোঁ ধরছিলেন, ব্যাপারটা এমন—যেন তাঁর পরিচিত অনেক মানুষ এখানে আছেন। তিনি প্রমাণ করেই ছাড়বেন। মেয়েটার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নগরের রাজপাড়া থানা সড়কে নিয়ে গেলেন। তিনি কী করতে চাচ্ছেন, তা দেখতে প্রতিবেদকও পেছনে পেছনে যান। সড়কের বাঁ পাশে একটি গলির মুখে ঢুকে বললেন, ‘এই বাড়ি, এই বাড়িই হবে।’ নিশ্চিত হতে পাশের দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা রফিক ভাইয়ের বাড়ি না?’ দোকানি নিশ্চিত করলেন।

রফিক কবিপুত্রের সহপাঠী ছিলেন। দরজায় কড়া নাড়ার পর খুলে দিলেন তাঁর (রফিক) ছোট ভাই। তাঁকে নিজের পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোক বেশ চিনতে পারলেন। ভেতরে নিয়ে বসালেন। সেখানে কিছুক্ষণ শৈশবের গল্প চলল। তাঁর গলা শুনতে পেয়ে ভেতর থেকে একজন নারী বলে উঠলেন, ‘এ লোকটা এখনো বেঁচে আছে?’

সেখান থেকে বেরিয়ে বোনের মেয়েটি আর দাঁড়াতেই চায় না। তাদের বিদায় দিতে দিতে মনে হলো। এই সেই কবি বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-৭৯) যাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ (১৯৩২) পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি।.

..পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপনবিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’

আজ ২৭ জুন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার ও শিশুসাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়ার ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীতে বিকেল সোয়া পাঁচটায় কবিকে নিয়ে হয় বিশেষ অনুষ্ঠান।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ হ দ ল ইসল ম র স মন বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

সিটি করপোরেশন ও পুলিশ কী করছে

রাজশাহী কলেজের সামনে এক মাস ধরে চলছে ফুটপাতের স্ল্যাব চুরির ঘটনা আর এর করুণ পরিণতি হলো একজন শিক্ষার্থীর নালায় পড়ে গুরুতর আহত হওয়া। সম্প্রতি সেখানে একই ধরনের আরও ঘটনা ঘটেছে। এটি আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার অবহেলা ও উদাসীনতার উদাহরণ। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এমন ঝুঁকিপূর্ণ ফুটপাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, প্রায় এক মাস রাজশাহী কলেজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে, যেখানে হাজারো শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ চলাচল করে, সেখানে ফুটপাতের স্ল্যাব চুরি হচ্ছে। প্রায় ৫০০ মিটার সড়কের দুই পাশে থাকা ফুটপাত থেকে অন্তত ২০টি স্ল্যাব চুরি হয়ে গেছে। গত বছরও শহরের বিভিন্ন রাস্তা থেকে স্ল্যাব ও লোহার ফ্রেম চুরি হয়েছিল, কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। এবারও স্ল্যাব চুরির ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে বলে জানা গেছে, কিন্তু সেটি সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

নালায় পড়ে আহত হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। স্থানীয় লোকজন গত ১০ দিনে অন্তত চারজনকে এই ফুটপাতে পড়ে যেতে দেখেছেন। এটি স্পষ্ট করে যে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে এবং কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পরও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একজন কলেজের ফটকের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি নিজের ছেলেকে আহত হওয়ার পর নিজেই চোর ধরার জন্য পাহারা দিচ্ছেন, কিন্তু তাতেও কোনো ফল হচ্ছে না।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল অবিলম্বে এই অরক্ষিত ফুটপাত মেরামত করা এবং স্ল্যাব চুরি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। শুধু কাগজে-কলমে ব্যবস্থা নিয়ে নাগরিকদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে রাখা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য শহরে আসে, কিন্তু শহরের অব্যবস্থাপনা তাকে হাসপাতালের বিছানায় ঠেলে দেয়, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?

এ ঘটনা একটি সতর্কতা। অবিলম্বে রাজশাহী কলেজের সামনের ফুটপাত সংস্কার করা হোক। একই সঙ্গে নগরজুড়ে এ ধরনের অরক্ষিত স্থানগুলো চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে সেগুলোর মেরামতের ব্যবস্থা করা হোক। নগর কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই দায়িত্ব পালনে তাদের ব্যর্থতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। স্ল্যাব চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিন নিয়ে বের হয়ে অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি একই কাজে জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের কীভাবে এ অপরাধকর্ম থেকে বিরত রাখা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পুরো আসনের ফল বাতিল করতে পারবে ইসি, ফিরছে ‘না’ ভোট 
  • লালমনিরহাটে সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় একজন গ্রেপ্তার
  • মৌচাকে হাসপাতালের পার্কিংয়ে প্রাইভেটকারে ২ মরদেহ 
  • তুরস্কে ভূমিকম্পে একজন নিহত, ধসে পড়েছে ১৬টি ভবন
  • তুরস্কে শক্তিশালী ভূমিকম্পে একজনের মৃত্যু, আহত ২৯
  • অসুস্থ ব্যক্তির জন্য দোয়া কীভাবে করব
  • সবুজবাগে ব্যবসায়ীকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তের ছোড়া গুলিতে পথচারী আহত
  • দেব আনন্দর স্বপ্ন সেদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল
  • ই–মেইলের জমানায় কদর নেই ডাকবাক্সের 
  • সিটি করপোরেশন ও পুলিশ কী করছে