গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে শেখ হাসিনা দেশ ও দশকে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় রেখে দেশ ত্যাগ করেছেন। অরাজক অবস্থার খেসারত দিতে হচ্ছে সমগ্র জাতিকে। শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট ও পাচার করেছেন, এটা প্রমাণিত। মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য অসংখ্য প্রাণ সংহার করেছেন, এ সত্য অনস্বীকার্য। কিন্তু তাতে শেখ হাসিনার পিতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দায় কী? বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান তো প্রতিষ্ঠিত সত্য!

শেখ হাসিনা-পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ড.

মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের একজন বলেছেন, বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা মনে করে না। তিনি বলেছেন, আমাদের আরও অনেক ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ রয়েছেন। কিন্তু আর কেউ কি ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ধারাবাহিক নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন?

আমরা জানি, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন। সেখান থেকে ক্রমেই গড়ে ওঠে যে ভাষা আন্দোলন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তার অন্যতম জননেতা। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উপস্থাপিত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। ওদিকে রাজপথে আওয়ামী লীগ ১৭ জুন স্বায়ত্তশাসন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলাসহ ২১ দফা দাবি ঘোষণা করে। সে বছর ১৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের নাম, রাষ্ট্রভাষা, স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব বাংলার স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিগুলো উত্থাপন করেন।
১৯৫৫ সালের ৯ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে বাংলায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের দাবি করেন এবং শেষ পর্যন্ত অধিবেশনের সভাপতি ডেপুটি স্পিকার তা মেনে নেন। অবশেষে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিলেও চক্রান্ত থাকে অব্যাহত। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ‘৬ দফা’ দাবি জাতির সামনে পেশ করেন। ফলে তাঁকে আসামি করে পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা দায়ের ও কারাবন্দি করে। গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেন। অতঃপর ৬ দফা হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রাহুমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশরূপে বিশ্বমানচিত্রে আপন অস্তিত্ব ঘোষণা করে।
শেখ মুজিবুর রহমান হুজুগে নয়; স্কুলজীবন থেকেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছেন। কোনো গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দল নয়; বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে এই উপাধি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই একাত্তরের ৭ মার্চ তিনি হয়ে উঠেছিলেন গোটা বাংলাদেশের অঘোষিত প্রতিনিধি। 

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকেও ইদানীং সুযোগসন্ধানী অনেকে গুরুত্বহীন প্রমাণের অপচেষ্টা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারও জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে ৭ মার্চ বাতিল করেছে। এ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে– অন্তর্বর্তী সরকারও ইতিহাসের সত্য আড়াল করতে চায়। অন্যথায় যে বক্তৃতায় স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছে এবং বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উজ্জীবিত করেছে, সেই ঐতিহাসিক দিনকে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টার আর কী কারণ থাকতে পারে? অথচ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ সেকশনে স্পষ্ট বলা হয়েছে– ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাংলাদেশের জনগণকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’ সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘এই ভাষণ কার্যকরভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। উপনিবেশ-পরবর্তী জাতি-রাষ্ট্রগুলির অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে ব্যর্থতা কীভাবে বিভিন্ন জাতিগত, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর জনসংখ্যাকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে, তার একটি বিশ্বস্ত দলিল এই ভাষণ।’ 

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছর পর শুধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চ নয়;  ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসও বাতিল করা হয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেটাও কি তাহলে অস্বীকার করতে চায়? শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশ-বিদেশে ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের অগ্রাধিকার নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবের বদলে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কে বিতর্ক তোলা অপ্রয়োজনীয়। প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার মিথ্যারই নামান্তর। ইতিহাসের ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তী সরকারের সসম্মানে বিদায় নেওয়াই বরং সময়ের দাবি।

ড. নূরুর রহমান খান: প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ খ ম জ ব র রহম ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলটি বলেছে, আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।

শুক্রবার জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।

তারা বলেন, এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

বিবৃতিতে নেতারা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, গণমানুষের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারের ব্যবস্থা। এই বিষয় দুটির দৃশ্যমান অগ্রগতিই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি রচনা করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানায় জেএসডি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • ‘শত শত বাস আসছে, পা ফেলানোর জায়গা নাই’
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়
  • লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি