খোঁড়াখুঁড়ি ও জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি, সনদ পেতে ঘুষ-হয়রানির অভিযোগ
Published: 11th, March 2025 GMT
কোথাও পানি নিষ্কাশনের নালা ও রাস্তার উন্নয়নকাজের জন্য দীর্ঘদিন ধরে সড়ক খুঁড়ে-কেটে রাখা হয়েছে। হেঁটে চলাচলও করা যাচ্ছে না। কিছু এলাকায় পয়োনালার পানি আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও বাসাবাড়ির বর্জ্য নিয়ে মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় হাঁটার রাস্তা (ওয়াকওয়ে), পার্ক-মাঠ কিছুই নেই। সড়কবাতিগুলো নষ্ট হয়ে আছে মাসের পর মাস। ওয়ার্ড কার্যালয়ে গেলে হয়রানি করা হচ্ছে। ঘুষ না দিলে সনদ পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন সব অভিযোগ জানালেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সঙ্গে যুক্ত নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশান ২ নম্বরে ডিএনসিসির নগর ভবন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক গণশুনানিতে এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এমন অভিযোগ জানান। নাগরিকসেবা–সংক্রান্ত বিষয়ে এ গণশুনানির আয়োজন করে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ।
শুনানি শুরু হয় বেলা ১১টার কিছু পরেই। গণশুনানিতে ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ উপস্থিত হন একেবারে শেষে, বেলা একটা এক মিনিটে। এর প্রায় আধা ঘণ্টা আগে শুনানিতে যুক্ত হন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো.
ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটের সমস্যার কথা তুলে ধরে ডিএনসিসির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাদেক আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ওই ওয়ার্ড এলাকায় তিনি ২৫ বছর ধরে বসবাস করছেন। গত ১৭ বছরে সেখানে রাস্তার কোনো উন্নয়নকাজ করতে দেখেননি।
সাদেক আহমেদ ভূঁইয়া আরও বলেন, আশকোনার মদিনা টাওয়ার থেকে দক্ষিণখান মূল রাস্তা পর্যন্ত অংশে সড়কটি সংস্কার করা হবে—এমনটা এক বছর আগে শুনেছেন। এই শুষ্ক মৌসুমেও ওই রাস্তায় পানি জমে আছে। প্রধান প্রকৌশলী এ সময় বলেন, সব জায়গায় একসঙ্গে কাজ ধরলে লোকজন বাসা থেকেই বের হতে পারবেন না।
ডিএনসিসির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ বাদশা কয়েকটি সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাত মাস ধরে ওই এলাকায় সড়কবাতি নষ্ট। করপোরেশনকে জানালেও বাতি ঠিক করা হয়নি। নালার ময়লা-আবর্জনা তুলে নালার পাশেই রাখা হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই যা নালায় গিয়ে পড়বে। নুরেরচালা বোটঘাটের রাস্তা দেড় মাসের বেশি সময় কেটে ফেলে রাখা হয়েছে।
ঈদের পরে আমরা এ ধরনের বড় বড় প্রোগ্রামে যাব। ঈদের আগে খুব একটা ঝামেলা করতে চাচ্ছি না এখন। ঈদের পরে গ্র্যাজুয়ালি আমরা রিকশাগুলোকে মেইন রোড থেকে সরিয়ে দেব। এটা হচ্ছে আমাদের টার্গেট।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন, প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ওয়ার্ডের ৪ নম্বর সড়কে নবজাগরণী ক্লাব থেকে মুন্সি মার্কেট এলাকা পর্যন্ত রাস্তার কাজ অনেক দিন ধরে বন্ধ। এ নিয়ে তাঁরা করপোরেশনে গিয়েছেন। করপোরেশন তাঁদের ভোগান্তির মূল্যায়ন করেনি। এমন পরিস্থিতিতে বৃষ্টি হলেই সেখানে কোমরপানি জমার শঙ্কায় রয়েছেন বাসিন্দারা। প্রধান প্রকৌশলী তাঁদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে আবেদনের অনুরোধ জানান।
দীর্ঘ সময় নিয়ে চালানো উন্নয়নকাজে দুর্ভোগ, অপ্রতুল নাগরিক–সুবিধা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ওয়াসার পানির সংকট নিয়ে অভিযোগ দেন ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সৈয়দ আহমেদ। তিনি বলেন, তাঁদের এলাকায় দুই বছর আগে থেকে শুরু হওয়া রাস্তার কাজ শেষ হচ্ছে না। এতে বাসিন্দাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তাঁদের এলাকায় বয়স্ক, নারী ও শিশুদের হাঁটাচলার কোনো সুযোগ নেই। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের পাশে আবদুল্লাহপুর খালের পাড়ে হাঁটার রাস্তা করার আবেদন করা হলেও তা হয়নি। বাসিন্দাদের জিম্মি করে ইচ্ছেমতো ময়লার বিল নেওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ময়লার বিল নগরবাসী জানেন না। এ জন্য মানুষের চোখে পড়ে, এমন বিভিন্ন স্থানে ঠিকাদারের নাম ও নির্দিষ্ট বিল সাইনবোর্ডে লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
ডিএনসিসির ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাত্তার চৌধুরী বলেন, কয়েক দিন আগে তাঁর এক স্কুলশিক্ষকের মৃত্যুসনদ নিতে গিয়ে সাত হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। জন্মনিবন্ধনের সরকারি ফি ৫০-১০০ টাকা হলেও, ২০০–৩০০ টাকা চেয়ে বসে থাকে। ময়লা সংগ্রহের কাজও কল্যাণ সমিতি থেকে জোর করে দখল করে নেওয়া হয়েছে। এ কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। এই ব্যক্তির বক্তব্যের পরে করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা জবাব দেননি।
উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগরের জন্য তিনি চারটি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যেগুলোর ভিত্তিতে ন্যায্য নগর গড়ে তোলা হবে।সন্ধ্যার পর প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নিমন্ত্রণ
গণশুনানির এক পর্যায়ে বক্তব্য দেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এক ঘণ্টা ২০ মিনিট এখানে আমি ছিলাম। মশার ব্যাপারটা কিন্তু তেমনভাবে উঠে আসে নাই। আপনাদের প্রয়োরিটিতে ছিল রাস্তাঘাট, কালভার্ট-ব্রিজ, হোল্ডিং ট্যাক্স। মশার ব্যাপারটা আসেনি। তার মানে এটা হচ্ছে লেস প্রায়োরিটি (কম অগ্রাধিকার)।’
এমন সময় শুনানিতে আসা উত্তরার এক বাসিন্দা ওই কর্মকর্তাকে থামিয়ে বলেন, ‘আপনি বলছেন, মশার বিষয়টি লেস প্রায়োরিটি দিয়ে আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি সে রকম নয়। আপনাকে উত্তরা এলাকায় দাওয়াত দিয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর যদি আমাদের এলাকা পরিদর্শন করতেন, আমরা অনেক খুশি হতাম। আমরা যে বাস্তব পরিস্থিতিতে বসবাস করছি, সেটা তুলে ধরতে পারতাম।’
ঈদের পর অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
গণশুনানিতে উপস্থিত থাকা অনেকেই তাঁদের বক্তব্যে অবৈধ অটোরিকশার চলাচল বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণের দাবি জানান। এ বিষয়ে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘ডিএমপির সঙ্গে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। আমরা গ্র্যাজুয়ালি ফেস আউট করে দিচ্ছি, রিকশাগুলো যাতে মেইন রোডে আসতে না পারে। আমরা একটা ট্র্যাপ তৈরি করছি।’
প্রধান প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘ঈদের পরে আমরা এ ধরনের বড় বড় প্রোগ্রামে যাব। ঈদের আগে খুব একটা ঝামেলা করতে চাচ্ছি না এখন। ঈদের পরে গ্র্যাজুয়ালি আমরা রিকশাগুলোকে মেইন রোড থেকে সরিয়ে দেব। এটা হচ্ছে আমাদের টার্গেট। রিকশা ঈদের পরে মূল সড়কে আসবে না, এই প্ল্যানে আমরা ডিএমপি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আগাব।’
অগ্রাধিকারে ১৮টি ওয়ার্ডের উন্নয়ন
শুনানির একেবারে শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হন ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। প্রথমেই তিনি মশার সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। পরে সার্বিকভাবে তিনি বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগরের জন্য তিনি চারটি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যেগুলোর ভিত্তিতে ন্যায্য নগর গড়ে তোলা হবে। এর মধ্যে প্রথমে পরিবেশ ঠিক করা, দ্বিতীয়ত জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত, তৃতীয়ত আবাসনে ন্যায্যতা এবং চতুর্থত ১৮টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা হবে। নগরবাসীকে সেবা প্রদানে জনবলসংকটের বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড এনস স র কর মকর ত দ র এল ক ম হ ম মদ গণশ ন ন ক জ কর আম দ র এল ক য় সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম, এখানে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই: জেড আই খান পান্না
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।
আজ শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বারের হলরুমে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার সংকট ও আইনি প্রতিকার পাওয়ার পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জেড আই খান পান্না। সেমিনারটির আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস (এইচআরসিবিএম), বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।
বক্তব্যে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এখানে সংখ্যালঘুর কথা বলা হচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। আজ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেখি, জুতা দিয়ে বাড়ি দিতে দেখি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। তাই আমি সবচেয়ে বড় অসহায়।’
এসব কথা বলতে বলতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জীবনে কখনো জেনে-বুঝে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন, তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
জেড আই খান পান্না আরও বলেন, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এটা সাম্প্রদায়িকতার দেশ না। সংবিধানে যেন কেউ হাত না দেয়। সরকারের অনেকেই বিদেশি হয়েও স্বদেশি ভাব দেখাচ্ছেন।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমাজে ন্যায়বিচার বা সুবিচার পাওয়ার কথা থাকলেও তা মিলছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার হয় না। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে বেরিয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন কুমার রায় বলেন, সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা হলেও সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না, এমনকি দুঃখও প্রকাশ করে না।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ শুরু হলে তা দমন করতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে উল্লেখ করে সুমন কুমার দাবি করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনাতনী সম্প্রদায়ের বাক্স্বাধীনতা বন্ধ করতে, নেতৃত্ব দমন করতে এসব করা হচ্ছে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে কে পাল। সঞ্চালনায় ছিলেন এইচআরসিবিএমের বাংলাদেশ চ্যাপটারের আহ্বায়ক লাকি বাছাড়। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ও মো. গোলাম মোস্তফা।