Risingbd:
2025-08-01@17:19:28 GMT

আমাদের বইমেলা: হতাশা ও আশা

Published: 16th, January 2025 GMT

আমাদের বইমেলা: হতাশা ও আশা

আমাদের অমর একুশে বইমেলা কোনো সাধারণ মেলা নয়। ‘আমাদের’, কারণ এর সঙ্গে বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রাণের আবেগ জড়িত। আর তার অসাধারণত্বেরও বহুবিধ দিক আছে। প্রথমত, এর সঙ্গে অমর একুশের শহীদদের আত্মদানের মহান অবদান জড়িত; দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বাংলাদেশের স্বাধিকার চেতনা জড়িত; তৃতীয়ত, এটি মাসজুড়ে একটি চেতনার মেলা; চতুর্থত, এটি বই ও বাঙালি সংস্কৃতির সবচে বৃহৎ মেলা; পঞ্চমত, এখানে দেশের লেখক-পাঠক-প্রকাশকের সবচেয়ে বেশি ও সরাসরি আন্তঃসংযোগ ঘটে; ষষ্ঠত, এটি আমাদের প্রকাশনা শিল্পের সবচেয়ে বড় উৎসব। এই মেলাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি ( প্রতি বছর গড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার) বই প্রকাশিত হয়। 

এই ইতিহাসটি হয়তো অনেকেই জানেন, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমি চত্বরে চট বিছিয়ে বই সাজিয়ে এই মেলার সূচনা করেছিলেন মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা। কালক্রমে জনগণের আগ্রহ ও উদ্দীপনায় সেই ছোট্ট চারাটিই এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। কেবল তাই নয়, বাংলা একাডেমির বিরাট চত্বর ছাপিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একে সম্প্রসারিত করতে হয়েছে। আজকে ছোট-বড় প্রকাশনা ও ছোটকাগজ মিলিয়ে দেশজুড়ে প্রায় হাজারখানেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যার প্রধান অংশই এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। কিন্তু বেদনার ব্যাপার, অনেক জাতীয় সংকটের মতো বইমেলা, বাংলা একাডেমি ও প্রকাশনাও নানা সংকটে জর্জরিত। অনেক সংকট কৃত্রিম, কিছু-বা সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।


প্রকাশনার ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি ও বিপুল পাঠক-লেখক-জনতার চাপের কারণে বাংলা একাডেমি চত্বর বইমেলার স্থান হিসেবে পর্যাপ্ত না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা স্থানান্তরের কথা আমরা বহুকাল ধরে বলে ও লিখে আসছিলাম। এক পর্যায়ে বছর কয়েক আগে থেকে বইমেলা যদিও এখন সেখানেই হয়, কিন্তু গত দু’তিন বছর ধরে গণপূর্ত বিভাগ সেখানে মেলা করতে দিতে নারাজ। ফলে এটি একটি গুরুতর সংকট, যেটি লেখক-পাঠক-প্রকাশক সবার জন্যই একটি হুমকি-অবস্থা। কারণ বইমেলা যদি দূরে কোথাও স্থানান্তর হয়, যেমন পূর্বাচলে, তাহলে সেটি হবে সবার জন্যই মারাত্মক! এতে প্রত্যেক পক্ষেরই ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল। 

আরো পড়ুন:

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি বন্ধ হচ্ছে, পাঠকদের প্রতিবাদ

রাজশাহীতে ৮ দিনব্যাপী বইমেলা শুরু

একটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শিশু একাডেমি থেকে বাংলা একাডেমি হয়ে, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি অঞ্চল, চারুকলা ইনস্টিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি থেকে জাতীয় জাদুঘর পর্যন্ত ভৌগোলিক পরিসরটি রাজধানীর প্রধান সাংস্কৃতিক অঞ্চল। এ এলাকাটির গুরুত্ব কী তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে। ফলে বইমেলা দূরে স্থানান্তরের আগে সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। তবে প্রস্তাব আকারে দু’চার কথা বলা যেতে পারে : 

ক.

