শৈশবের স্মৃতি হাতড়াতে রাজশাহীতে কবিপুত্রের একদিন
Published: 27th, June 2025 GMT
১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে রাজশাহীতে এলেন কবি বন্দে আলী মিয়ার ছেলে জাহিদুল ইসলাম। সঙ্গে আনেন বোনের মেয়েকে। দেখাবেন রাজশাহীতে কোথায় তাঁদের বাড়ি ছিল। কোথায় তাঁরা বড় হয়েছেন। মুখস্থ পথে হেঁটে ঠিক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন; কিন্তু বাড়ির সামনে এসেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁদের সেই স্মৃতিঘেরা বাড়ি ভেঙে সেখানে উঠেছে বহুতল ভবন। ভাগনি বুঝতে পারলেন, মামার ঠিকানা হারিয়ে গেছে। বলল, ‘মামা, চলো বাড়ি যাই।’ কিন্তু জাহিদুল ইসলাম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৬৫ সাল থেকে মৃত্যুর (১৯৭৯) আগপর্যন্ত রাজশাহীতে ছিলেন। কাজ করতেন রাজশাহী বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে। সেই সুবাদে সরকারি বাসা পেয়েছিলেন। নগরের কাজীহাটা এলাকায় ছিল সেই বাসা। দীর্ঘদিন রাজশাহী থাকায় কবি ও তাঁর সন্তানদের অনেক স্মৃতি ছিল সেখানে। সেই স্মৃতি হাতড়াতে সান্তাহার থেকে ছুটে এসেছিলেন কবিপুত্র জাহিদুল ইসলাম। ডাকনাম চাঁদ। বয়স ৭১। তাঁরা আট ভাই ও চার বোনের মধ্যে এখন তিন ভাই ও তিন বোন বেঁচে আছেন।
সেদিন জাহিদুল ইসলামের সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল এ প্রতিবেদকের। রিকশায় উঠেই তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বেতারের সামনে যাও।’ কাজীহাটা এলাকায় বেতারের সামনে রিকশা থামল। নেমেই হনহন করে উত্তর দিকের একটি গলিতে হেঁটে গেলেন। কিছুদূর গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলেন। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। মাঝবয়সী একজন লোককে থামিয়ে জানতে চাইলেন, স্থানীয় কি না? লোকটি মাথা নাড়াতেই জানতে চাইলেন, এখানে কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়ি ছিল না? লোকটি এবার জোরে মাথা নেড়ে আঙুল তুলে দেখালেন, ওই যে ওখানে বাড়ি ছিল। সেই বাড়ি ভেঙে এই দালান উঠেছে।
জাহিদুল এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু সময় নিয়ে লোকটিকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে ফারুক ভাইয়ের বাড়ি কোনটা? কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটি জানালেন, ফারুক ভাই তো মারা গেছেন। এবার জাহিদুল পাড়ার দু-একজন মেয়ের নাম বললেন। লোকটি তাঁদেরও চিনতে পারলেন। কেউ কেউ মারা গেছেন এবং অন্যরা কোথায় আছেন বলে দিলেন। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলেন, ফারুক ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের চেম্বার পাশের একটি ভবনে।
অগত্যা সেখানে ছুটে গেলেন জাহিদুল ইসলাম। তখন ভেতরে টুপি পরে এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। ভেতরে ঢুকেই জাহিদুল বলে উঠলেন, ‘বাবু ভাই, আমাকে চিনতে পেরেছেন।’ লোকটি ইতস্তত করতে লাগলেন। এবার আরেকটু পরিষ্কার করার জন্য বললেন, ‘ভাই আমার নাম চাঁদ, আমি চাঁদ।’ তখন লোকটি আমতা-আমতা করে বললেন, ‘ও আচ্ছা, বসেন বসেন।’ তাঁকে চিনতে পেরেছেন দেখে অতি উৎফুল্ল হয়ে জাহিদুল নাম ধরে তাঁর অন্য সব ভাইবোনের কথা জানতে চাইলেন। লোকটি সংক্ষেপে কথাবার্তার উত্তর দিলেন। এমন সংক্ষিপ্ত উত্তরের জন্য কবিপুত্র বোধ হয় প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি হেসে হেসে আরও অনেক কথা বলতে চাইলেন। এবার লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘ভাই আর সময় দিতে পারব না। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।’
বের হওয়ার পর ভাগনি আর একদণ্ডও দাঁড়াতে চাইল না। বারবার বলছিল, ‘মামা রাত হয়ে যাবে। চলো, ফিরে যাই।’ কিন্তু জাহিদুল ততই গোঁ ধরছিলেন, ব্যাপারটা এমন—যেন তাঁর পরিচিত অনেক মানুষ এখানে আছেন। তিনি প্রমাণ করেই ছাড়বেন। মেয়েটার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নগরের রাজপাড়া থানা সড়কে নিয়ে গেলেন। তিনি কী করতে চাচ্ছেন, তা দেখতে প্রতিবেদকও পেছনে পেছনে যান। সড়কের বাঁ পাশে একটি গলির মুখে ঢুকে বললেন, ‘এই বাড়ি, এই বাড়িই হবে।’ নিশ্চিত হতে পাশের দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা রফিক ভাইয়ের বাড়ি না?’ দোকানি নিশ্চিত করলেন।
রফিক কবিপুত্রের সহপাঠী ছিলেন। দরজায় কড়া নাড়ার পর খুলে দিলেন তাঁর (রফিক) ছোট ভাই। তাঁকে নিজের পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোক বেশ চিনতে পারলেন। ভেতরে নিয়ে বসালেন। সেখানে কিছুক্ষণ শৈশবের গল্প চলল। তাঁর গলা শুনতে পেয়ে ভেতর থেকে একজন নারী বলে উঠলেন, ‘এ লোকটা এখনো বেঁচে আছে?’
