দেশে-বিদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় খাদ্যের সন্ধানে
Published: 24th, September 2025 GMT
বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আমার যোগসূত্র ছিল বেশ ক্ষীণ, মূলত আমার রবীন্দ্রভক্ত বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যতটুকু পেয়েছি। কয়েক মাস ধরে রবীন্দ্রনাথে অবগাহন করেছি, তাঁর গান-কবিতায় নিমগ্ন হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকেও আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল এবং নোবেল বিজয়ী হিসেবে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা সংস্কৃতির একজন আইকন। মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ? তাঁর কথা ভাবলে কেবল একটা শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখের ছবিই মানসপটে ভেসে ওঠে। একজন ভোজনরসিক এবং খাদ্যবিষয়ক লেখক হিসেবে, আমি সব সময় আগ্রহী ছিলাম রবীন্দ্রনাথের খাদ্যরুচি নিয়ে। এ বিষয়ে মনে আসে ফরাসি রন্ধনবিশারদ জিন অ্যান্থেলমে ব্রিলাট সাভারিনের সেই বিখ্যাত উক্তি—‘তুমি কী খাও তা জানতে পারলে, মানুষ হিসেবে তুমি কেমন তা বোঝার কিছুই বাকি থাকে না।’
খাবারদাবার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজে খুব বেশি লেখেননি, কিন্তু তাঁর বংশধরসহ অন্যদের কাছ থেকে তাঁর এই ভোজনরসিক দিকটির কথা জানা যায়৷ তাঁর শৈশবের স্মৃতিকথা, ‘আমার ছেলেবেলা’–তে খাবারের প্রসঙ্গ কিছু কিছু এসেছে। যদিও জমিদারি পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছে বেশ কষ্টসহিষ্ণুতার শিক্ষার ভেতর দিয়েই, যেটা তাঁর বাবাই চাইতেন। একটা বড় সময় তিনি কাটাতেন চাকরদের মহলে। স্মৃতিকথায় উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁদের সেই সব সাদাসিধে খাবারদাবারের অকপট বর্ণনাই তিনি দিয়েছেন।
ভ্রমণপিপাসু রবীন্দ্রনাথ একে একে পৌঁছে যান ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড আর তুরস্কে, আর সেখানকার খাদ্যাভ্যাসগুলো আত্মস্থ করে নেন সময়ের সঙ্গে। যেহেতু ভারতীয় আর পশ্চিমা দুই ধরনের খাবারের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ছিল, এই দুইয়ের একটা মেলবন্ধন ঘটানোর ইচ্ছা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে জাগ্রত হয়।পাতলা বইখানিতে, চাকরের নিয়ে আসা টিফিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যখন ব্রজেশ্বরের ফর্দ এড়িয়ে জলপানে বরাদ্দ হলো পাউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন, মনে হলো আকাশ যেন হাতে নাগাল পাওয়া গেল।’ তারপর আবার বলেছেন, ‘সেই কম খাওয়াতে আমাকে কাহিল করেছিল এমন কথা বলবার জো নেই। যে ছেলেরা খেতে কসুর করত না তাদের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি বই কম ছিল না।’ রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ঘরে বানানো সাদাসিধে খাবারই বেশি খেতেন তখন। ব্যামো থেকে উঠে এসে এসব খাবার কেমন মুখরোচক লাগত, সে প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘তিন দিনের দিনই মৌরলা মাছের ঝোল আর গলা ভাত উপোসের পর ছিল অমৃত।’
আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলিসন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস-হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতেরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, ছেলেবেলার এসব সাধারণ খাবারদাবারের বাইরে নানা রকম উপাদেয় খাবারের বিষয়ে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। নিজের লেখা ছাড়াও, অন্যান্য অনেক সূত্র থেকেই আরও সুরভিত ও আড়ম্বরপূর্ণ খাবারদাবারের প্রতি তাঁর আকর্ষণের খোঁজ পাই। মাত্র ৮ বছর বয়সেই কিন্তু তিনি খাবার নিয়ে একটা লিমেরিক লিখেছিলেন, যা সেই সময়টাকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে:
আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস-হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে
রবীন্দ্রনাথের রসনাবিলাস নজরে আসে, যখন বড় হয়ে তিনি দেশ-বিদেশ ঘুরছেন আর ঘরে ফিরে সেখানে খাওয়া নানা খাবার ফের বানানোর চেষ্টা করছেন। প্রায়ই যেতেন দেশের বাইরে, আর সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন পছন্দসই নতুন রেসিপি। ঠাকুরবাড়ির রান্না ছিল গোটা ভারতের আর বাকি দুনিয়ার নানা রকম স্বাদের এক সংমিশ্রণের জায়গা। যেমন বলা যায় কাবাবের কথা, তিনি কাবাব ভালোবাসতেন, যার মধ্যে কোনো কোনোটা ছিল একেবারেই অপ্রচলিত। এই কাবাবগুলো ধীরে ধীরে ঠাকুরবাড়ির পাতে জায়গা পেতে শুরু করে।
ভ্রমণপিপাসু রবীন্দ্রনাথ একে একে পৌঁছে যান ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড আর তুরস্কে, আর সেখানকার খাদ্যাভ্যাসগুলো আত্মস্থ করে নেন সময়ের সঙ্গে। যেহেতু ভারতীয় আর পশ্চিমা দুই ধরনের খাবারের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ছিল, এই দুইয়ের একটা মেলবন্ধন ঘটানোর ইচ্ছা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে জাগ্রত হয়। রবীন্দ্রনাথের জিবে লেগে থাকা এসব স্বাদ আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় গলদঘর্ম হতে হতো ঠাকুরবাড়ির রাঁধুনিদের।
রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন মুরগি আর মাটনের পাই; চিংড়ি আর হ্যামের প্যাটিস; ব্রেডক্রাম্ব দিয়ে রোস্ট করা মুরগি-মাটন বা আনারসে রোস্ট করা মাটন; চিংড়ির কাটলেট। বাঙালি রান্নার মধ্যে মাছ। তাঁর প্রিয় মাছের পদগুলো হলো কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগডাল, নারকেল-চিংড়ি, আদার মাছ আর ভাপা ইলিশ।রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন পাই, প্যাটিস, রোস্ট আর কাবাব—মুরগি আর মাটনের পাই; চিংড়ি আর হ্যামের প্যাটিস; ব্রেডক্রাম্ব দিয়ে রোস্ট করা মুরগি-মাটন বা আনারসে রোস্ট করা মাটন; চিংড়ির কাটলেট। যেসব কাবাবের স্বাদ তাঁর কাছে মুখরোচক ঠেকত তার মধ্যে ছিল সুরাতী মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি টার্কিশ কাবাব আর চিকেন কাবাব নোসি। বাঙালি রান্নার স্বাদও তিনি ভালোবাসতেন, বিশেষ করে বাঙালির প্রধান খাদ্য, মাছ। তাঁর প্রিয় মাছের পদগুলো হলো কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগডাল, নারকেল-চিংড়ি, আদার মাছ আর ভাপা ইলিশ।
ঠাকুরবাড়ির অন্যতম নিদর্শনই হয়ে উঠেছিল এই পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধন। এ বাড়ির আরও অনেকেই ঘুরতে ভালোবাসতেন, আর দূর-দূরান্ত থেকে খুঁজে আনতেন নতুন রেসিপি। বাঙালির মিষ্টিপ্রেম প্রবাদতুল্য, ঠাকুরবাড়ির লোকজনও এর বাইরে ছিলেন না। তবে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ছানার মিষ্টি বা সন্দেশের চেয়ে একদমই আলাদা, ফুলকপির তৈরি একরকম মিষ্টি ছিল এ বাড়ির লোকদের বেশি পছন্দের। দেশি-বিদেশি দুই রকম খাবারেরই সহাবস্থান ছিল এ বাড়ির রান্নাঘরে৷
ঠাকুরবাড়িতে দুপুরে খাওয়া হতো ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে, মাটিতে বসে। কিন্তু রাতের খাবার খাওয়া হতো পশ্চিমা কেতায়, চেয়ার–টেবিলে। রবীন্দ্রনাথ ছুরি-কাঁটা চামচ, রুপার তৈজসপত্র ব্যবহার করেই খেতেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য আর প্রতীচ্যকে এক পাকে বেঁধেছিলেন, চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন বৈশ্বিক। এ জন্য মাছ-ভাতের মতো পাই-প্যাটিসও যে তিনি সমান ভালোবাসতেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শৈশব স্মৃতিকথার শেষের দিকে, ইংল্যান্ড সফর ও সেখানে পাওয়া শিক্ষার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘নিজের মধ্যে নিয়েছি পূব-পশ্চিমের হাত মেলানো—আমার নামটার মানে পেয়েছি প্রাণের মধ্যে।’ রবি, যে কিনা আকাশকে প্রদক্ষিণ করে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ঠ ক রব ড় র র স ট কর ম ছ আর পছন দ
এছাড়াও পড়ুন:
আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার এই দেশে ক্লোজড: সারজিস আলম
ছবি: প্রথম আলো