প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, বাণিজ্য-সংক্রান্ত চুক্তির জন্য আলোচনা ও দর-কষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষতা বাড়াতে পারেনি; বরং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য-সুবিধা পেয়ে আসছে। এতে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে।

আজ বুধবার রাজধানীতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস-বিস) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথাগুলো বলেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী। শুল্ক চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ কীভাবে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারে, তা নিয়ে সেমিনারটির আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান।

অনুষ্ঠানে আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো এলডিসিতে যোগ দেয়নি। এর পরিবর্তে তারা শুরু থেকেই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও দক্ষ ট্রেড নেগোসিয়েশন টিম গড়ে তুলেছে। আমরা (বাংলাদেশ) সেটা করিনি। বাণিজ্য আলোচনায় আমাদের দক্ষতা কম। এ কাজে সরকারের ওপরই অত্যধিক নির্ভরশীল থাকতে হয়।’

এলডিসি উত্তরণ পেছানো সহজ কাজ হবে না বলে জানান আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এখন অনেকেই এলডিসি উত্তরণ পেছানোর কথা বলছেন। কিন্তু বিষয়টি শুধু সরকারের হাতে নেই। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ নিয়ে ভোটাভুটি হয়। সেখানে ১৯৩টি দেশের মধ্যে আমাদের অন্তত ৯৭টি দেশের সমর্থন (ভোট) লাগবে। এটা এত সহজ নয়। কারণ, অন্য দেশগুলো আমাদের সুবিধার জন্য কেন ভোট দেবে? আমরা এলডিসির সর্বাধিক সুবিধা ভোগ করি। এ নিয়ে অন্য দেশগুলো আমাদের ঈর্ষা করে। তাই আমাদের বাস্তবধর্মী হতে হবে।’

ডব্লিউটিওর নিয়ম না মেনে কোনো দেশের সঙ্গে একতরফা শুল্ক বা অশুল্ক বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। আমাদের কিছু এফটিএ, কিছু পিটিএ ও কিছু ইপিএ আলোচনা চলমান রয়েছে। বিশেষ করে এলডিসি উত্তরণের আগে বা পরে দেশের বাজার রক্ষা করতে আমাদের এসব চুক্তি করতে হবে।—মাহবুবুর রহমান, বাণিজ্যসচিব

আনিসুজ্জামান চৌধুরী জানান, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী পরিবর্তনের সময় অনেক শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের জন্য নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে হবে। সরবরাহ, জ্বালানি, বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ প্রভৃতি খাতে দ্রুত সংস্কার আনতে হবে। পাশাপাশি কর-জিডিপি অনুপাতও বাড়াতে হবে। এ ছাড়া শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কমানো বা মজুরি বাড়ানোর মতো পদক্ষেপগুলো শুরুতে বাড়তি খরচ মনে হলেও তা পরে উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সার্বিক বিষয়ে জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে হবে।

আনিসুজ্জামান চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমরা প্রায়ই সরকারকে সব দোষ দিই, কিন্তু নিজেরা সহযোগিতা করি না। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো ঔপনিবেশিক মানসিকতায় আটকে আছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে স্ক্যানার বসানো, জাতীয় সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেম চালুসহ সংস্কারের সফল উদাহরণ আছে।’

বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা বহুপক্ষীয় বিশ্বে কাজ করছি। ফলে ডব্লিউটিওর নিয়ম না মেনে কোনো দেশের সঙ্গে একতরফা শুল্ক বা অশুল্ক বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের কিছু এফটিএ, কিছু পিটিএ ও কিছু ইপিএ আলোচনা চলমান রয়েছে। বিশেষ করে এলডিসি উত্তরণের আগে বা পরে দেশের বাজার রক্ষা করতে আমাদের এসব চুক্তি করতে হবে।’

উদাহরণ দিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্রের মোটরযানকে আমরা শুল্কমুক্ত করি, তাহলে জাপানও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই সুবিধা ভোগ করবে। এটাই নিয়ম। আমরা নিয়মভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাস করি। তাই নিয়মের বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়। এটাই আমরা বোঝাতে চেষ্টা করেছি এবং আংশিক সফল হয়েছি। এ ছাড়া যেকোনো পক্ষ চাইলে ছয় মাসের নোটিশ দিয়ে শুল্ক চুক্তি থেকে বের হতে পারবে। এটি আমরা শুল্ক চুক্তির খসড়ায় যুক্ত করতে পেরেছি। এটিও বাংলাদেশের বড় সাফল্য।’

বিআইআইএসএসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবির, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রসুল ও তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান।

বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে অনেক ব্র্যান্ড চীন থেকে তাদের উৎপাদন সরিয়ে নিচ্ছে। নতুন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের সামনে এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। এ নিয়ে আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

ইনামুল হক খান আরও বলেন, ‘মার্কিন ক্রেতারা পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য, ট্রেসেবিলিটি ও কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এসব বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। পণ্য তৈরিতে বাংলাদেশ এখনো তুলা থেকে তৈরি সুতার ওপর ৭০ শতাংশ নির্ভর করে। কিন্তু বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে হলে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারও বাড়াতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য আম দ র এলড স

এছাড়াও পড়ুন:

ট্যাগিংয়ের রাজনীতির বিদায়, নাকি নতুন সূচনা

বাংলাদেশে রাজনীতির আলোচনায় ‘হাইপ’ (অতি উচ্ছ্বাস) তৈরি হওয়া নতুন কিছু নয়। যখন কোনো বিষয় হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তখন আমরা সবাই এ ধরনের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাই। কিন্তু উত্তেজনা কমে গেলে আমরা কয়জনই–বা ফিরে তাকাই, বাস্তবতার আলোকে বিষয়গুলো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করি?

মনে পড়ে, গত বছর কিছু মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত হাইপ তৈরি হয়েছিল—‘ড. ইউনূসকে আমরা পাঁচ বছর চাই।’ সে সময়কার উত্তেজনা, বিতর্ক আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজন কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, সেটা এখন অনেকেই নতুন করে বুঝতে পারছেন। অথচ তখন আমরা কেউই সেটাকে গভীরভাবে খতিয়ে দেখিনি। এখন ফিরে তাকালে বোঝা যায়, হাইপের ঢেউ যত বড় হয়, বাস্তবতার ভিত ততটা মজবুত হয় না।

সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনকে শুধু হাইপ দিয়ে দেখলে ভুল হবে। এই নির্বাচন সত্যিই কি ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতির দিকনির্দেশক, নাকি এটা সাময়িক উচ্ছ্বাস, যা কিছুদিন পরই মিলিয়ে যাবে?

ট্যাগিংয়ের রাজনীতি: নাম পাল্টেছে, স্বভাব পাল্টায়নি

ছাত্র সংসদের নির্বাচনের পর শিক্ষার্থীরা এখন দাবি করছে—‘ট্যাগিং রাজনীতি আর চলবে না’। কিন্তু বাস্তবে কি আমরা ট্যাগিং বন্ধ হতে দেখছি?

শেখ হাসিনার আমলে বিরোধীদের দমনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল ‘রাজাকার’ ট্যাগ দেওয়া। সেই ট্যাগে জামায়াত ও তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির এবং বিএনপি সবচেয়ে বেশি ভুগেছে। তখন মনে হয়েছিল, হয়তো এ প্রবণতা একদিন শেষ হবে। কিন্তু এখন আবার নতুন আঙ্গিকে ও ভয়ংকর রূপে ফিরে এসেছে এই ট্যাগিং।

আজকে অনলাইন-অফলাইনে আমরা প্রতিদিনই শুনছি—কেউ নাস্তিক, কেউ ইসলামবিদ্বেষী, কেউ শাহবাগী; ‘শাহবাগী গোসল করে না’ এবং নারীবিদ্বেষী অনেক ধরনের মন্তব্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বট বাহিনী’ দিন-রাত এই ট্যাগগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ট্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিল যারা, তারাই আবার ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছে। অনেকটা এ রকম বলা যায়, এককালে যারা মজলুম (নিপীড়িত) ছিল, তারাই জালিম (অত্যাচারী) হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আরও পড়ুনট্যাগের মহিমা: ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’১৮ নভেম্বর ২০২৪

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, শিক্ষিত মানুষ, এমনকি আইনকানুন জানা ব্যক্তিরাও এখন ট্যাগিংয়ের ভাষায় কথা বলছেন। সম্প্রতি একটি টক শোতে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক একজন ‘ব্যারিস্টার’ যুক্তিতর্ক না দিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমানকে ‘নাস্তিক’ ও ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলে আক্রমণ করেছেন। ডা. জাহেদ দাবি করেছেন, এর ফলে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এদিকে এবি পার্টির নেতা আরেক ‘ব্যারিস্টার’ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ছাত্রদলকে দেখলে মনে হয়, তারা গাঁজাখোর, চাঁদাবাজ।’ এ ধরনের মন্তব্য কি রাজনৈতিক যুক্তি, নাকি সরাসরি ট্যাগিং?

