ক্যান্সার এখন আমাদের জীবনে দূরের কোনো বিষয় নয়। আমাদের চারপাশে হরহামেশাই কারও না কারও নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার কথা শোনা যায়। আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ রোগের ঝুঁকিতে বসবাস করছি। শুধু আমাদের দেশেই নয়। বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগগুলো ব্যাপক হারে বাড়ছে। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এটি কেবল শারীরিক অসুস্থতা নয়। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝি, এটি কতটা ক্ষত তৈরি করে মনের ভেতর। এ ভয়ভীতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটিয়ে ওঠা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন অপরের সহযোগিতা, সহমর্মিতার পরশ। লিখেছেন জাহান ই গুলশান
ক্যান্সার এমন এক রোগ; যা একই সঙ্গে মানুষের শারীরিক, আর্থিক, মানসিক, সামাজিক, পেশাগত দুর্ভোগ নিয়ে আসে। সারাক্ষণ এক অদৃশ্য ভয় তাড়া করে আক্রান্ত এবং তাঁর পরিবারকে। সেই ভয় ক্যান্সার ফিরে আসার বা শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে ভালো থাকা বিষয়ে সংকোচ, দ্বিধা নিয়ে; আর্থিক জোগান নিয়ে; যথাযথ কাজ পাওয়া নিয়ে। এমনকি অনেকের ক্ষেত্রে সুস্থ পারিবারিক জীবন চালিয়ে যাওয়া নিয়ে টেনশন থেকে। এসব ভয় বা দুশ্চিন্তা কোনোটাই অমূলক নয়। ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে আমার এক সহযোদ্ধা নারীকে তাঁর জীবনসঙ্গী ছেড়ে গেছেন। কারণ তিনি রোগীর সঙ্গে থাকতে চান না। আর্থিক ব্যয় মেটাতে চান না।
ক্যান্সারে নিজের ছোট্ট শিশুকে হারানোয় মাকে দোষারোপ করা হয়। তাঁর কারণে সন্তান মারা গেছে। সেই মাকে বিয়ে নামক সম্পর্ক থেকে বের করে দেওয়া হয়। আবার ক্যান্সার জেনেই নেলী বিয়ে করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শরিফকে। যাতে শরিফের যত্ন করতে পারেন। একমাত্র সন্তান তানিশাকে হারিয়ে বাবা আনিসুল হক তানিশার মাকে আগলে রেখেছেন সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত বা তাদের কেয়ারগিভারদের কথা শোনার জন্য সমাজ ততটা আগ্রহী নয়। ক্যান্সার যে রোগের অধিক কিছু, সেখানে একা একজনের বা একটি পরিবারের পক্ষে চিকিৎসাসহ সবকিছু চালিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন; তা যেন আমরা এখনও বুঝতে পারছি না। অথচ উন্নত বিশ্বে ক্যান্সার সারভাইবার বা তাদের পরিবার, স্বজন, কেয়ারগিভারদের জন্য বিভিন্ন সাপোর্ট গ্রুপ রয়েছে। এমনকি চিকিৎসকরা আক্রান্তদের এসব সাপোর্ট গ্রুপের কাছে পাঠান। দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আমিও এ রকম সাপোর্ট গ্রুপ দেখেছি, যারা হাসপাতালে নির্দিষ্ট একটি স্থানে বসেন; রোগীদের কথা শোনেন, পরামর্শ দেন। আমাদের দেশেও কিছু সংগঠন স্বেচ্ছায় সাপোর্ট দিতে এগিয়ে এসেছে, এটি আশার কথা। সমাজের সবাইকে এসব সংগঠনে যুক্ত হওয়া, ভূমিকা রাখা দরকার। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক ক্যান্সার আক্রান্তের সমস্যাই অপরের থেকে পৃথক। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পূর্বশর্তই এ পৃথককে সমবেত করা। জনবান্ধব চিকিৎসাসেবা কেবল ক্যান্সারের জন্য নয়, সব রোগের চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য। একজনের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা অন্যদের জন্য সাহস, মনোবল বাড়িয়ে দিতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসায় যা অত্যন্ত জরুরি। এ রকম উপলব্ধি থেকে আমরা বেশ কয়েকজন ক্যান্সার সারভাইবার মিলে স্বেচ্ছসেবামূলক ‘সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন’ গড়ে তুলেছি। ‘এখানে থেমো না– ক্যান্সার লড়াকুদের বয়ান’ নামে সংকলন প্রকাশ করেছি। চেয়েছি, আমাদের ভুল ও সঠিকতা থেকে যেন অন্যরা শিক্ষা নিতে পারেন।
আমাদের দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে এ রকম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে তা সমাজে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া কেয়ারগিভারদের প্রতিটি লেখায় দুশ্চিন্তা– কোথায় যাবে, কার কাছে চিকিৎসা বা রোগ সম্পর্কে ঠিকঠাক তথ্য পাবে– এ রকম হাজারো উদ্বেগ, চাপের কথা উঠে এসেছে; যা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এ জন্য প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার কাউন্সেলিং ইউনিট চালু অত্যন্ত জরুরি।
‘এখানে থেমো না’ সংকলনে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন তাঁর জীবনসঙ্গী ড.
