আব্দুল গফুরের হাত ধরে মৌলভীবাজারে মধু চাষের নিরব বিপ্লব
Published: 6th, October 2025 GMT
স্বল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মধু চাষে ঝুঁকেছেন ৩০ গ্রামের অন্তত ৬০০ চাষি। উপজেলার কাঠলকান্দি গ্রামের আজাদ মিয়ার কৌশল থেকে মধু চাষ উপজেলা ছাড়িয়েও এখন ছড়িয়ে পড়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকায়। ফলে জেলাটিতে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষের নিরব বিপ্লব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর আগে আজাদ মিয়া পাহাড় থেকে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি মৌ-রানি (রানি মৌমাছি) ধরে নিয়ে আসেন। এটিকে আটকে রেখে দেন কাঠের বাক্সে। রানীকে ঘিরে হাজারো মৌমাছি জমা হতে থাকে বাক্সে। এখান থেকেই মধু চাষের যাত্রা শুরু হয় আজাদ মিয়ার। এক রানি থেকে আরো রানির জন্ম হতে থাকে। এর সঙ্গে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে মধু চাষ।
মধু বহু রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। তাই এর অনেক চাহিদা। ক্রেতারা বাড়ি থেকেই খাঁটি মধু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বাজারজাতের আলাদা চিন্তা করতে হয় না চাষিদের। কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ছাড়াও জেলার মানুষজন জানতেন, খাঁটি মধু সংগ্রহ করার জন্য পাহাড়ি বনে ঘুরতে হয়। এখন তা হাতের কাছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার কাঠালকান্দি গ্রামের চাষি আব্দুল গফুর বলেন, “এক সময় পাহাড়ি এক বন্ধুর (ভারতের) কাছ থেকে জানতে পারি মৌমাছি কিভাবে বা কাকে কেন্দ্র করে এক জায়গায় জড়ো হয়। মূলত রানি মৌমাছি যেখানে থাকে, সেই স্থানেই মৌমাছির দল জড়ো হয়ে চাক বাধে। সেই চাকে ফুলের রেণু জমা করে মধু তৈরি করে।”
তিনি বলেন, “তার দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ি একদিন রানি মৌমাছি বনে সনাক্ত করে ছিদ্র যুক্ত একটি বাশেঁর চুঙ্গির ভিতর বন্দি করি। কোনো মতে ঢুকিয়ে দিতেই চারপাশ ভরে যায় কর্মী মৌমাছিতে। এভাবেই মধু চাষ শুরু হয়।”
প্রথমে সনাতনী পদ্ধতিতেই তিনি চাষ করতেন। পরে বিসিক থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান আব্দুল গফুর।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) আব্দুল গফুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বসত ঘরের চারপাশে বেশ কয়েকটি কাঠের বাক্স মাটি থেকে একটু উচুঁতে বিশেষভাবে রাখা। বৃষ্টিতে যাতে কাঠের বাক্স নষ্ট না হয় তাই উপরে টিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া। তিনি একটি বাক্স খুললে সেখানে দেখা যায়, চাকে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি।
বাক্সের নিচের দিকে ছোট ছিদ্র যুক্ত একটি নেট লাগানো। এই ছিদ্র দিয়ে মৌ-মাছি যাতায়াত করে। কিন্তু ছিদ্র এমন আকারের যাতে রানি মৌ-মাছি বের হতে না পারে। অন্যরা সহজে চলাচল করতে পারে। রানি অন্যদের চাইতে সাইজে একটু বড় তাই এই ছিদ্র দিয়ে বেড় হতে পারে না।
এক সময় আব্দুল গফুর মধু সংগ্রহের জন্য বনে যেতেন, এখন নিজ বাড়িতে বসেই মধু আহরণ করেন। এ থেকে তার ভালোই আয় হয়। তবে বৃষ্টি, খরায় এই মধু চাষে প্রভাব পড়ে। ফুল কম হলে ঘাটতি হয়। বনের গাছ যেমন বেলফই (জলপাই), লুদরাজ (মালা তৈরি হয়),পাহাড়ী লিচু, নাগেশ্বর এগুলো কমে যাওয়ায় মধু চাষে সমস্যা হয়। এখন এই বাক্স পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় বলে জানান আব্দুল গফুর।