অন্ধ আত্মবিশ্বাস: ইতিহাস, বাস্তবতা ও শিক্ষা

জামায়াতে ইসলামী এখন একধরনের অন্ধ আত্মবিশ্বাসে ভুগছে বলে অনেকের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা ধরে নিচ্ছে—ডাকসু বা জাকসু নির্বাচনের সাফল্য মানেই জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি জয়ের রাস্তা খুলে যাবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, কেবল আত্মবিশ্বাস বা কয়েকটি সাময়িক সাফল্য কোনো রাজনৈতিক দলকে স্থায়ী শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে না। পুরো বিষয়টা এতটা সরলীকরণ না করে আরও গভীরে দেখা দরকার।

জামায়াত মনে করছে, তারা সমাজে অনেক ‘সেবামূলক’ কাজ করছে এবং এসব দিয়েই নির্বাচনে জয় আসবে। কিন্তু শুধু ‘সেবামূলক’ কাজ দিয়ে কি নির্বাচনে জেতা যায়? বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তেমনটা বলে না।

২০০৬ সালের সেনাশাসন-পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হলে সমাজে হঠাৎ ধারণা তৈরি হয়েছিল—জামায়াতই একমাত্র সৎ মানুষের দল। চারদলীয় জোট সরকারের অংশ হয়েও তারা দুর্নীতিতে জড়ায়নি—এমন কথা বলে একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছিল।

আরও পড়ুনশিবিরের উত্থানের রাজনীতি, বাস্তবতা ও নানা সমীকরণ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নানা ঘটনাপ্রবাহের পর জামায়াতের পরামর্শ মেনে বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। সেই নির্বাচনের ফল হলো ধারণার চেয়ে ভিন্ন। ‘সৎ মানুষের ইমেজ’ নিয়েও জামায়াত মাত্র দুটি আসন পায়। এ থেকে বোঝা যায়, মাঠের রাজনীতি কেবল সততার ইমেজ বা সমাজসেবার মতো কাজ দিয়ে হয় না, এখানে আরও জটিল হিসাব-নিকাশ ও সমীকরণ কাজ করে।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে বহু মানুষ নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে, আত্মত্যাগ করেছে। তারা ভেবেছিল, দেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল, সেই আন্দোলনের কোনো কোনো নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। এ রকম একটি রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরও তারা কেন দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন—এ প্রশ্ন আজ অনেকেই করছেন।

*ট্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিল যারা, তারাই আবার ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছে। অনেকটা এ রকম বলা যায়, এককালে যারা মজলুম (নিপীড়িত) ছিল, তারাই জালিম (অত্যাচারী) হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
* পিআর পদ্ধতির ইস্যুটি এখনো সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। যারা দাবি করছে ‘৭০ শতাংশ মানুষ পিআর চায়’, তারা আসলে অসত্য তথ্য দিচ্ছে।
* বড় কোনো রাজনৈতিক সংস্কার যদি তাড়াহুড়া করে এবং যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বাস্তবায়ন করা হয়, সেটা শেষ পর্যন্ত দেশকে নতুন সমস্যার দিকে ঠেলে দেয়।

এর মানে কি আমরা ধরে নিয়েছিলাম, গণ-অভ্যুত্থানের পর হঠাৎ সবার মধ্য নীতিনৈতিকতার বোধ তৈরি হবে? কিন্তু বাস্তবতা বলছে, তেমনটা হয়নি। এ রকম অভিযোগও উঠেছে, কোনো কোনো খাতে আগের আমলের চেয়ে এখন দুর্নীতি আরও বেড়েছে।

ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি—এসব আমাদের সমাজে বছরের পর বছর ধরে চলছে। এগুলোর বিস্তার এতটাই ঘটেছে যে সাধারণ মানুষ এখন এগুলোকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করে। তাই শুধু সততার ইমেজ দিয়ে রাজনীতির মাঠে খুব সুবিধা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

ভ্রান্ত পথের ঝুঁকি

জামায়াত দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে একটি দক্ষ ও ‘সুশৃঙ্খল’ কর্মিবাহিনী তৈরি করেছে। কিন্তু এখন যদি সেই কর্মীদের কেবল ‘বট বাহিনী’তে রূপান্তর করা হয় আর ‘হাই কমান্ড’ থেকে আসা মেসেজই শুধু তারা ডেলিভার করে, তাহলে ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব যুক্তি, চিন্তা ও রাজনৈতিক চেতনা হারিয়ে যাবে। রাজনীতি তখন আর সৃজনশীলতা বা বাস্তবতাভিত্তিক হবে না; বরং যান্ত্রিক প্রতিধ্বনিতে পরিণত হবে।

আওয়ামী লীগের উদাহরণটা এখানে খুবই শিক্ষণীয়। তারা ২০১৪ সালের পর নিজেদের সাংস্কৃতিক শক্তি ও আদর্শিক কর্মীদের হারিয়ে কেবল ‘বট বাহিনী’র ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছিল। এর ফলে তারা মানুষের আস্থা হারিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, জামায়াত কি একই ভুল করছে?

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের আগেও দেশে একাধিক সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। এসব আন্দোলনে অনলাইন নির্ভরশীলতার কিছু উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা দরকার। কারণ, তখন সোশ্যাল মিডিয়া যেন একধরনের বিকল্প বাস্তবতা তৈরি করেছিল।

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, ট্যাগিংয়ের রাজনীতি এবং ‘বট বাহিনী’ ব্যবহার করে অনলাইনে সাময়িকভাবে হাইপ তোলা যায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এগুলো সমাজে বিভক্তি-বিভাজন তৈরি করে। ভারতে বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এ রকম কাজ করেছে। বাংলাদেশেও একই রকম প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

’২৪ সালের শুরুতে তৎকালীন হাসিনা সরকার ডামি নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো রাজপথে আন্দোলনে নেমেছিল। সে সময় কিছু ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সার প্রতিদিন ঘোষণা দিচ্ছিল, ‘আওয়ামী লীগ কয়েক দিনের মধ্যেই পড়ে যাবে।’ তাদের এসব ভাইরাল ভিডিও অনেক মানুষ বিশ্বাসও করেছিল। কিন্তু বাস্তব কী হলো? আওয়ামী লীগ সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল না; বরং আরও কয়েক মাস টিকে গেল।

এসব ঘটনাপ্রবাহের সঠিক বিশ্লেষণ করেছিলেন অল্প কয়েকজন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান তখন পরিষ্কার করে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আরও কিছুদিন টিকে থাকবে। একইভাবে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট জিয়া হাসান যুক্তি দিয়েছিলেন, ঢাকায় বিএনপি লাখো মানুষ আনলেও পুলিশ ও প্রশাসন আওয়ামী লীগকে রক্ষা করবে, তাই সরকার সঙ্গে সঙ্গে পড়বে না। পরে দেখা গেল, তাদের এই পূর্বাভাসই বাস্তবতার কাছাকাছি ছিল।

আরও পড়ুনবেপরোয়া ছাত্রলীগ, হিন্দু শিক্ষার্থীকেও ‘শিবির’ ট্যাগ ও ভয়াবহ নির্যাতন০৭ জুন ২০২৪

অন্যদিকে যারা প্রতিদিন আওয়ামী লীগের পতনের কাউন্টডাউন চালাচ্ছিল, তাদের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলো না। এমনকি, ২০২৪ সালের জুনে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তখন এসব ইনফ্লুয়েন্সারের কেউ দাবি করছিল, ‘ছাত্র আন্দোলন আসলে ভারতের প্রজেক্ট।’ এখন জামায়াত যদি এসব ইনফ্লুয়েন্সার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনে করে যে সোশ্যাল মিডিয়ার হাইপই তাদের জয়ের নিশ্চয়তা দেবে, তাহলে তারা ভুল করবে। বিভিন্ন কারণে জামায়াতের সমর্থন কিছুটা বাড়তে পারে, কিন্তু ইতিহাস আমাদের সতর্ক করে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি দলটি প্রথমে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রথম দিকে তারা তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পরে কী হলো? তাদের জনপ্রিয়তা যে কমতে শুরু করেছে, এটা এখন অস্বীকার করার উপায় নেই। এর একটা অন্যতম কারণ হলো, যেকোনো ইস্যুতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করা বা অন্যদের উসকে দেওয়া। এ রকম কর্মকাণ্ড মানুষ কিছুদিন মেনে নিলেও শেষ পর্যন্ত এ ধরনের রাজনীতি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে।