এই আক্ষেপ আমরা আর করতে চাই না। আমরা চাই দরিদ্র কিংবা প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী যে কেউ যেন দেশেই ক্যান্সারের উন্নততর চিকিৎসা সুলভে নিতে পারেন। বর্তমানে বেশির ভাগ পরিবারকেই ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। সারভাইবার ও কেয়ারগিভারদের লেখায় উঠে এসেছে, ক্যান্সার চিকিৎসার অর্থসংস্থান কোথা থেকে হবে তা সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় তাদের। সে জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে জাতীয় ক্যান্সার তহবিল গঠনের জোর দাবি জানাচ্ছি। যে তহবিল থেকে আক্রান্তরা ন্যূনতম ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা সহযোগিতা পেতে পারেন। সেই সঙ্গে ক্যান্সার সচেতনতা বাড়াতে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব মিডিয়াকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ক্যান্সার সচেতনতা বাড়াতে কাজে লাগাতে হবে। ক্যান্সার প্রতিরোধে বা আর্লি ডিটেকশনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের এ প্রশিক্ষণ দেবে। একইভাবে দেশের ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে টিকা নিতে ব্যাপক উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণা চালাতে হবে।
জীবনের পথে, প্রাণ-প্রকৃতির পথে আমাদের আরও বেশি করে সক্রিয় হতে হবে; যেমনটা ‘এখানে থেমো না’ সংকলনে শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন– ‘মৃত্যু তো অনিবার্য, কিন্তু অকাল বা দীর্ঘ অসুস্থতায় কষ্টকর মৃত্যু কোনোভাবেই অনিবার্য নয়, গ্রহণযোগ্য নয়। অনিবার্য নয় ব্যয়বহুল চিকিৎসা, চিকিৎসা করতে গিয়ে সপরিবারে বিপর্যস্ত হওয়া। বিশ্বে যত সম্পদ যুদ্ধে, প্রাণ বিনাশে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণে ব্যয় হয়, তার একাংশ যদি মানুষ রক্ষায় চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণায় ব্যয় হতো তাহলে এই গ্রহের মানুষের জীবন কম কঠিন হতো। যদি উন্নয়ন নামে মুনাফাসন্ধানী নদী-বন-সমুদ্রবিনাশী তৎপরতায় বাতাস, নদী, ফল-ফসল, পানি বিষাক্ত না হতো তাহলে মানুষ অকালে অবিশ্বাস্য মরণঘাতী অসুখবিসুখে কম আক্রান্ত হতো। যদি চিকিৎসা মুনাফা-ব্যবসার বিষয় না হয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে দাঁড়াত, তাহলে অনেককেই চিকিৎসা ব্যয়ের আতঙ্কে আরও অসুস্থ হতে হতো না। তার মানে ক্যান্সারসহ নানা রোগে অকালমৃত্যু এবং দুর্ভোগ মোকাবিলার পথ আছে। আমরা যারা এখনও জীবিত আছি, তাদেরই দায়িত্ব এই পথকে বাস্তব করে তোলার জন্য সরব ও সক্রিয় থাকা।’
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জ বন র জন য পর ব র জন য স ত হওয় এ রকম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সাকিবের পথে হাঁটছেন মিরাজ
সাকিব আল হাসানের সঙ্গে নিজের তুলনাকে মেহেদী হাসান মিরাজ হয়তো উপভোগই করেন। কারণ, তাঁর স্বপ্ন সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা। সেই পথে বোধ হয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টেস্টে দেশে-বিদেশে সম্প্রতি ভালো করছেন। পাকিস্তানে দারুণ প্রশংসিত ছিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজে উভয় টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। সিলেটের হারের ম্যাচেও ১০ উইকেট ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নিয়ে সাকিব ও সোহাগ গাজীর কাতারে নাম লেখালেন। মূলত মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ব্যবধানে টেস্ট জেতা সম্ভব হয়।
গতকাল শতকের ঘরে যেতে কম কসরত করতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে তো অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাসানের আউটের শঙ্কায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় শতকের দেখা পান তিনি। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল মিরাজের। গতকালের পারফরম্যান্স নিয়ে টাইগার এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় চেষ্টা করেছিলাম ২ রান নিয়ে ১০০ রানে যেতে। সেভাবে দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ডারের হাতে বল চলে গিয়েছিল (হাসি)। তার পর তো আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসান অনেক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তানজিমও ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তাইজুল ভাইও। এই তিনজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কারণ, ওদের জন্যই আমি ১০০ রান করতে পেরেছি।’
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দাবি মিরাজের, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১০০ করেছিলাম, ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। অল্পের জন্য ৫ উইকেট হয়নি। হলে ভালো লাগত। ওই ম্যাচ হেরেছিলাম এই মাঠে। সে জিনিসটা মাথায় ছিল। ভালো লাগছে ম্যাচটি জিতেছি।’ মিরাজ ১৬২ বলে ১১টি চার ও একটি ছয় মেরে ১০৪ রান করেন। ২১ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন পাঁচ উইকেট।
টেস্টে এ রকম অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাংলাদেশে আর দু’জনের আছে। সাকিব আল হাসান দু’বার ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে আর ২০১৪ সালে খুলনায়। সোহাগ গাজী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার করেন চট্টগ্রামে। সেই মাইলফলক ছোঁয়া মিরাজকে সম্প্রতি অলরাউন্ডার ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়। সাকিবের বিকল্প ভাবা হয় তাঁকে এখন।
এ ব্যাপারে মিরাজের অভিমত, ‘দেখেন একটা জিনিস, যখন সাকিব ভাই ছিলেন, ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল। যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।’
সিলেটে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট করে নিয়েও দলকে জেতাতে পারেননি মিরাজ। চট্টগ্রামে সাদমান, তাইজুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ম্যাচ জয়ের নায়ক হন। এই সাফল্য নিয়ে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম ম্যাচ হারার পর যেভাবে কামব্যাক করেছি, এটা খুবই দরকার ছিল। আমাদের সবাই ভেবেছিল, আমরা ভালো করব।’ মিরাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোচিং স্টাফ ও সতীর্থের কাছে। আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা পুরো দলের।