সেখান থেকে বেরিয়ে বোনের মেয়েটি আর দাঁড়াতেই চায় না। তাদের বিদায় দিতে দিতে মনে হলো। এই সেই কবি বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-৭৯) যাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ (১৯৩২) পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি।.
আজ ২৭ জুন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার ও শিশুসাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়ার ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীতে বিকেল সোয়া পাঁচটায় কবিকে নিয়ে হয় বিশেষ অনুষ্ঠান।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ হ দ ল ইসল ম র স মন বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
জবি ছাত্র জোবায়েদ হত্যা মামলায় ২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জোবায়েদ হোসেন হত্যা মামলায় দুইজন সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
বুধবার (১৯ নভেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দীন তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
আরো পড়ুন:
সখীপুরে মেয়েকে হত্যার পর নিজেকে শেষ করলেন মা
নেত্রকোণায় চালককে হত্যা করে মোটরসাইকেল ছিনতাই
সাক্ষীরা হলেন, জবি শিক্ষার্থী সৈকত হোসেন এবং সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. ওয়াহিদুর রহমান। সৈকত নিহত জোবায়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই এবং ডা. ওয়াহিদ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি বর্ষার মামা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বংশাল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ হোসেন সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য আবেদন করেন।
জবানবন্দিতে সৈকত বলেন, “আমি জবির ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ও জোবায়েদ ভার্সিটির বড় ভাই। আমি জোবায়েদ ভাইয়ের ক্লোজ ছোট ভাই হওয়াতে বর্ষা আমার নাম্বার জোবায়েদ ভাই থেকে নেয়। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপ হাই, হ্যালো কথাবার্তা হত। ২-৩ মাস আগে বর্ষা আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তখন থেকে বর্ষার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। জোবায়েদ ভাই প্রায় ১ বছর ধরে বর্ষাকে বাসায় টিউশন পড়াত।”
তিনি বলেন, “ভার্সিটি এলাকায় থাকাকালে গত ১৯ অক্টোবর বিকেল ৫টা ৫৮ মিনিটের দিকে বর্ষা তাকে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেয়, ‘ভাইয়া কই তুমি?’ আমি জানাই ক্যাম্পাসে। বর্ষা বলে, ‘স্যারের আম্মুর নাম্বার আছে?’ কারণ জানতে চাইলে বর্ষা বলে, ‘লাগবে।’ ভাইয়ের কিছু হয়ছে কি না জানতে চাইলে বর্ষা বলে, ‘ভাইরে (জোবায়দে) কে জানি মাইরা ফেলছে।’ আমি বলি, মাইরা ফেলছে বলতে? বর্ষা বলে, ‘খুন করে ফেলছে।’ তখন বর্ষাকে কল দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। এরপর বিষয়টি বড় ভাইদের জানাই।”
ডা. ওয়াহিদুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, “গত ১৯ অক্টোবর সাপ্তাহিক নৈশ্যকালীন ডিউটি থাকায় বাসায় অবস্থান করছিলাম এবং ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ আমার স্ত্রীকে দ্বিতীয় তলার চাচাতো ভাই ফোন করে জানায়, সিঁড়িতে কোনো একজন লোক পড়ে আছে। আমরা তখন সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেখি সিঁড়ির মাঝামাঝি একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।”
তিনি বলেন, “তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকজন জড় হয়ে যায় এবং সেখানে শনাক্ত হয় যে, আমার ভাগ্নি বর্ষার প্রাইভেট টিউটর জুবায়েদের মরদেহ। তাৎক্ষণিক ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশকে অবহিত করি।”
বর্ষার মামা জানান, পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন তার ভাগ্নি বর্ষার সঙ্গে মাহির নামক এক ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং জোবায়েদ মাস্টারের সঙ্গেও বর্ষার প্রেম ছিল। এই দ্বন্দ্বের কারণে মাহির রহমান, জোবায়েদ মাস্টারকে হত্যা করে ঘটনার দিন দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, মো. জোবায়েদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতেন। প্রতিদিনের মতো গত ১৯ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বংশাল থানাধীন ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নুর বক্স লেনের ১৫ নম্বর হোল্ডিং রৌশান ভিলায় বর্ষাকে পড়ানোর জন্য যান।
সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটের দিকে ওই ছাত্রী জোবায়েদ হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই সৈকতকে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে জানায়, “জোবায়েদ স্যার, খুন হয়ে গেছে। কে বা কারা জোবায়েদ স্যারকে খুন করে ফেলছে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. কামরুল হাসান ৭টার দিকে জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেনকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তথ্যটি জানান। এনায়েত তার শ্যালক শরীফ মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে সাড়ে ৮টার দিকে ঘটনাস্থল রৌশান ভিলায় পৌঁছান। ভবনের নিচতলা থেকে ওপরে ওঠার সময় সিঁড়ি এবং দেয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পান। ওই ভবনের তৃতীয় তলার রুমের পূর্ব পার্শ্বে সিঁড়িতে জোবায়েদের রক্তাক্ত মরদেহ উপুড় অবস্থায় দেখতে পান।
ঘটনার দুইদিন পর ২১ অক্টোবর জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন বংশাল থানায় মামলা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে জোবায়েদকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলার ডান পাশে আঘাত করে হত্যা করেছে।
মামলায় বর্ষা, তার প্রেমিক মো. মাহির রহমান, মাহিরের বন্ধু ফারদীন আহম্মেদ আয়লান ২১ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছে।
ঢাকা/লিমন/মেহেদী