আরও পড়ুনশিক্ষার্থীদের পিটিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ রক্ষা হবে কি১৬ জুলাই ২০২৪

জামায়াত সম্ভবত একই রকম ভুল করছে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে তারা সংসদের উভয় কক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন) পদ্ধতির দাবি নিয়ে অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছে। এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হতে পারে। পিআর পদ্ধতির ইস্যুটি এখনো সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। যারা দাবি করছে ‘৭০ শতাংশ মানুষ পিআর চায়’, তারা আসলে অসত্য তথ্য দিচ্ছে। এ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা বা জরিপ হয়নি।

বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনায় দেখা গেছে যে বড় কোনো রাজনৈতিক সংস্কার যদি তাড়াহুড়া করে এবং যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বাস্তবায়ন করা হয়, সেটা শেষ পর্যন্ত দেশকে নতুন সমস্যার দিকে ঠেলে দেয়। যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাময়িক সমাধান দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা নানা জটিলতার জন্ম দিয়েছে।

কাজেই জামায়াত যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠা হাইপ আর নিজেদের ‘সৎ ইমেজ’ বিবেচনায় নিয়ে ভেবে থাকে যে পিআর পদ্ধতির পক্ষে আন্দোলনে জনগণ তাদের সঙ্গে থাকবে, তাহলে বুঝতে হবে, তাদের হিসাব-নিকাশে বড় ভুল আছে। পিআর নিয়ে আন্দোলনে বরং মানুষ বিরক্ত হতে পারে, যার মাশুল রাজনীতির মাঠে তাদের দিতে হবে।

আরও পড়ুনবিএনপি যখন সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার৩১ আগস্ট ২০২৫

আরব বসন্তও আমাদের প্রায় একই শিক্ষা দেয়। মিসর, তিউনিসিয়া কিংবা লিবিয়ায় প্রথমে মনে হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঢেউ শাসন বদলে দেবে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে দেখা গেল, সংগঠিত রাজনৈতিক দল আর দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ছাড়া সেই পরিবর্তন স্থায়ী হয়নি। গবেষক ইভজেনি মোরোজভ সতর্ক করেছিলেন, ‘ডিজিটাল ইউটোপিয়ানিজম বিপজ্জনক; কারণ, এটি বাস্তব শক্তির কাঠামোকে আড়াল করে।’ (দ্য নেট ডিলুশন, ২০১১)

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, ট্যাগিংয়ের রাজনীতি এবং ‘বট বাহিনী’ ব্যবহার করে অনলাইনে সাময়িকভাবে হাইপ তোলা যায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এগুলো সমাজে বিভক্তি-বিভাজন তৈরি করে। ভারতে বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এ রকম কাজ করেছে। বাংলাদেশেও একই রকম প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

মধ্যপন্থার রাজনীতি

এনসিপি প্রথমে মধ্যপন্থী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। তাদের গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা হিসেবে ইমেজ, তারুণ্য আর নতুন ধারার রাজনীতির প্রতিশ্রুতি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজকে আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু নানা বিভ্রান্তিকর কাজের কারণে তারা মূল সমর্থকশ্রেণিকে ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছে।

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতা-কর্মীর অন্যান্য দলে যোগ দেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটাকে আমরা কীভাবে দেখব? যারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি করেছে, তারাই আবার তাদের দলে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের জায়গা দিচ্ছে, এটা কি স্ববিরোধিতা হলো না?

বিএনপি ও এনসিপি যদি সত্যিই নিজেদের মধ্যপন্থী দল হিসেবে দাবি করে, তাদের কখনোই উচিত হবে না কোনো দলকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার মতো ‘চরম পথে’ যাওয়া। মধ্যপন্থার বৈশিষ্ট্যই হলো সবাইকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা।

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