গণপূর্ত অধিদপ্তর যে ‘সাংস্কৃতিক বলয়’ তৈরির জন্য বইমেলা করতে দিতে চায় না, তাদের সেই ‘বলয়ে’ বইমেলাকে আত্তীকরণ করলে কী অসুবিধা? বই তো সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। 
খ. বাংলা একাডেমি চত্বরেই অন্তত তিন তলাবিশিষ্ট সুপরিসর কয়েকটি ভবন তৈরি, যেগুলোতে বিভিন্ন সাইজের স্থায়ী স্টল নির্মিত থাকবে। আর লিফটের পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণে চলমান সিঁড়ি বা এক্সেলেটরের ব্যবস্থা করা, যাতে লোকজন সহজে ওঠানামা করতে পারেন। 
গ. বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন বর্তমানে আগারগাঁওতে স্থানান্তরিত হয়েছে। সেই পুরনো জায়গাটি সরকার থেকে বাংলা একাডেমির নামে বরাদ্দ নেওয়া। এবং বাংলা একাডেমি চত্বর ও সাবেক আণবিক শক্তি কমিশনের স্থান মিলিয়ে সুপরিকল্পিত বইমেলা করা। সুযোগ থাকলে এটি ফলপ্রসূ হতে পারে আর স্থান সংকট নিয়ে ‘নাটকের’ অবসান ঘটতে পারে।


এ তো গেল বাহিরের কথা। এবার ভেতরের কথাও কিছু হোক। আমরা বলছি এটি চেতনার মেলা। তবে সেই ‘চেতনা’র অবস্থাটা আসলে কী? শুধু বই বা বইমেলা নয়, বরং স্বাধীনতার পর গত প্রায় সাড়ে পাচ দশকে দেখা গেছে আমাদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বহু চেতনাই বারবার লুণ্ঠিত-ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সংস্কৃতি অন্যতম। এমনকি আজও আমরা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট মান বা সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারিনি। ফলে প্রায় একভাষী জাতি হলেও আমাদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য প্রকট। দেশ ও জাতিপ্রেমও অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে প্রায় সব ধরনের শাসকগোষ্ঠীও নিজেদের স্বার্থে এই বিভেদ টিকিয়ে রাখতে চায়। ফলে আজও শিক্ষানীতিসহ ও বহু জাতীয় প্রশ্নে ভাগ করে শাসন করার নীতি বিরাজ করছে। এর পরিণাম সমাজ-রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রেই খুব দৃশ্যমান। এর মধ্যেও যে অল্প কটি প্রতীকী ঐক্যের দৃশ্যমান রূপ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একুশে বইমেলা। কিন্তু যে জাতীয় মান বা আকাঙ্খা প্রত্যাশিত, তা আজও অনুপস্থিত কেবল তাই নয়, বরং দিনকে দিন এর মান যেন পড়তির দিকে। বইমেলা ঘিরে হাজার হাজার বই প্রকাশ এর সংখ্যাগত বড়ত্বকে নির্দেশ করলেও মানগত শ্রেষ্ঠত্বের দিকটি সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানে ভাষাপ্রেম বা সংস্কৃতির সাধনার চেয়ে যেনতেন প্রকারে বই প্রকাশ ও স্থূল প্রচারের জোরে কিছু রোজগার বা আত্মপ্রেমের তুষ্টিলাভই যেন প্রধান। ভালো ও মানসম্মত বই প্রকাশ যে কেবল পেশাদারিত্বের প্রকাশ নয়, বরং জাতীয় দায়িত্ব-কর্তব্যেরও অঙ্গ, সে কথা যেন আমরা ভুলে বসে আছি। তাহলে প্রতি বছর এত কম মানসম্পন্ন ও সুসম্পাদিত বই প্রকাশ হতো না। 

এ দিকে নিওমিডিয়ার যুগে নানান প্রচার বালাই বেশ চলছে। ফলে যা-তা বইও ফেসবুক-ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে বাজার মাত করছে। অনেক ভালো ও মানসম্মত বই দৃশ্যের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আবার আমাদের গণমাধ্যমও কেবল ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষাপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখায়, আর সারা বছর অনেকটা শীতনিদ্রায় থাকে। ফলে বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক ও বই নিয়ে হরেদরে প্রচার করে থাকে, বাছবিচারের তেমন উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। যে কারণে সাধারণ পাঠকের পক্ষেও ভালো বইয়ের সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যদি এই বাস্তবতা চলমান থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ বড় কঠিন হয়ে পড়ে।  


একুশে বইমেলাকে ঘিরে লাখো লোকের পেশা নেশা উদ্দীপনা আর কোটি কোটি মানুষের আবেগ ও চেতনা  জড়িত। ফলে একটি সুস্থ সুন্দর সুপরিকল্পিত মেলা সবসময়ই আমাদের কাম্য। কিন্তু সেটি কতটা হচ্ছে এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অনেক মৃত্যু ও ত্যাগের জুলাই অভ্যুত্থান ও দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান দেশের জনগণকে আশাবাদী করে তুলেছিল যে, এবার হয়তো রাষ্ট্রে গণ-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু তার কোনো সুস্পষ্ট চেহারা এখনো দৃশ্যমান নয়। বরং নতুনতর অনেক সংকট উপস্থিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মব জাস্টিস, ভিন্নমত দলন, অর্থনৈতিক সংকট, সংখ্যালঘু দমন ও বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর নিজস্ব স্বার্থোদ্ধারের তৎপরতা। সব মিলিয়ে আবারও নতুন ধরনের ‘ভয়ের সংস্কৃতি’র শিকার হয়ে পড়েছে জনগণ। জাতীয় আকাঙ্খার বদলে কতিপয়তন্ত্র নানা রকম চাপ ও অন্যায্য দাবি করছে। এর প্রভাব পড়ছে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও। 

এমনিতেই প্রকাশকরা নানারকম সংকট মোকাবিলা করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছেন। এর ওপর বিভিন্ন দৃশ্য-অদৃশ্য বিধিনিষেধ ও হুমকির কারণে তারা হতাশ। কারণ এ মেলার পরিস্থিতি নিয়ে নানারকম আতঙ্কের কারণে তারা কোনো ভরসা করতে পারছেন না। ফলে এবার বইও অনেক কম প্রকাশিত হচ্ছে। লেখকরাও নানা ধরনের উদ্বেগে ভুগছেন। পাঠক নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছেন। 

এ অবস্থায় আশা করি রাষ্ট্র, প্রশাসন ও মেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো আমলে নেবেন এবং একটি সুস্থ মেলার পরিবেশ সুনিশ্চিত করবেন। কারণ এই একুশ শতকে এসেও আমরা নিশ্চয়ই মধ্যযুগে ফিরে যেতে চাইব না।  

লেখক: কবি ও সাংবাদিক 
 

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বইম ল বই ত হয় ছ এক ড ম

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীতে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাকে আশ্রয় দেওয়ায় তাঁতী দলের নেতা বহিষ্কার

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আলাউদ্দিনকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের এক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কৃত মোহাম্মদ সৈকত উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়ন তাঁতী দলের সভাপতি ছিলেন। আজ শুক্রবার বিকেলে জেলা তাঁতী দলের সদস্যসচিব মোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে জেলা তাঁতী দলের আহ্বায়ক ইকবাল করিম সোহেল ও সদস্যসচিব মোরশেদ আলমের যৌথ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়।

চিঠিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মোহাম্মদ সৈকতকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি মূল্যায়নে ব্যর্থ হওয়ায় হাতিয়া উপজেলা তাঁতী দলের দক্ষিণ কমিটিকে সতর্ক করা হয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার ভোরে হাতিয়া উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের জোড়খালী গ্রামে সৈকতের বাড়ি থেকে সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে হাতিয়া থানা–পুলিশ। এ সময় তাঁর কাছ থেকে ১০টি ককটেল উদ্ধার করা হয়। আলাউদ্দিন ও মোহাম্মদ সৈকত সম্পর্কে ফুফা–ভাগনে।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ সৈকত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো পরিবার থাকে। আমি ব্যবসার কাজে দিনের বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকি। আলাউদ্দিন কখন বাড়িতে এসেছেন, তা আমার জানা নেই। আমাদের ঘর থেকে তাঁর শ্বশুরদের ঘর অনেক দূরে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে জড়ানো হয়েছে।’

নোয়াখালী জেলা তাঁতী দলের সদস্যসচিব মোরশেদ আলম বলেন, আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকে আত্মগোপনে থাকার সুযোগ করে দেওয়ায় মোহাম্মদ সৈকতকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের তাঁতী দল কমিটিকেও সতর্ক করা হয়েছে।

আরও পড়ুনহাতিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে পালিয়ে থাকা সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গ্রেপ্তার৩১ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