জলাভূমি রক্ষায় চাই সমন্বিত মহাপরিকল্পনা
Published: 1st, February 2025 GMT
আজ বিশ্ব জলাভূমি দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে দিবসটি। মূলত ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসার শহরে ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত হয় জলাভূমি সম্মেলন। তখন থেকেই সারাবিশ্বে জলাভূমি সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়াস হিসেবে পালিত হয় এ দিবসটি। জীববৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক সমাহারের জন্য বাংলাদেশের সুন্দরবন, হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওরকে রামসার অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদী ও খালে নানা প্রজাতির মাছ, বিশেষ প্রজাতির ডলফিন, উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমৃদ্ধ প্রাণবৈচিত্র্য পৃথিবীর মধ্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।
জালের মতো বিছিয়ে থাকা নদনদীর আশীর্বাদে প্রাকৃতিক জলাভূমির বৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের এই দেশ। বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জলাভূমির অবদান। জলাভূমিগুলো ভৌগোলিক স্থানভেদে এবং গঠন প্রকৃতির কারণে হাওর, বাঁওড়, খালবিলসহ নানা নামে পরিচিত আমাদের কাছে। শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ানোই নয়, বরং জলজ জীবন ও প্রাকৃতিক সম্পদের আধার হিসেবে জলাভূমি আগলে রেখেছে বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। আমাদের দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ শতাংশ জলাভূমি। বড় বড় হাওর, বিলের নাম আমাদের অনেকেরই জানা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে সাড়ে তিনশরও বেশি হাওর রয়েছে। হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার, খালিয়াজুরী, নিকলি, ইটনার হাওর, পচাশোল, সোমাইসহ বিভিন্ন নামে হাওর রয়েছে এ এলাকায়। এ ছাড়াও চলনবিল, ডাকাতিয়া বিল, আড়িয়ল বিল, গাজনার বিল, বাইক্কা বিল সারাদেশেই পরিচিত।
যুগ যুগ ধরে এসব জলাভূমি আমাদের দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য। দেশের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের সিংহভাগই আহরণ করা হয় এসব জলাশয় থেকে। এ ছাড়াও জলজ উদ্ভিদ, শাকসবজি থেকে শুরু করে আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা এসব জলাভূমিতেই জন্মে। বাংলাদেশের জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯)-তে হাওর, বাঁওড় ও বিলকে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শীতকালে এ জলাভূমিগুলোই হয়ে ওঠে পরিযায়ী পাখির জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি
জলাশয়গুলো বাস্তুতন্ত্রের নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই নয়; বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রেও জলাভূমি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের খাদ্যশস্যের জোগান দিতে ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় নদনদী, খালবিলের পানি। আবার শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়া জলাভূমির পলির ওপর জন্ম নেয় সোনালি ধান। বাংলাদেশে উৎপাদিত ধানের একটা বৃহৎ অংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে।
আমরা নিজেরাই আজ সেসব জলাভূমি ধ্বংসে মত্ত। অনেক বছর আগে ডাকাতিয়া বিল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কীভাবে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের প্রভাব খাটিয়ে এই বিলের বিভিন্ন অংশ দখল করে নিয়েছেন। দেশের সব জায়গার চিত্র মোটামুটি একই। নানা জায়গায় মার্কেট, বাড়িসহ যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের জন্য ভরাট করা হচ্ছে জলাভূমি। অপরিকল্পিত দ্রুত নগরায়ণের করাল গ্রাসের প্রথম বলি হয় আমাদের আশপাশের জলাভূমি। এক দশক আগেও বিভিন্ন নগরীর পাশে যেসব জলাভূমি দেখা যেত, আজ তা ভরাট করে বানানো হয়েছে বহুতল অট্টালিকা অথবা বাণিজ্যিক স্থাপনা। গত দুই দশকে ঢাকা এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় জলাভূমি কমেছে ২৩ শতাংশ, যা ঢাকার জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন সমস্যার অন্যতম কারণ। গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে জলাভূমি দখলের মাত্রা
অনেক বেশি।
কয়েক মাস আগেই আমাদের দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীতে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যার পানিতে দিনের পর দিন মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের খবর ও ছবি বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষকে ব্যথিত করেছে। অথচ লোকালয়ের পানি অনেক দ্রুত নেমে যেত যদি সেই এলাকার জলাভূমিগুলো দখল করে ভরাট না করা হতো। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যা দীর্ঘতর হওয়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে সে অঞ্চলের জলাভূমি ভরাট করে ফেলা। মূলত অনেক জলাভূমির সঙ্গে নদীর সরাসরি সংযোগ থাকে। নদীই জলাশয়ের পানি বয়ে নিয়ে যায় সাগরে। এ কারণে ভরাট হওয়া জলাভূমিগুলো পানি নিষ্কাশনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই। ব্যাঙের ছাতার মতো শিল্পকারখানার বিস্তার জলাভূমি বিনষ্টের অন্যতম কারণ। শিল্পকারখানার অপরিশোধিত তরল কিংবা কঠিন বর্জ্য অনেক জায়গাতেই সরাসরি ফেলা হচ্ছে জলাভূমিতে। সেই বর্জ্যের বিষাক্ত ছোবলে সময়ের আবর্তে হারিয়ে গেছে অনেক দেশীয় মাছ, উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী। এ ছাড়া নগরজীবনের জৈব ও অজৈব ক্ষতিকর পদার্থের পাশাপাশি বেশির ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যের শেষ ঠিকানা হয় আমাদের জলাভূমিতে। দখল-দূষণের ভয়াবহতায় অনেক জলাভূমি আজ মৃতপ্রায়।
সারা পৃথিবীর জলাভূমি রক্ষার জন্যই রামসার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছরই গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবারের বিশ্ব জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য– Protecting wetlands for our common future.
অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে জলাভূমি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মানুষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জলাভূমি বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলাভূমির সীমানা নির্ধারণ, দখল-দূষণ প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে বাংলাদেশের জলাভূমির সুরক্ষা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
ড. মো. রাশেদুজ্জামান পবিত্র: সভাপতি, ইএসডি বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি;
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
সাকিবের পথে হাঁটছেন মিরাজ
সাকিব আল হাসানের সঙ্গে নিজের তুলনাকে মেহেদী হাসান মিরাজ হয়তো উপভোগই করেন। কারণ, তাঁর স্বপ্ন সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা। সেই পথে বোধ হয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টেস্টে দেশে-বিদেশে সম্প্রতি ভালো করছেন। পাকিস্তানে দারুণ প্রশংসিত ছিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজে উভয় টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। সিলেটের হারের ম্যাচেও ১০ উইকেট ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নিয়ে সাকিব ও সোহাগ গাজীর কাতারে নাম লেখালেন। মূলত মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ব্যবধানে টেস্ট জেতা সম্ভব হয়।
গতকাল শতকের ঘরে যেতে কম কসরত করতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে তো অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাসানের আউটের শঙ্কায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় শতকের দেখা পান তিনি। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল মিরাজের। গতকালের পারফরম্যান্স নিয়ে টাইগার এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় চেষ্টা করেছিলাম ২ রান নিয়ে ১০০ রানে যেতে। সেভাবে দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ডারের হাতে বল চলে গিয়েছিল (হাসি)। তার পর তো আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসান অনেক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তানজিমও ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তাইজুল ভাইও। এই তিনজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কারণ, ওদের জন্যই আমি ১০০ রান করতে পেরেছি।’
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দাবি মিরাজের, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১০০ করেছিলাম, ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। অল্পের জন্য ৫ উইকেট হয়নি। হলে ভালো লাগত। ওই ম্যাচ হেরেছিলাম এই মাঠে। সে জিনিসটা মাথায় ছিল। ভালো লাগছে ম্যাচটি জিতেছি।’ মিরাজ ১৬২ বলে ১১টি চার ও একটি ছয় মেরে ১০৪ রান করেন। ২১ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন পাঁচ উইকেট।
টেস্টে এ রকম অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাংলাদেশে আর দু’জনের আছে। সাকিব আল হাসান দু’বার ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে আর ২০১৪ সালে খুলনায়। সোহাগ গাজী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার করেন চট্টগ্রামে। সেই মাইলফলক ছোঁয়া মিরাজকে সম্প্রতি অলরাউন্ডার ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়। সাকিবের বিকল্প ভাবা হয় তাঁকে এখন।
এ ব্যাপারে মিরাজের অভিমত, ‘দেখেন একটা জিনিস, যখন সাকিব ভাই ছিলেন, ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল। যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।’
সিলেটে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট করে নিয়েও দলকে জেতাতে পারেননি মিরাজ। চট্টগ্রামে সাদমান, তাইজুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ম্যাচ জয়ের নায়ক হন। এই সাফল্য নিয়ে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম ম্যাচ হারার পর যেভাবে কামব্যাক করেছি, এটা খুবই দরকার ছিল। আমাদের সবাই ভেবেছিল, আমরা ভালো করব।’ মিরাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোচিং স্টাফ ও সতীর্থের কাছে। আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা পুরো দলের।