কমলগঞ্জ উপজেলার প্রায় গ্রামেই এভাবে মধু চাষ করা হয়। একই উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের কোনাগাও গ্রামের বদরুজ্জামান (মঙ্গল) মধু চাষে বেশ এগিয়ে আছেন। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একটি টিন শেডের নিচে বিশেষ ভাবে রাখা ১১টি মৌমাছির বাক্স। বসত ভিটার বারান্দায় আরো দুটি।
বদরুজ্জামান মঙ্গল জানান, মূলত তিনি কৃষিজীবী। ১০ বছর আগে শখ করে একটি কাঠের বাক্স ১৫০ টাকা দিয়ে তৈরি করে শুরু করেন মধু চাষ। এখন তার বাড়িতে ১৩টি ও বাড়ির বাহিরে ৫০টি বাক্স আছে। এখান থেকে তার বছরে আয় প্রায় লাখ টাকা। এক সময় চাষের কিছুই না জানলেও এখন তিনি পাকা মৌ চাষি। তাকে সবাই মধু মঙ্গল নামে চিনে।
তিনি জানান, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাস ছাড়াও বছরে দুইবার মধু সংগ্রহ করা যায়। এক সময় খালি হাতে মধু আহরণ করতে গিয়ে মৌমাছির কামড়ে আহত হন। এখন অভিজ্ঞতা হয়েছে। গায়ে বিশেষ পোষাক (এপ্রোন) জড়িয়ে মধু আহরণ করেন এবং চাক পরীক্ষা করেন।
তিনি আরো জানান, মৌমাছিরা ঠান্ডা বা রাতে বের হয় কম। গরমের সময় বেশি ওড়াওড়ি করে। তখন পাখার শব্দ শুনা যায়। এক বাক্স থেকে বছরে ৫-১০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। তিনি নিজেই রানি মৌমাছি সংগ্রহ করেন। রানিসহ মৌমাছির একটি বাক্স ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এখন এক লিটার মধূ বিক্রি হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। এই মধু বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হয় না। ক্রেতারা বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যান।
মধু মঙ্গল বলেন, “কমলগঞ্জ উপজেলার আরো যেসব গ্রামে মধু চাষ হয় তার মধ্যে আছে জালালিয়া, বালিগাও, ইটখোলা, রাজটিলা, মাধবপুর, ধলাইর পাড়, সলিমবাজার, কাঠালকান্দি, কালারবিল, কানাইদেশী, গুলেরহাওর, আধকানি, মধ্যভাগ, নওয়াগাও, ভানুবিল, হখতিয়ারখলা, বনগাঁও, কাটাবিল, বাগমারা অন্যতম। এসব গ্রামের প্রায় ৫ শতাধিক লোক এই মধু চাষের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কেউ নিজেদের চাহিদা পুরণ করছেন, আবার কেউ সংসারের স্বাচ্ছন্দ ফিরিয়েছেন।”
কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষি উন্নয়ন পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আজাদ মিয়া বলেন, “পুরো জেলায় এখন প্রায় ৪ হাজার বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এই বাক্সগুলোর বড় একটি অংশ দেখাশুনা করতাম আমি নিজেই। বাক্স স্থাপন, মধু সংগ্রহ ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করেছি। এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় দুরে যেতে পারি না। তবে খোঁজখবর রাখি। প্রয়োজনে গিয়ে পরামর্শ দেই নতুন চাষিদের। বিনিময়ে সামান্য আয় হয়।” মধু চাষিদের সরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষি উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ বাবুল বলেন, “মৌ চাষে নতুন চাষি যুক্ত হচ্ছেন। এর জন্য বাড়তি সময় দিতে হয় না। অনেক পরিবার মধু চাষ করে পরিবারের বাড়তি চাহিদা পুরণ করছে। স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে পরিবারে। এখন প্রায় ৬০০ পরিবার এই চাষে যুক্ত আছেন। বড় চাষি কয়েকজন। মধু বাজারজাত করার জন্য আলাদা কোনো বাজার লাগে না। ক্রেতারা বাড়ি থেকেই নিয়ে যান। রানি মৌমাছির জন্য এখন বনে যেতে হয় না। বাক্সেই নতুন কলোনি তৈরি হয়। ২-১টি নতুন রানি জন্ম নেয়। রানি সনাক্ত করে সেখান থেকে আলাদা করতে হয়। কমলগঞ্জে মধু চাষের নিরব বিপ্লব ঘটেছে।”
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাখন চন্দ্র সুত্রধর বলেন, “মধু চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে। সহজভাবে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে।”
ঢাকা/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর কমলগঞ জ উপজ ল র আজ দ ম য় এক সময় পর ব র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান বাস্তবায়নে বাংলাদেশ নৌবাহিনী
ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম শুরু হয়েছে ৪ অক্টোবর থেকে। আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনব্যাপী সারা দেশে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৫’ পালিত হবে। এসময় ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে।
পাশাপাশি সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এলাকায় সকল প্রকার মৎস্য নৌযান কর্তৃক ইলিশসহ সকল প্রজাতির মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের ঘোষিত এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমুদ্র, নদী ও উপকূলীয় এলাকায় মোতায়েন রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
রবিবার (৫ অক্টোবর) চট্টগ্রামস্থ নৌবাহিনীর ঈসা খাঁ ঘাঁটির মিডিয়া বিভাগ থেকে জানানো হয় ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ এর আওতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজসমূহ সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৫’ পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১৭টি যুদ্ধ জাহাজ ৯টি জেলায় নিয়োজিত রয়েছে।
এ অভিযানের অংশ হিসেবে চাঁদপুর এলাকায় বানৌজা ধানসিঁড়ি/শহীদ ফরিদ ও বিএনডিবি গাংচিল; কক্সবাজার এলাকায় বানৌজা অতন্দ্র, শহীদ মহিবুল্লাহ, দুর্জয়, সাগর ও শহীদ দৌলত; খুলনা এলাকায় বানৌজা মেঘনা, চিত্রা/তিতাস; বাগেরহাট এলাকায় বানৌজা করতোয়া, আবু বকর/দুর্গম; পিরোজপুর ও বরগুনা এলাকায় বানৌজা সালাম ও কুশিয়ারা; বরিশাল এলাকায় বানৌজা পদ্মা, চিত্রা/ তিতাস এবং পটুয়াখালী এলাকায় এলসিভিপি-০১৩ বিশেষভাবে টহল প্রদান করছে।
গভীর সমুদ্রে দেশি-বিদেশি সকল প্রকার সৎস্য শিকারীদের অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ এবং অত্যাধুনিক মেরিটাইম পেট্রোল এয়ার ক্রাফট-এর মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারী করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী ফ্লিটের জাহাজ, ক্রাফট এবং বোটসমূহ ইলিশের প্রধান প্রজনন অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ, ও মৎস্য কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে অবৈধ ইলিশ আহরণ ও বিদেশি মাছ ধরার ট্রলারের অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করবে।
অভিযানকালে ইলিশ আহরণে নিয়োজিত অসাধু ব্যক্তি ও যান্ত্রিক মৎস্য নৌযানসমূহের ওপর কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
ইলিশ মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সুরক্ষিত রাখা, অবাধ প্রজননের সুযোগ সৃষ্টি এবং জাতীয় অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে মা ইলিশের সুষ্ঠু সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে নৌ সদস্যরা সর্বদা নিবেদিত।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের সমুদ্রসীমায় ও অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় মাছ ইলিশের প্রাচুর্য বৃদ্ধি ও মৎস্য সম্পদের সমৃদ্ধিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ঢাকা/রেজাউল/এস