দুঃশাসন মানুষকে হতভাগ্য আর উদ্ধত করে তোলে। দুঃশাসনের একটি ভয়ানক ডমিনো ইমপ্যাক্ট থাকে। এতে জুলুম পর্যায়ক্রমে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের দিকে আবর্তিত হতে থাকে, যা সুশাসনের ঠিক বিপরীত। 

পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র কার্যকর কিনা, তা বুঝতে হলে আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্রমিক অগ্রগতির গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী কিনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ গত ৫৩ বছরে এসব ক্ষেত্রে কিছু পোস্টার পার্সন তৈরি করা ছাড়া মৌলিক অগ্রগতি আনতে পারেনি।

দেশের নারী জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ অংশ পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া, মজলুমদের মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়িত। নারীদের এই দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে পুঁজিপতি ও শিল্পমালিকরা তাদের সস্তাশ্রমের ওপর ভর করে কারখানা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছে। শ্রমবাজারে ব্যাপক নারী শ্রমিকের উপস্থিতির কারণে পুরুষদের মজুরিও ব্যাপক হারে সংকোচন করতে সক্ষম হয়েছে। গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের মতো স্বাভাবিক জৈবিক কাজ দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থার জন্য নারীদের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে।

এ দেশে নবজাতকের মৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুহার এখনও সন্তোষজনকভাবে কম নয়। এ দেশের বেটাগিরি রাজনৈতিক সংস্কৃতি নারীদের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী পরিসরগুলোতে প্রকৃত অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করে প্রতীকী প্রতিনিধিত্বে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।

নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে প্রণীত আইনগুলো স্পষ্টতই কার্যকর নয়। সহিংসতার শিকার নারী বিচার চাইতে গিয়ে পুনরায় সহিংসতার শিকার হচ্ছে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুশাসনগুলোকে প্রায়ই নারীদের নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্যকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে।

বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির প্রশ্ন নারী মুক্তির প্রশ্ন থেকে আলাদা নয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ দেশের প্রতিটি নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কোনো রাষ্ট্রকাঠামো আমরা গড়ে তুলতে পারিনি, কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার যত বলয় আমাদের সমাজে ছিল, তার প্রতিটিই সুকৌশলে ধ্বংস করা হয়েছে।

এ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী-পুরুষের ন্যায়ানুগ সমতার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বাড়ানোর জন্য সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পদে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

অর্থনৈতিকভাবে নারীদের জন্য কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের সুযোগ বাড়াতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কর্মক্ষেত্র ও প্রকাশ্যে তাদের অংশগ্রহণ সহজ করতে হবে। নারীর নিরাপত্তায় আইনের কঠোর বাস্তবায়ন ও সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈষম্য দূর করে সমতাপূর্ণ সমাজ গঠন সম্ভব।

এর জন্য অবশ্যই পরিবার ও সমাজে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহিমূলক কার্যকরী রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য় ন গর ক প র ট ক র যকর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

জাতিসংঘের কিছু সুপারিশ মানা হয়নি সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের সংশোধনীতে জাতিসংঘের কিছু সুপারিশ মানা হয়নি। অধ্যাদেশটি জারির আগে গত মার্চে জাতিসংঘ এ বিষয়েটি বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছিল। কিন্তু গত মাসে জারি করা সংশোধিত অধ্যাদেশে দেখা যায় কিছু সুপারিশ এড়ানো হয়েছে।

বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে গত মাসে সংশোধিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে আগের আইনের ৯টি ধারা বাদ পড়েছে। তবে বাদ পড়া ধারাগুলোর কিছু বিধান নতুন অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে।

এই অধ্যাদেশের প্রথম খসড়াতেও কিছু ধারা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। সে অবস্থাতেই গত ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ তা অনুমোদন দেয়। পরে সমালোচনার মুখে কিছু সংশোধনী আনা হয়। গত মার্চে ওই সংশোধনের সময় জাতিসংঘ কিছু সুপারিশ করে। কিন্তু গত ২১ মে চূড়ান্তভাবে যে অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে জাতিসংঘের কিছু সুপারিশ মানা হয়নি।

অবশ্য মানবাধিকারকর্মীরা বাতিল হওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে তুলনা করে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ কে তুলনামূলকভাবে ভালো বলেছেন। তাঁরাও অবশ্য অধ্যাদেশের কিছু বিষয় নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সংশোধিত অধ্যাদেশে এখনো অনেক ধারায় মতপ্রকাশকে ‘অপরাধ’ হিসেবে রাখা হয়েছে অস্পষ্ট সংজ্ঞার মাধ্যমে, যা অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান, যার ভয়ে অনেকে মতপ্রকাশে নিরুৎসাহিত হবেন।

সংশোধিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে বলা হয়, সাইবার নিরাপত্তা আইনে নাগরিক সুরক্ষা–সংক্রান্ত বিধান অপ্রতুল থাকায় অপপ্রয়োগ ও নিপীড়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব করেছিল। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) করা হয়। তবে আইনগুলো জনগণকে সুরক্ষা দিতে পারেনি বলে সমালোচনা ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই আইনগুলো হয়ে উঠেছিল নিপীড়নমূলক। ওই আইনগুলো আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ায় এবং মতপ্রকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্যমূলক হওয়ায় দেশে–বিদেশে ছিল সমালোচনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ করে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাকে ধারাগুলো সংশোধনে সুপারিশ দেয় জাতিসংঘ। তবে সংশোধিত অধ্যাদেশে তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটেনি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সংশোধিত অধ্যাদেশে এখনো অনেক ধারায় মতপ্রকাশকে ‘অপরাধ’ হিসেবে রাখা হয়েছে অস্পষ্ট সংজ্ঞার মাধ্যমে, যা অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান, যার ভয়ে অনেকে মতপ্রকাশে নিরুৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি নির্বাহীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামো রাখা হয়েছে, যার নজরদারিতে নেই কোনো বিচারিক তত্ত্বাবধান বা কোনো জবাবদিহি।

অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) ১৯ ধারা মেনে চলার বাংলাদেশের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা একাধিকবার স্মরণ করিয়েছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘ বলছে, সরকারের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। তবে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের সংশোধনীতে তা অনুপস্থিত, যা নিশ্চিত করতে সরকার আইনত বাধ্য।

গত ১৭ মার্চ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, প্রচার ও সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ দূত আইরিন খান বাংলাদেশকে বলেছিলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করায় তিনি মর্মাহত। যদিও অধ্যাদেশে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ অনেক ধারা বাতিল করা হয়েছে। অন্য অনেক বিষয়, যা নিয়ে জাতিসংঘের গভীর উদ্বেগ ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো গ্রহণ করা হয়েছে। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ সংশোধনের সময় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় কিছু ধারা নিয়ে উদ্বেগ ও সুপারিশ করেছিল। অধ্যাদেশে হ্যাকিংয়ের মতো সাইবার অপরাধ ও লিঙ্গভিত্তিক হয়রানিকে এক করে দেখা হয়েছিল। সংশোধনীতে অপরাধের ভিন্নতা আমলে নিয়ে শাস্তি ও জরিমানা ভিন্ন করেছে সরকার। এ ছাড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংশোধনীর ২৩ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘হুইসেলব্লোয়ার’দের ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ আইনের আওতায় আনা যাবে না। তবে ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’র কোনো ব্যাখ্যা অধ্যাদেশে দেওয়া হয়নি। ফলে ভিন্ন মতপ্রকাশে এ আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।

সাইবার সন্ত্রাসকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে সংশোধিত অধ্যাদেশের ২৩ ধারায়। এ ধারাটি অত্যন্ত অস্পষ্ট, যা রাজনৈতিক ও মানবাধিকারকর্মীসহ সাংবাদিকদের বৈধ মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করবে। জাতিসংঘ বলছে, এ ধারায় অপরাধের কঠোর শাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞাটি সুস্পষ্ট করা এবং আন্তর্জাতিক মান ও বিশ্বব্যাপী মানসম্পন্ন অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাকে ধারাগুলো সংশোধনে সুপারিশ দেয় জাতিসংঘ। তবে সংশোধিত অধ্যাদেশে তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটেনি।

সংশোধিত অধ্যাদেশের ২৫ ধারায় যৌন হয়রানি, প্রতিশোধমূলক পর্নোগ্রাফি, ব্ল্যাকমেইলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে আমলে নেওয়াকে সাধুবাদ জানিয়েছে জাতিসংঘ, যা ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ বা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে’ ছিল না। তবে এখানে অশ্লীলতার পূর্ণ ব্যাখ্যা বা সীমা ঠিক করে দেওয়া হয়নি। এতে করে অস্বচ্ছভাবে এর প্রয়োগ হতে পারে।

সাইবার স্পেসে জাতিগত বিষয়ে সহিংসতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সংশোধিত অধ্যাদেশের ২৬ ধারায়। এখানে ‘ঘৃণা’ বা ‘বিদ্বেষমূলক’ বক্তব্যের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ফলে অস্পষ্টতা থেকে গেছে, যা সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষ মত এবং সমাজ সংস্কারকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগের সুযোগ থাকছে। এ ধারাটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আইসিসিপিআরের ধারা ২০ (২) সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে করে জাতিসংঘ।

সংশোধিত অধ্যাদেশের ২৭ ধারায় অপরাধ সংঘটনে ‘সহায়তা’ করলে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু ‘সহায়তা’ কী, তা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এতে করে এ ধারার ফাঁকে কর্তৃপক্ষ কাউকে অযৌক্তিকভাবে ফৌজদারি অপরাধে জড়িত করতে পারে। এ ধারার অস্পষ্ট ভাষা এবং মামলা-মোকদ্দমার আশঙ্কা মানুষকে অনলাইন বিতর্কে অংশগ্রহণ বা তথ্য প্রচার থেকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। এর ফলে স্বআরোপিত বিধিনিষেধ ও ভিন্নমত পোষণকারীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে।

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে জাতিসংঘের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো গ্রহণ করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাতিসংঘের কিছু সুপারিশ মানা হয়নি সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে