দীর্ঘকাল ধরে কৃষকসমাজ অবহেলিত। তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্র তাদের যথাযথ মূল্য ও স্বীকৃতি দেয় না। অনেক কৃষক এখনও আধুনিক প্রযুক্তি, ভালো বীমা এবং সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত।
সরকার কিছু উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিলেও মূল সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে। কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকরী সহায়তা, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং সঠিক মনোযোগ তাদের নাজুক অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। তাদের স্বার্থরক্ষা এবং তাদের উন্নয়ন অবশ্যই দেশের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। তারা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, কিন্তু তাদের পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ এখনও নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে কৃষকদের যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো ঋণের বোঝা, মূল্যহীন ফসলের দাম, অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির অভাব, প্রশিক্ষণের স্বল্পতা এবং দুর্বল বীমা ব্যবস্থা ইত্যাদি। সরকার ভর্তুকি মূল্যে সার, কীটনাশক ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ, কৃষি তথ্যসেবা এবং সেচ ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়ে তাদের জন্য কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করছে। এই উদ্যোগগুলো আরও উন্নত এবং ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে কৃষকরা প্রকৃত সুবিধা পান।
একই সঙ্গে কৃষকদের সংগঠিত করা, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি। প্রয়োজন কৃষকদের জন্য আরও সমন্বিত পরিকল্পনা এবং তাদের জীবিকার উন্নয়নের জন্য প্রকৃত নীতি গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাতের প্রতিটি স্তরে প্রয়োগযোগ্য সঠিক নীতি এবং সমর্থন কৃষককে তাদের অবহেলা থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করবে।
দেশের মানুষকে কৃষকদের প্রতি আরও সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কারণ তারাই আমাদের খাবার সরবরাহের প্রধান অবলম্বন। কৃষকদের প্রতি অবহেলা এবং তাদের সমস্যা দীর্ঘদিনের। শুধু সরকারি নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের সবারই এই সমস্যার প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। কৃষকদের সঠিক মূল্য ও সম্মান দেওয়া, তাদের জীবিকা নিশ্চিত করা এবং তাদের খাদ্য নিরাপত্তা ঠিক রাখতে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার।
প্রথমত, কৃষির আধুনিকীকরণ এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। অনেক কৃষক এখনও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন, যা তাদের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। আধুনিক প্রযুক্তির প্রবর্তন, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার কৃষকদের জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে। এগুলোর উপযোগিতা এবং ব্যবহার সবার কাছে নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, কৃষকদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। ঋণের চাপ ও বঞ্চনা, অস্বচ্ছ কৃষিবাজার, প্রকৃত দামে ফসল বিক্রি করতে না পারা– এই সমস্যাগুলোর সমাধান ছাড়া তাদের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব নয়। সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি, বেসরকারি খাতেরও এই বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত। এ ছাড়া কৃষকদের জন্য স্থায়ী সুদহীন ঋণ, অর্থনৈতিক সুরক্ষা এবং সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা জরুরি।
তৃতীয়ত, একটি কার্যকর এবং স্বচ্ছ কৃষিবাজার ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। এখনও অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পাযন না, যেহেতু মধ্যস্বত্বভোগীরা অধিকাংশ লাভ নিয়ে যায়। ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে আধুনিক বাজার ব্যবস্থা, সরাসরি কৃষক-বাজার লিঙ্ক এবং সরবরাহ চেইন উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ ছাড়া, কৃষকদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা এবং কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক পরিবারের সদস্যদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা তাদের উন্নয়নে সহায়ক হবে।
তবে, সব সমস্যার মূলে রয়েছে কৃষি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন এবং কৃষকদের উন্নতির জন্য সঠিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একমাত্র তখনই তারা তাদের মেধা ও পরিশ্রমের সঠিক মূল্য পাবেন এবং তারা দেশের উন্নয়নে সঠিকভাবে অবদান রাখতে পারবেন।
আক্তার মনি
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
aktermonia031@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর দ র জন য ব যবস থ অবহ ল সমস য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
এখনও পাহাড়ের নিচে বাস ২০ সহস্রাধিক মানুষের
২০১৭ সালের ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধসের দৃশ্য এখনও চোখে ভেসে উঠলে শিউরে উঠি। এখনও আমার ঘরের আশপাশে সেই পাহাড় ধসের চিহ্ন রয়ে গেছে। তাই অল্প বৃষ্টি হলেই আতঙ্কে থাকি, আশ্রয়কেন্দ্র খুঁজি। কিন্তু আমরা অসহায় ও গরিব, যেখানে পেটের ভাত জোগাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে নিরাপদ ভাড়া বাসায় থাকার সামর্থ্য কোথায়? তাই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই পাহাড়ের নিচে বসবাস করছি।
কথাগুলো বলছিলেন রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর লোকনাথ মন্দিরের পাশে সিএনবির পাশে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা পঞ্চাশোর্ধ্ব নূরজাহান। শুধু নূরজাহান নন, রূপনগর, মুসলিমপাড়া, শিমুলতলী, লোকনাথ মন্দির এলাকা, রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন নিচু এলাকা, কিনারাম পাড়াসহ শহরের অন্তত ২৯টি স্থানে ২০ হাজারের বেশি নিম্ন আয়ের মানুষ মারাত্মক ঝুঁকি জেনেও বসবাস করছে পাহাড়ের পাদদেশে। একটু ভারী বৃষ্টি এলেই সবার স্মৃতিতে ফিরে আসে, ২০১৭ সালের এ দিনে শহরে পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু পুনর্বাসন না হওয়ায় পাহাড়ের নিচে বসবাস বন্ধ হয় না। উল্টো দিন দিন বাড়ে।
এমন অবস্থায় আজ শুক্রবার ২০১৭ সালেই সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনার আট বছর পূর্ণ হলো। ২০১৭ সালের ১৩ জুন ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকা, মুসলিমপাড়া, শিমুলতলী, রূপনগর, সাপছড়ি, মগবান, বালুখালী, জুরাছড়ি, কাপ্তাই, কাউখালী ও বিলাইছড়ি এলাকায় ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের মৃত্যু হয়। মানিকছড়িতে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের ওপর থেকে মাটি সরাতে গিয়ে ৫ সেনা সদস্য পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়েন। ওই সময় পাহাড় ধসে জেলায় ১৬০০ থেকে ১৭০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারাদেশের সঙ্গে রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল এক সপ্তাহ। দীর্ঘ তিন মাসের বেশি সময় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার পর ক্ষতিগ্রস্তরা নিজেদের জায়গায় ফিরে যায়। এ ছাড়া ২০১৮ সালে নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড় ধসে দুই শিশুসহ ১১ জন এবং ২০১৯ সালের কাপ্তাইয়ে ৩ জনের প্রাণহানি ঘটে।
২০১৭ সালের সেই পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল ও বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পরও ঝুঁকিতে থাকা লোকজনদের পুনর্বাসন করতে পারেনি প্রশাসন। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করেই দায় সারে তারা। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে স্থাপনা নির্মাণ না করতে মাঝেমধ্যে নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়। কিন্তু এই সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান আজও হয়নি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, রাঙামাটি পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে শিমুলতলী, রূপনগর, লোকমন্দির পাড়া, পোস্ট অফিস কলোনি এলাকা, নতুনপাড়া, বিদ্যানগর, কিনারামপাড়া, সিলেটি পাড়াসহ অন্তত ২৯টি স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া নানিয়ারচর, কাউখালীসহ কয়েকটি উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। এসব এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে এখনও ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রূপনগর, লোকনাথ মন্দির, মুসলিমপাড়া এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ওই পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। কথা হয় রূপনগর এলাকার বাসিন্দা সমলা আক্তার, কমলা বেগম, আব্দুল মান্নান ও শাহানা বেগমের সঙ্গে। তারা জানান, ভারী বৃষ্টি হলেই ভয় লাগে। কিন্তু তাদের যাওয়ার কোথাও জায়গা নেই। বেশি বৃষ্টি হলে জেলা প্রশাসন থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু সম্পদ হারানোর ভয়ে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না।
তারা আরও জানান, সবাই চায় ভালো ও নিরাপদ স্থানে বসবাস করতে। তাই সরকার যদি তাদের পুনর্বাসন করে তাদের জন্য ভালো হয়।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের পুনর্বাসন চলমান প্রক্রিয়া। তবে এ ক্ষেত্রে জটিলতা হচ্ছে, যেখান থেকে মানুষজনদের সরিয়ে নেওয়া হয়, সেখানে আবারও নতুন লোকজন বসবাস শুরু করে। এসব এলাকায় লোকজন কম টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে। তা ছাড়া পাহাড়ে ভূমি জটিলতা থাকার কারণে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বা পাহাড়ের ঢালুতে মানুষ বসবাস করছে। যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নেওয়া হচ্ছে আইনি ব্যবস্থাও। তবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস বন্ধ করতে সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি।