অর্থনীতির সংস্কার করেছিলেন সাইফুর রহমান
Published: 28th, February 2025 GMT
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। সমাজের সব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তিনি কাজ করছেন। দাতাদের সাহায্যনির্ভরতা থেকে অর্থনীতিকে বের করতে বাণিজ্য উদারীকরণ করেছেন। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে চালু করেন ভ্যাট আইন। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেন। সব মিলিয়ে সাইফুর রহমান অর্থনীতির প্রথম সংস্কার করেন। সেটির সুফলও পেয়েছে দেশ।
দৈনিক বণিক বার্তা ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) যৌথ উদ্যোগ ‘গুণীজন সংবর্ধনা’র সপ্তম আয়োজনে এভাবেই প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে স্মরণ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
অনুষ্ঠানে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে মরণোত্তর সম্মাননা জানানো হয়। তাঁর পক্ষে তিন নাতি—নাবিল ইলহান, এম সাফির রহমান ও এম বাসির রহমান সম্মাননা গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর দুই ছেলে এম কায়সার রহমান ও নাসের রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
আজ শুক্রবার রাতে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে সম্মাননা জানানো হয়। বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইডিএসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কাজী ইকবাল।
এম সাইফুর রহমান ১৯৭৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সরকারের অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ভ্যাট, তৈরি পোশাক খাতে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা চালুসহ অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ও নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আমি চাকরিজীবনে চমৎকার এই মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, বন্ধুসুলভ ও বাংলাদেশ দরদি ছিলেন। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার সময় তিনজন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি। সাইফুর রহমান রাজনীতিবিদ হওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘সাইফুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৯১ সালে। স্বৈরাচার সরকার যখন বিদায় নেয়, তখন রিজার্ভ ও ট্রেজারি খালি করে যায়। বর্তমানের মতো তখনো একই অবস্থা ছিল। সে সময় বাজেট সহায়তা দেওয়ার জন্য আইএমএফ কর ও জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে বলল। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক বাজেট সহায়তা দেওয়ার জন্য কাস্টমস শুল্ক ৭৫ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিল। তাদের প্রস্তাব পর্যালোচনা করার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। আমি একটা মডেল দাঁড় করালাম। তাতে দেখলাম, দুইটা প্রস্তাব সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ কাস্টমস শুল্ক ৭৫ শতাংশ বাড়ালে কর ও জিডিপির অনুপাত বাড়বে না। কাজটি করতে তিন দিন লাগল। সাইফুর রহমান স্যার আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমরা যেতেই উনি বললেন, কাস্টমস শুল্ক ৭৫ শতাংশ করা যাইত না। উনি এমনই তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন।’
ফাওজুল কবির খান বলেন, ভ্যাট আইন পাস হবে কি না, শেষ সময় পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল না। সেদিন সংসদে মন্ত্রী ও এমপি সবাই আইনটির বিরোধিতা করেছিলেন। একমাত্র তিনিই (সাইফুর রহমান) দেশের জন্য একা দাঁড়িয়েছিলেন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, দেশের অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। তবে সাইফুর রহমানের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে দিয়ে যাওয়ার কারণে অন্ধকারে নিপতিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘এখন অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের সময়। আমরা আশা করি, সম্পদের সমবণ্টন হবে, অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হবে না এবং স্বজনতোষী পুঁজিবাদের সৃষ্টি হবে না।’
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সাইফুর রহমান ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। বেসরকারি খাত, পণ্য রপ্তানি ও রাজনীতি—সব দিকেই তিনি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তিনি দেশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে নিয়ে গেছেন। সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন। সেটি করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের বিরাগভাজন হয়েছেন। তারপরও সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে চেষ্টা করে গেছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কারে পেইনফুল সিদ্ধান্তগুলো সাইফুর রহমান নিয়েছেন উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আগামী দিনে বিএনপি যে সংস্কারের কথা বলছে, তার মধ্যে সাইফুর রহমান যেসব পদচিহ্ন রেখেছেন, সেগুলোকে এগিয়ে নেওয়াও রয়েছে।
বিআইডিএসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কাজী ইকবাল বলেন, সাইফুর রহমানের সঙ্গে বিআইডিএসের সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি গবেষণা পছন্দ করতেন। গবেষকদের সম্মান করতেন। নব্বইয়ের দশকে দেশের বাণিজ্য উদারীকরণে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী।
সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান বলেন, সংস্কার কেন ও কীভাবে করতে হয়, সেটি খুব ভালো করে জানতেন সাইফুর রহমান। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ও ভ্যাট আইন পাস করার সময় তিনি ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করার কথাও বলেছিলেন। জাকির আহমেদ খান আরও বলেন, ‘সাইফুর রহমান ছিলেন দেশপ্রেমিক মানুষ। স্বার্থপরতার কোনো প্রমাণ তাঁর কাছ থেকে পাইনি।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এম এ কাশেম ও তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠান সহযোগিতায় ছিল ইউনাইটেড ফাইন্যান্স।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন উপদ ষ ট ন বল ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দহন থেকে জংলি
‘আমি নিয়মিত অনেক চিত্রনাট্য পাচ্ছি। নিয়মিত সেসব সিনেমা করলে প্রচুর টাকা কামাতে পারব। ফিন্যান্সিয়ালি জায়গাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দর্শক আমাকে যেভাবে দেখতে চাচ্ছেন, তেমন গল্প পাচ্ছি না। দর্শক-প্রত্যাশার চেয়ে ভালো কিছু দিতে চাই। যখন সামগ্রিক চিন্তা করি, তখন ভাবতে হয় আমি কতটা আয় করলাম তার চেয়েও দর্শকের সামনে কীভাবে আসছি, সেটি মুখ্য। এটি একটি প্যাকেজ। মাঝে একটি-দুটি গল্প পছন্দ হয়। সেসব টিমের যে অবস্থা, বাজেট সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে ভালো গল্প তুলে আনা কঠিন হবে। তখন আমি না করে দিই। আমি চাইছি নিজের মতো করে কাজ করতে। জীবনে অনেক সিনেমা করতে হবে, এমন চিন্তা নেই। আমার মতো করে অল্প কিছু কাজ করে যেতে চাই।’ বলছিলেন সিয়াম আহমেদ।
গেল ঈদে মুক্তি পেয়েছে সিয়াম আহমেদ অভিনীত সিনেমা ‘জংলি’। যে সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নায়কের আবেগ ও পরিশ্রমের দীর্ঘ গল্প। সিনেমাটি করতে একচুলও ছাড় দেননি সিয়াম। ফলাফল হিসেবে পেয়েছেন দর্শকের অবারিত ভালোবাসা। জংলি মুক্তির পর তাই গল্পটি হয়ে উঠেছে সবার। দর্শকরা হলে গিয়ে কেঁদেছেন, গল্পে বুঁদ হয়ে থেকেছেন। করেছেন সিয়াম ও তাঁর টিমের প্রশংসা।
