পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তার রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ বিতর্ক উঠেছিল দেশভাগের আগেই। সে সময়ে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহের হোসেন, আবদুল হক প্রমুখ বাংলা ভাষার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। ১৯৪৭ সালের পয়লা সেপ্টেম্বরেই তমদ্দুন মজলিস গঠনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। তারা পাকিস্তানবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নটি সামনে আনে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা এ সংগঠনের মধ্যে ছিল না।

এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুল মতিন বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন, আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক প্রক্রিয়ারও সূচনা করেন। পরে তিনি পরিচিত হন ‘ভাষা মতিন’ নামে। তিনি ছিলেন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী। তখন গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এ সংগঠনও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে অগ্রসর হয়।

সংগঠনটির পেছনে সক্রিয় ছিল গোপন কমিউনিস্ট পার্টি। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর্যায়ে বাংলা ভাষার, বাংলা সাহিত্যের এবং বাংলায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এ দেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সরকারি অফিসে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে এবং সে ধারা চলমান আছে। নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষা চালু থাকলেও উচ্চ আদালতে অবহেলিত। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের জন্য অনেক বই ইংরেজি থেকে, আরও কোনো কোনো ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়েও বাংলা প্রচলনের আয়োজন দেখা গেছে। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করতে পারিনি। স্বীকার করতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার গুরুত্ব আগের থেকে কমে গেছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংলিশ ভার্সন চালু করা হয়েছে এবং তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে মূলধারার শিক্ষা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার কমেছে।

আমরা যদি প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার উন্নয়ন চাই বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকেই অবলম্বন করা জরুরি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইংরেজির অপরিহার্যতা আছে। ভালোভাবে ইংরেজি শেখানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার। সুষ্ঠু জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ন করে, জনসমর্থন নিয়ে তার বাস্তবায়ন দরকার।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি আছে, তা বাংলা ভাষার উন্নতির পথে অন্তরায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে নানা ধারায় বিভক্ত রাখার ফলে এটি জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গঠনের সহায়ক হয়নি।

জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি এবং ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি আর ভাষার উন্নতিও অবিচ্ছেদ্য। ভাষাকে উন্নত না করে আত্মনির্ভর স্বাধীন আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতি সম্ভব হয় না। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল, ভাষাও বিকাশশীল। প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা ভাষাকে আমরা যতটা গুরুত্ব দিই, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া আমাদের কর্তব্য।

পৃথিবীতে প্রায় ২০০ ভাষায় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান এখনো ওপরের দিকেই আছে। এ ছাড়া বিশ্বে আরও কয়েক হাজার জনগোষ্ঠী আছে, যাদের আলাদা ভাষা আছে। বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশে ৪৫টি নৃগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র মাতৃভাষা আছে, সেগুলোও বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

আমাদের উচিত একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা এবং রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র দুটোকেই যথাসম্ভব উন্নতিশীল রাখা। তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব আর নতুন রাজনীতি ও সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন উপলব্ধি দরকার।

মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রভাষা বলতে কেবল অফিসের ভাষা বোঝায় না, বোঝায় তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু। রাষ্ট্রভাষার মধ্যে অফিস চালানোর ভাষা আছে, সেই সঙ্গে আছে জাতীয় জীবনে জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা; আছে আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভাষা। সেখানে বাংলা ভাষা আরও গুরুত্ব ও মনোযোগ দাবি করে।

আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা না টিকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও টিকবে না। দেশ থাকবে; মাটি, মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, নদীনালা ও আকাশ-বাতাস থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে না। যাঁরা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বদলে ইংরেজির প্রচলন চান, তাঁরা বাংলাদেশের কল্যাণ চান না।

বাংলা ভাষার উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশের উন্নতি হবে না। বাংলাদেশের উন্নতি ছাড়া বাংলা ভাষার উন্নতি সম্ভব হবে না। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা দুটো সম্পর্কেই নতুন চিন্তা ও নতুন জাগরণ দরকার।

# আবুল কাসেম ফজলুল হক: শিক্ষাবিদ ও বাংলা একাডেমির সভাপতি

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র র জন য পর য য় স গঠন দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে

জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।

আজ সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি সভায়’ এই সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।

তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে। এসব সুপারিশ জমা দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আজ জরুরি বৈঠকে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