এই ভূখণ্ডের একরোখা বৈষম্যের ইতিহাস
Published: 26th, July 2025 GMT
১৯৮০-র দশকে আসাদ গেটের সামনে আমার স্কুল সেন্ট জোসেফ। একদিন শুনি সামনের কাতারের ছাত্র চিৎকার করে বলছে, ‘এই দেখ দেখ, চিঙ্কু যায়!’ চীনা লোক? মাও সে–তুংয়ের হাজার ফুল? তারা মোহাম্মদপুরে কী করছে, এই আদি ১৯৮৫ সালে? ভালোমতো তাকিয়ে দেখি গেটের বাইরে একজন আদিবাসী ছেলে। সে পাহাড়ি না সমতলের, বাংলাদেশের ২৭টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কোনটি—তাতে কিছু আসে যায় না। মুখের গড়নের কারণে বাঙালি, প্রধানত বাঙালি মুসলমান, ছাত্ররা তাঁকে নিষ্ঠুর বর্ণবাদী গালি দেওয়ার অধিকার পেয়ে গেল।
১৪ বছর বয়সে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে যাই, কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্প দেখতে। মেশিনের শব্দ প্রচণ্ড। তার ওপর দিয়ে আমার চাচা যন্ত্রপাতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি সবেমাত্র বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর প্রকৌশলী কৌতূহল জলবিদ্যুৎ নিয়ে। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, মেশিনগুলো ছিল প্রযুক্তিগত বিস্ময়। আমি স্কুলে ফিরে একটি বিজ্ঞান প্রকল্পের স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু এই বিদ্যুৎজাদুর পেছনে ১৯৬৫ সালে চাকমা সম্প্রদায়ের হাজার হাজার পরিবার ও গ্রামের উচ্ছেদের ঘটনা আমার চাচা হয়তো জানতেন না। নির্মম সেই ঘটনামালা প্রকাশিত হতে লেগেছে বহু দশক। অতি সম্প্রতি অ্যাডভোকেট সমারী চাকমা লিখেছেন মৌখিক ইতিহাসের যুগান্তকারী কাজ কাপ্তাই বাঁধ বর-পরং: ডুবুরিদের আত্মকথন (ইউপিএল, ২০২৪)।
সেন্ট জোসেফ শিক্ষা পর্ব শেষ করার পরে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার যাই। এবার আমার সঙ্গী জুম্ম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কর্মীরা, তাঁদের মধ্যে সমারি চাকমাও ছিলেন। সে সময়ে দেখি, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের রূপকথা (‘বাংলাদেশে সকল জনগোষ্ঠী মিলেমিশে থাকে’) এবং জুম্ম জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনের বাস্তবতার মধ্যে এক বিশাল ফারাক। আমি ভাবতাম, বোধ হয় শুধু একাত্তরের প্রজন্মেরই এই দেখার ভুল। তারা মেঘের অনেক রং চলচ্চিত্র (১৯৭৬) এবং সেটির অভিনেত্রী মাথিনকে নিয়ে পত্রিকার প্রচ্ছদকাহিনি করে ক্ষান্ত হয়েছে। পরের দশকে বুঝেছি বাঙালি মুসলমান পুরুষের পক্ষে ভিন্ন জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গকে সমান কাতারে না দেখার রেওয়াজ কোনো প্রজন্ম ভাঙতে পারেনি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর ‘কী পেলাম’-জাতীয় বিষয়ে গোলটেবিল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাগ্যুদ্ধ চলছে। আলোচনার স্বরে চলে এসেছে অবসাদের ছায়া। ঘটনাপ্রবাহ এবং বিশেষত আবারও নারী অধিকার খর্বের জলসা দেখে, বিজয় প্রসাদের আরব বসন্ত, লিবিয়ার শীত (একে প্রেস, ২০১২) বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। প্রসাদের বয়ানে পশ্চিমা দেশের সহায়তায় লিবিয়ার গাদ্দাফিকে উৎখাত করার পর আরব বসন্তের আশা ধূলিসাৎ হয়। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় ‘আমরা সবাই রাজা’ জোশে স্থায়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যার অবসান আজও ঘটেনি। তবে প্রসাদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলা যায়, বসন্তের মৃত্যুঘণ্টা সবার আগে সেই মিসরের তাহরির স্কয়ারেই শোনা যায়। তাহরিরে যুব-বিপ্লবের মধ্যেও কিছু সাংবাদিক লেখেন যে নারী অধিকার প্রশ্নে ইতিমধ্যে বিপজ্জনক সংকেত দেখা যাচ্ছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর আসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতা ছিলেন আরেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, মোহাম্মদ আল বারাদায়ী। বারাদায়ীর অধীনে এক অস্থির পরিস্থিতি, অবশেষে নির্বাচনের আগে নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয় এবং এক বছর পর ব্রাদারহুডের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথমে রাস্তার আন্দোলন এবং পরে মুরসির সেনা অভ্যুত্থান।
সমতল থেকে পাহাড়ে সমান অধিকারের দাবিতে গ্রাফিতি.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অনুমোদনের প্রথম দিন সেন্ট মার্টিন যায়নি কোনো পর্যটকবাহী জাহাজ
দীর্ঘ ৯ মাস পর শনিবার থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রথম দিন কোনো জাহাজ সেন্ট মার্টিনে না যাওয়ার কারণে পর্যটকেরা দ্বীপে যেতে পারেননি। হাজারো পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যেতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। অন্যদিকে জাহাজমালিকেরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন শর্তের কারণে পর্যটকদের আগ্রহ না থাকায় জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্বীপটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলে সরকারের কোনো বাধা নেই। লিখিতভাবে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে দিনে গিয়ে দিনেই চলে আসতে হবে; রাতে থাকা যাবে না।
এদিকে রাতে থাকার সুযোগ না থাকায় পর্যটকেরা যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ, দীর্ঘ সময় ভ্রমণ করে দ্বীপে গিয়ে আবার সেদিনই চলে আসতে হবে। এ কারণে জাহাজমালিকেরাও জাহাজ চালাতে অনীহা প্রকাশ করছেন। তাঁদের দাবি, দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম বলেন, জাহাজমালিকেরা যদি জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের জারি করা ১২টি নির্দেশনা এবার কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করবে জেলা প্রশাসন।
শাহিদুল আলম বলেন, আগে টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করলেও নিরাপত্তার কারণে এখন কক্সবাজার শহর থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত করবে।
সি ক্রুজ অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকে জাহাজ ছেড়ে গেলে সেন্ট মার্টিন পৌঁছাতে সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগে। ফলে পর্যটকেরা কিছুই ঘুরে দেখতে পারবেন না। দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি ব্যবসার জন্যও তা অলাভজনক। এ কারণেই অনেক পর্যটক সেন্ট মার্টিন যেতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।
হোসাইন ইসলাম আরও বলেন, রাতযাপন করার সুযোগ না থাকলে সেন্ট মার্টিনের পর্যটন মৌসুম জমে না। পর্যটকেরা রাতের সৈকত দেখতে চান, ঢেউয়ের শব্দ শুনতে চান। সেটাই তো সেন্ট মার্টিনের আসল আকর্ষণ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে। এ লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুনসেন্ট মার্টিনে নিষেধাজ্ঞা উঠছে কাল, তবে জাহাজ চলবে কি৩১ অক্টোবর ২০২৫