সিয়াম বললেন, ‘এ সিনেমায় আমি দীর্ঘ সময় দিয়েছি। সিনেমার জন্য চুলদাড়ি বড় করেছি। একটি সিনেমার জন্য আমার পাগলামি নিয়ে মা-বাবার মনে হয়তো প্রশ্ন ছিল, ছেলেটি চুল-দাড়ি বড় করে কী করছে? কী করেছি, এটি তো তাদের বোঝানো যায় না। তবে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, সিনেমাটি মুক্তির পরে গল্পটি তাদের টাচ করবে। কারণ, গল্পটিই এমন, এটি প্রথম যদি কাউকে টাচ করে, সেটি সন্তানের মা-বাবাদের। যে কারণে তাদের একসঙ্গে হলে নিয়ে কাছ থেকে অনুভূতি জানার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত মা-বাবার কাছ থেকে সেরা ফিডব্যাক পেয়েছি। বাবা-মেয়ের গল্পটি দেখে তারা ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু আমার বাবা-মা নন, অন্য মা-বাবাদের কাছেও গল্পটি নিজেদের হয়ে উঠেছে। তারা সিনেমাটি দেখে কেঁদেছেন। হল রিঅ্যাকশনের সেসব ভিডিও সবাই দেখেছেন। সব মিলিয়ে আমরা সফল। আমাদের জংলি সফল।’
মুক্তির পর থেকে ‘জংলি’ সিনেমার এগিয়ে যাওয়ার গ্রাফ দেখলে শুধু দর্শকের ভালোবাসায় সফল নয়, ব্যবসায়িকভাবেও সিনেমাটি যে সফল তার চিত্র বিদ্যমান। মাত্র ৮টি শো দিয়ে শুরু হওয়া সিনেমাটি ঈদের এতদিন পরও মাল্টিপ্লেক্সে ত্রিশটির মতো শো নিয়ে দাপিয়ে চলছে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও জংলি হয়ে উঠেছে দর্শকদের সিনেমা।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টাইগার মিডিয়ার কর্ণধার জানিয়েছেন, জংলি প্রায় ছয় কোটির (গ্রস) ক্লাবে প্রবেশ করেছে।
ঈদে মুক্তির পর থেকে ক্রমশ দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘জংলি’। এমনকি, দেশের সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে কানাডা, আমেরিকা ও ইউকে’র ৪০টি থিয়েটারে মুক্তি পেয়েছে ‘জংলি’। গত ২৫ এপ্রিল থেকে স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো-এর পরিবেশনায়, ঈদের সিনেমাগুলোর মধ্যে দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি থিয়েটারে একযোগে মুক্তি পেয়েছে এ সিনেমাটি। কানাডা ও আমেরিকার বক্স অফিসে প্রথম ৩ দিনের গ্রস ৩৫,০০০ ডলার আয় করে শুভসূচনা করেছে ‘জংলি’।
ঈদে আরও অনেক ছবি মুক্তি পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে জংলি বিশেষ হয়ে উঠেছে কেবল বাবা-মেয়ের গল্পের কারণে। সঙ্গে সিয়ামের নজরকাড়া অভিনয়। নৈঋতার পাখি হয়ে ওঠার দারুণ চেষ্টা। দিমিত্রি থে স্টোনহার্ট নামে এক মনীষী বলেছেন, ‘একজন বাবা বলেন না যে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন; বরং তিনি দেখিয়ে দেন যে, তিনি তোমাকে ভালোবাসেন’ জংলি সিনেমায় সিয়াম সেটি বোঝাতে পেরেছেন। ফলে সিনেমাটি হয়ে উঠেছে সবার।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন– ‘পৃথিবীতে আসার সময় প্রতিটি মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে, কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে।’
সিয়াম তাঁর জীবনের সেই দৈত্যকে জাগাতে পেরেছেন। পেরেছেন বলেই হয়তো আজ তিনি সাধারণ সিয়াম থেকে নায়ক সিয়াম হয়ে উঠেছেন। সিয়ামের যাত্রাটা শুরু বেশ আগে হলেও পুরোপুরি শুরু হয় ‘দহন’ সিনেমার মাধ্যমে। রায়হান রাফী পরিচালিত এ সিনেমাটির মাধ্যমে সিয়াম নাটক থেকে পুরোপুরি চলচ্চিত্রের মানুষ হয়ে ওঠেন। সে যাত্রা এখনও চলছে। প্রথম সিনেমায় যে সিয়ামকে সবাই দেখেছেন, জংলির সেই সিয়াম যেন আকাশ-পাতাল। তখন সিয়াম ছিলেন তরুণ, এই সিয়াম এখন বাবা। পর্দায় ও বাস্তবে দুই জায়গাতে দারুণ এক বাবা হয়ে উঠেছেন তিনি। নিজের অভিনয় ক্যারিয়ার নিয়ে আগামী পরিকল্পনা কী? প্রশ্ন রাখলে নায়ক বলেন, ‘আমি নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাই। যারা আমার আগের কাজ দেখেছেন, তারা যেন বলেন, আগের কাজকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছি। আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন।’