অধস্তন রাখার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারীদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি: বদিউল আলম মজুমদার
Published: 4th, October 2025 GMT
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো তোলা হয়েছে উল্লেখ করে কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সে আলোচনায় নারীর ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকার পরাজিত হয়েছে। সেখানে পুরুষেরা জয়ী হয়নি। কিংবা কেউ জয়ী হয়নি। জয়ী হয়েছে পুরুষতন্ত্র।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, নারীদের অধস্তন রাখার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারীদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণবিষয়ক এক প্রতিবেদন উপস্থাপন নিয়ে আজ শনিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন বদিউল আলম মজুমদার। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন ফোরামের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর সৈয়দা আহসানা জামান।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত পুরুষতন্ত্র আমাদের ওপর এমনভাবে জেঁকে বসেছে এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেদিকে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে নারীদের প্রতি আমরা বৈষম্য করেছি। তাদের বঞ্চিত করেছি। তাদের অধস্তন করে রেখেছি। তাদের নিগৃহীত করেছি। নিপীড়িত রেখেছি।’ এটি জাতির এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আরও পড়ুনআট মাসে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার১ ঘণ্টা আগেসরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নারীবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনকে বাদ দেয়নি উল্লেখ করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেসব সুপারিশে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে না, কিংবা রাজনৈতিক দলের দ্বিমত করার সুযোগ থাকবে না, এগুলো বাস্তবায়ন করার সুযোগ সরকারের আছে।
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সার্বিক সচেতনতার ওপর জোর দেন বদিউল আলম মজুমদার। নিজেও ব্যক্তিগতভাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সোচ্চার থাকবেন বলেও জানান তিনি।
অপরাজেয় বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানুর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েঞ্জিং অ্যান্ড ক্যাম্পেইনের পরিচালক নিশাত সুলতানা, আইনজীবী ফাহমিদা রিংকী প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক
এছাড়াও পড়ুন:
বিপ্লব সফল করতে না পারায় তরুণদের দায় রয়েছে
বাংলাদেশে বিপ্লব সফল করতে না পারায় তরুণদের দায় রয়েছে বলে মনে করেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। ‘কৃষকের মুক্তি ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব: ভাসানীর সাধনা’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে এ কথা বলেন ফরহাদ মজহার। সোমবার বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেটে ডেইলি স্টার সেন্টারের এ এস মাহমুদ সেমিনার হলে ‘ইতিহাস আড্ডা’ সিরিজের এ আলোচনার আয়োজন করে ডেইলি স্টার।
গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘৮ আগস্টে একটা কী হয়েছে? একটা রেজিম চেঞ্জ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এবং এখন যা কিছু ঘটছে, সবই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ঘটছে।’ এ ঘটনাকে বাঘ তাড়াতে গিয়ে কুমির আনার মতো ঘটনা উল্লেখ করে উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক চরিত্র বদলের দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
জুলাই সনদের প্রসঙ্গ তুলে ফরহাদ মজহার বলেন, ঐক্য ধ্বংস করার জন্য ঐকমত্য কমিশন হয়েছে। এ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন আদেশ রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে করার সমালোচনাও করেন তিনি। পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশনে জনগণের প্রতিনিধিত্ব না হয়ে লুটেরা, মাফিয়া শ্রেণিদের ঐক্য হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাই সনদের সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘পুরোনো সংবিধান রয়ে গেছে, সেই সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট (রাষ্ট্রপতি), তিনি আপনাদের ঐকমত্য কমিশনের দাবি স্বাক্ষর করেছেন। অতএব শেখ হাসিনা স্বাক্ষর করেছে।’
জনগণ সব ক্ষমতার অধিকারী এবং জালিম সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা ন্যায়সংগত—এসব শিক্ষা মাওলানা ভাসানীর জীবন থেকে শিখতে হবে বলে পরামর্শ দেন এই ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, সরকার, করপোরেশন অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে। পাশ্চাত্যকে গ্রহণ করতে গিয়ে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি ফেলে না দেওয়ার দুর্দান্ত উদাহরণ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আগামী দিনেও তিনি প্রাসঙ্গিক থাকবেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, মাওলানা ভাসানীকে ঘিরে দেশে দুই ধরনের ব্যাখ্যা প্রচলিত। একদল তাঁকে কেবল ‘লাল ভাসানী’ হিসেবে দেখেন, যিনি বাম ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির পথিকৃৎ। আরেকদল তাঁকে ‘সবুজ ভাসানী’ একজন পীর ও ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি আরও বলেন, ‘এই দ্বৈত বিভাজন আমাদের সমাজের বাইনারি রাজনীতিরই প্রতিফলন—ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা।’
আলোচনায় কৃষিব্যবস্থা সংস্কারের পাশাপাশি ভূমি সংস্কারের ওপর জোর দেন লেখক ও চিন্তক ফিরোজ আহমেদ। তিনি বলেন, মাওলানা ভাসানী তাঁর রাজনীতির মধ্যে সব সময়ই ভূমিসংস্কারের প্রশ্নটা রেখেছিলেন। পাশাপাশি কৃষকের মুক্তি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়ে মাওলানা ভাসানীর একটি কঠোর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীনতার পর ভূরাজনৈতিক নীতির সমকালীন তাৎপর্য, কৃষকের ওপর রাষ্ট্রের শোষণ নীতির বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানীর দর্শনগুলো তুলে ধরে বর্তমানে তাঁর প্রাসঙ্গিকতায় গুরুত্ব দেন ফিরোজ আহমেদ।
মাওলানা ভাসানীর জীবনীর ওপর আলোকপাত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, মাওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এ লক্ষ্যেই তিনি নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, তাঁদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।
মোশাহিদা সুলতানা বলেন, ‘মাওলানা ভাসানী তাঁর জীবনকালে যতটুকু প্রাসঙ্গিক ছিলেন, তার থেকে এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছেন। ১০০ বছর আগে মাওলানা ভাসানী যা বলেছেন, কৃষকের অবস্থা আসলে সেখান থেকে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। আমাদের কৃষিব্যবস্থা বদলেছে, কিন্তু কৃষকের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা বদলায়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের পরও এ অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া এবং কৃষি কমিশন গঠন না করারও সমালোচনা করেন তিনি।
অসাম্প্রদায়িক চিন্তা এবং তৎকালীন সরকারের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানীর অবস্থান তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘তিনি (মাওলানা ভাসানী) কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করেননি কোনো এলিট গ্রুপের স্বার্থে। তিনি আসলে তাঁদের (কৃষক) মনের শক্তি জুগিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, মাওলানা ভাসানী নিজে ধার্মিক ছিলেন; কিন্তু আবার একই দিক থেকে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়ার দিকটি তুলে ধরেন।
এ ছাড়া মাওলানা ভাসানীর জীবনকালের নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মানুষের ঐক্য বজায় রাখা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং কৃষকের অধিকার রক্ষায় ভারত সরকারের আগ্রাসী নীতির দিকগুলোও উঠে আসে মোশাহিদা সুলতানার বক্তব্যে।
ডেইলি স্টার–এর সাংবাদিক ইমরান মাহফুজের সঞ্চালনায় আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন ডেইলি স্টার–এর সাংবাদিক শামসুদ্দোজা সাজিন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান।