একুশে গ্রন্থমেলায় সব্যসাচী স্টলে আক্রমণের নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়ে ২০৫ নাগরিকের বিবৃতি
Published: 11th, February 2025 GMT
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ‘সব্যসাচী’ স্টলে আক্রমণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশ-বিদেশে বসবাসকারী ২০৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক।
‘নেটওয়ার্ক ফর ডেমোক্রেটিক বাংলাদেশ’ নামের আন্তর্জাতিক অ্যাকটিভিস্ট সংগঠনের ব্যানারে গতকাল সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। নেটওয়ার্কের পক্ষে বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আজফার হোসেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সব্যসাচী স্টলে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের ন্যক্কারজনক আক্রমণ, প্রকাশনীর প্রকাশক-লেখক শতাব্দী ভবকে শারীরিক-মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় এই নাগরিকেরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন। সব্যসাচী স্টলের বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিনসহ ‘নাস্তিক্যবাদী ও শাতিমদের বই’ প্রকাশের অভিযোগ তুলে আগের দিন রোববার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি দেওয়া হয়। এরপরও স্টলটিতে কোনো রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে না পারার ব্যর্থতার দায় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে। অথচ, ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পরে এই বইমেলা নিয়ে এই নাগরিকদের আশা ছিল, সব চিন্তা ও মতের প্রকাশ মুক্ত, অবারিত হবে। সব লেখক-প্রকাশক নির্ভয়ে নিজেদের বই প্রকাশ, পরিবেশন ও বিক্রয় করতে পারবেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরে এমন আঘাতের ঘটনায় তাঁরা (নাগরিকেরা) অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলেও তাঁরা একইভাবে একুশে বইমেলার ওপরে বারংবার আক্রমণ ঘটতে দেখেছেন।
বিবৃতিদাতারা বলেন, অতীতে শাসকগোষ্ঠীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর হুমকিতে রোদেলা, শ্রাবণের মতো প্রকাশনী মেলায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বই নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই ধারাবাহিকতাতেই স্বাধীন মত ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের ওপর এই আক্রমণ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জায়গায় আজ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কখনো তারা নারীদের ফুটবল খেলায় বাধা দিচ্ছে, আক্রমণ করছে। আবার কখনো তারা পতিত ফ্যাসিবাদের প্রতীক-স্থাপনার প্রতি জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ নিয়ে সেখানে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করছে। কৃষকের ভাস্কর্যসহ নানা রকম ভাস্কর্য ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারকে ভাঙচুর চালাচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি তুলছে। সারা দেশে একের পর এক মাজারের ওপরে হামলা ও আক্রমণ চলছে। তৌহিদি জনতাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের হুমকি-ধমকিতে প্রশাসন নিরাপত্তা বিধানের পরিবর্তে ওরস শরীফ ও মেলা বন্ধ করে দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার জননিরাপত্তা প্রদানে, বিশেষ করে সব মানুষের ধর্মীয় ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে। এর ফলে পতিত ফ্যাসিবাদীশক্তি বিশ্বে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের কবলে যাওয়া দেশ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চরমভাবে ব্যর্থ সরকার হিসেবে দেখাতে পারছে। এভাবেই তারা দেশে ও বিদেশে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারছে।
বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘এ অবস্থায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এবং অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করা বাংলাদেশের সমস্ত স্তরের জনগণের প্রতি আমাদের আহ্বান, দেশে ও বিদেশে আওয়ামী এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের নানারকম চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও উসকানিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করুন।’
বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের বাইরে থেকে যাঁরা নানাভাবে উসকানি দিচ্ছেন, প্রকারান্তরে তাঁরা দেশে বিভক্তির রাজনীতি তৈরির মাধ্যমে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তিকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলছেন। ফ্যাসিবাদী শক্তির হাতেই তাঁরা নানারকম অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। সরকারকে বিপদে ফেলছেন। এভাবে তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানকেই দুর্বল করে ফেলতে ভূমিকা রাখছেন। ফলে যেকোনো ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উসকানি থেকে সবাইকে সাবধান থাকার আহ্বান জানান বিবৃতিদাতা নাগরিকেরা।
বিবৃতিদাতারা চারটি দাবি তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো—১.
২. সব ধরনের মত-পথের বই প্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা নিশ্চিতে যেকোনো ফ্যাসিবাদী হামলা মোকাবিলায় বইমেলা ও প্রকাশনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কোনো গোষ্ঠীর উসকানি, দাবি বা হামলায় কোনো অবস্থাতেই যাতে কোনো স্টল সাময়িকভাবেও বন্ধ করা না হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক যদি তা নিশ্চিত করতে না পারেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি তাঁর পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।
৩. সারা দেশে মাজার, ওরস শরিফ ও মেলার ওপরে আক্রমণ; নারী ফুটবলের ওপর হামলা; বিভিন্ন ভাস্কর্য ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কার্যকর ভূমিকা দেখতে চান বিবৃতিদাতা নাগরিকেরা। এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের ব্যবস্থা করা হোক। মানে দোষী প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সাজার ব্যবস্থা করা হোক।
৪. অবিলম্বে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে হবে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিবৃতিতে সই করা ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন—আজফার হোসেন (শিক্ষক, গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি), জোবাইদা নাসরীন (শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), হেলাল মহিউদ্দীন (শিক্ষক, মন্টক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি), ফাহমিদুল হক (লেখক ও শিক্ষক), রাহাত মুস্তাফিজ (লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট), কায়সুল খান (গবেষক ও কলামিস্ট), লুবনা ফেরদৌসি (শিক্ষক), কাশফিয়া নাহরিন (শিক্ষার্থী), মেহেরান সানজানা (অভিনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট), খন্দকার সুমন (চলচ্চিত্র নির্মাতা), সাইদুর রহমান (সংবাদকর্মী), সহিদুজ্জামান পাপলু (রাজনৈতিক কর্মী), প্রীতম শুভ (সংস্কৃতিকর্মী), শ্রাবণী মজুমদার (প্রকাশক), নাসরিন খন্দকার (নৃবিজ্ঞানী), বাধন অধিকারী (সাংবাদিক), লুনা রুশদী (লেখক), পাভেল পার্থ (লেখক ও গবেষক), অনিক দেবনাথ (উন্নয়নকর্মী), রায়হান রাইন (শিক্ষক), মারজিয়া প্রভা (অ্যাক্টিভিস্ট) প্রমুখ।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ সরক র বইম ল উসক ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
প্রযুক্তি কি ডিমেনশিয়া বাড়িয়ে দিচ্ছে? ৫৭টি ভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর তথ্য
প্রযুক্তির কল্যাণে হুটহাট বড় পরিবর্তন আসা নতুন কিছু নয়। করোনা মহামারির আগে বাসা থেকেও যে অফিস করা সম্ভব, সেটা মানতে চাইতেন না অনেকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হোম অফিস হয়েছে স্বাভাবিক। একই ঘটনা ঘটেছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। একসময় যেকোনো তথ্য খুঁজে বের করার জন্য শরণাপন্ন হতে হতো সার্চ ইঞ্জিনের; এআই সেই উত্তর সবিস্তারে দিয়ে দিচ্ছে মুহূর্তেই। ফলে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শুধু জীবনকে সহজতর করছে না, বাঁচিয়ে দিচ্ছে সময় ও পরিশ্রমও। কিন্তু এই বেঁচে যাওয়া সময় ও পরিশ্রম মস্তিষ্কের ওপর ঠিক কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস ও বেলোর ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, এত দিন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানব মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমার যে গুঞ্জন ভেসে বেড়িয়েছে, তার কোনো সত্যতা নেই। ‘নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ নামে যে হাইপোথিসিস আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই গবেষকদের কাছে। বরং পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষদের স্মার্টফোন, কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার তাঁদের স্বাভাবিক স্মৃতিভ্রম অনেকটা স্তিমিত করে।
ডিজিটাল ডিমেনশিয়া কী২০১২ সালে প্রথম ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী ও মনোবিদ ম্যানফ্রেড স্পিৎজার। মূলত যে হারে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে এবং মানুষ যান্ত্রিক পর্দার সামনে প্রতিদিনের বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছে, তাতে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে অনেকটাই। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলোও মনে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে অনেকে। যেমন ফোন নম্বর। একসময় প্রিয়জনের ফোন নম্বর আমাদের মুখস্থ থাকত। এখন ফোন নম্বর ঠাঁই পায় মুঠোফোনের কনটাক্ট লিস্টে। ফোন নম্বর মনে রাখার চেষ্টাই করে না কেউ। আবার অনেকক্ষণ যান্ত্রিক পর্দার সামনে থাকলেও সেখান থেকে শেখার ইচ্ছা থাকে না অনেকের। চোখের সামনে যা আসছে, স্ক্রল করে চলে যাচ্ছে পরের কোনো কনটেন্টে। এতে মনোযোগ হারিয়ে যায় দ্রুত। আর প্রযুক্তির এমন অতিব্যবহার যে স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে, একেই ধরা হয় ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ হিসেবে।
আরও পড়ুনডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহারের সময় ২০-২০-২০ নিয়ম মানাটা কেন জরুরি২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩গবেষণা যা বলছেপ্রায় ৪ লাখ ১১ হাজার পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের ওপর চালানো ৫৭টি ভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে স্মৃতিভ্রম দেখা দেয়, তার অনেকটাই হ্রাস করে প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে স্মৃতিশক্তি কমে আসার আশঙ্কা প্রায় ৫৮ শতাংশে নেমে আসে।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বরং আরও কিছু সূচকের (যেমন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থা) ওপর নির্ভর করে। মজার ব্যাপার হলো, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার থেকেও বেশি কার্যকর প্রযুক্তির ব্যবহার।
তবে এর সবকিছুই নির্ভর করছে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের ওপর। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা বেশির ভাগ সময়ই অনলাইনে কাটান ইউটিউব ভিডিও অথবা ফেসবুক স্ক্রল করে। এতে তাঁদের মস্তিষ্কের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। মস্তিষ্ক সচল রাখতে পারে এমন কনটেন্টে তাঁদের মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারলে আনন্দ যেমন পাবেন, তেমনই ডিজিটাল দুনিয়া সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে যাবে। এ ছাড়া অনলাইনের হাজারো গুজব ও উসকানি থেকে মুক্ত থাকবেন তাঁরা।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট
আরও পড়ুনমাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