ঠিকাদারের হেলাফেলায় দেড় বছরের কাজে ৬ বছর পার
Published: 17th, January 2025 GMT
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (টিএসসি) ক্যাম্পাস নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। দেড় বছরে কাজটি শেষ হওয়ার কথা। তবে গত ছয় বছরেও কাজ শেষ করতে পারেননি ঠিকাদার। অথচ দেশে একই সময়ে শুরু হওয়া এমন ১০০ ক্যাম্পাসের মধ্যে ৯১টিরই নির্মাণ শেষ হয়েছে। অভিযোগ, মন্ত্রীর ভাগনে পরিচয়ে দাপট দেখানো ঠিকাদারের কারণে কাজটি এখনও শেষ হয়নি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, ক্যাম্পাসটির অবস্থান উপজেলা সদরে দোয়ারা-ভোগলাবাজার সড়কের (সাইটিং ঘাটে) পাশে দুই একর জমিতে। এখানে পাঁচ তলা একাডেমিক ভবন, চার তলা অফিস ভবন, চার কক্ষ বিশিষ্ট সার্ভিস স্টেশনসহ একাধিক স্থাপনা নির্মাণের কথা। প্রায় ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দের কাজটি যৌথভাবে পায় বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহের মেসার্স ভাওয়াল কন্সট্রাকশন-ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বরিশালের এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে ওই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চুক্তিতে কাজটি নেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মাহতাবুল হাসান সমুজ। ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট শুরু করা কাজটি ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের চার বছর পরও শেষ করতে পারেননি সমুজ।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জের সাবেক এক প্রকৌশলী বলেন, সমুজ নিজেকে পরিচয় দিতেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের ভাগনে হিসেবে। অফিসের পিয়ন থেকে কর্মকর্তা সবাই তাই জানতেন। এ জন্য কেউ কিছু বলতে পারতেন না। অফিসের কাউকে তিনি আমলেও নিতেন না। কাজ শেষ করার তাগাদা দিলে উল্টো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে দিয়ে ধমক দেওয়াতেন।
প্রায় ছয় বছরের মাথায় ওই ঠিকাদারের আসল পরিচয় জানতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, একদিন মন্ত্রী এম এ মান্নানকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘সে আমার কীভাবে ভাগনে হয়? আপনারা নিয়ম অনুযায়ী কাজ আদায় করবেন। অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেবেন।’ এর পর তাঁকে চাপ দেওয়া হয়।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশে ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাস নির্মাণ একসঙ্গে শুরু হয়। এর মধ্যে ৯১টি ক্যাম্পাসের কাজ শেষ। নতুন ক্যাম্পাসে চলছে ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। তবে কাজ শেষ না করেই দোয়ারাবাজার টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম গত বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়। প্রথম বছর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৫৬০ শিক্ষার্থী ভর্তির কথা থাকলেও শ্রেণিকক্ষ সংকটে ভর্তি করা হয় মাত্র ১৮৬ জনকে।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের উপজেলা অপেক্ষাকৃত অবহেলিত। এখানে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ হচ্ছে শুনে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দেড় বছরের কাজ ছয় বছরেও শেষ না হওয়ায় আমরা হতাশ। শুনেছি ঠিকাদার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় ইচ্ছে মতো কাজ করেছেন।
কলেজটির অধ্যক্ষ প্রকৌশলী এএসএম নাঈম বলেন, ক্যাম্পাস নির্মাণ শেষ না হলেও ২০২৩ সালে আমাকে অধ্যক্ষ নিয়োগের মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। শিক্ষার্থীও ভর্তি করা হয়েছে। তবে শ্রেণিকক্ষ না থাকায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি করা গেছে।
তিনি জানান, ঠিকাদার দাবি করেন– জমি নিয়ে ঝামেলা থাকায় কাজে দেরি হয়েছে। তবে তিনি খবর নিয়ে জেনেছেন, জমি অধিগ্রহণের টাকা পাওয়া নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ ছিল। এ নিয়ে মামলা হলেও কাজে কেউ বাধা দেয়নি।
ঠিকাদার মাহতাবুল হাসান সমুজ বলেন, নির্মাণকাজের শুরুতেই জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। ঠিকাদারকে মামলায় বিবাদীও করা হয়। সেই কাগজ আমার কাছে আছে। পরে মাটি ভরাট ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজও আমাকে দিয়ে করানো হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগও ছিল। সব মিলিয়ে কাজটিতে কয়েক কোটি টাকা লোকসানে পড়েছি আমি। তবে কোথাও আমি কোনোভাবেই দাপট দেখাইনি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাক
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান হবে আশা করা যায়। নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়ে দুই পক্ষই নীতিগতভাবে একমত হয়েছে যে ২০২৬ সালের রোজার আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
সাম্প্রতিক কালে নানা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি–দলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনের শপথ ইস্যু সেই বিরোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি ও আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে।
কিন্তু ঈদুল আজহার আগের রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে বিএনপির নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে।
এমনই একটি পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বৈঠকের ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়টি সামনে এলেও দুই পক্ষের আলোচনা কেবল এর মধ্যে সীমিত ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সংস্কারের ধারাবাহিকতার ওপরও জোর দেন তঁারা।
বৈঠকের ফলাফলকে প্রায় সব দলই স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণার ধরন নিয়ে আপত্তি জানালেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা কেউ করেনি। আমরাও মনে করি, কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ যারা সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও বিচারকাজ দৃশ্যমান করার ওপর জোর দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি ত্বরান্বিত করা জরুরি। আবার অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায়, সে জন্য জুলাই-আগস্টের হত্যার বিচারও অপরিহার্য। কিন্তু এই দুটি বিষয়কে কোনোভাবে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না।
যেসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধানের বিষয়টি জড়িত নয়, সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা যায়। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তেমন বাধা আসার কথা নয়। তবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার অর্থ এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা না থাকলে সরকার একা কাজটি করতে পারবে না।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় সংঘাতের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে না চললে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। আমরা আশা করি, দিন-তারিখের বিষয়ে সমঝোতার পর নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। রাজনীতিতে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে একে অপরকে ‘শত্রুজ্ঞান’ করার পুরোনো সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।